“কানাডার মাটিতে নিজ্জারের মতো আরও হত্যাকাণ্ডের আশঙ্কা রয়েছে,” বলেন কানাডার পররাষ্ট্রমন্ত্রী মেলানি জোলি।
Published : 15 Oct 2024, 12:22 PM
বছরখানেক আগে কানাডার মাটিতে শিখ বিচ্ছিন্নতাবাদী নেতা হরদীপ সিং নিজ্জার হত্যা নিয়ে যে তীব্র বিতর্ক সম্প্রতি তৈরি হয়েছে, তার মধ্যে ভারত ও কানাডার কূটনীতিকদের বহিষ্কার ও সরিয়ে নেওয়ার সিদ্ধান্ত এসেছে।
উত্তর আমেরিকার দেশটির প্রধানমন্ত্রী ট্রুডো বলেছেন, নিজ্জার হত্যায় ভারতীয় এজেন্টরা সরাসরি জড়িত ছিলেন- এমন ‘বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ’ পেয়েছে পুলিশ। এরপরই তার সরকার প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে।
ভারতীয় এজেন্টদের বিরুদ্ধে ‘হত্যাকাণ্ড, জবরদস্তি ও হিংসাত্মক কর্মকাণ্ডে’ জড়িত থাকার অভিযোগ তুলে কানাডীয় পুলিশ বলছে, ওই এজেন্টরা খালিস্তানপন্থি আন্দোলনের সমর্থকদের নিশানা করেছে, যারা ভারতে শিখদের জন্য আলাদা আবাসভূমি চায়।
দিল্লি এই অভিযোগগুলোকে ‘অযৌক্তিক’ বলে প্রত্যাখ্যান করে ট্রুডোর বিরুদ্ধে কানাডার বিশাল শিখ সম্প্রদায় নিয়ে রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের অভিযোগ তুলেছে।
সোমবার বিকালে টেলিভিশনে সরাসরি সম্প্রচারিত বক্তব্যে ট্রুডো বলেন, কানাডায় ‘অপরাধমূলক' কর্মকাণ্ডকে সমর্থন করে ভারত ‘মৌলিক ভুল' করেছে এবং সবশেষ অনুসন্ধান অনুযায়ী তার সরকারকে কাজ করতে হবে।
“আরসিএমপি (রয়্যাল কানাডিয়ান মাউন্টেড পুলিশ, কানাডার জাতীয় পুলিশ সেবা) যে প্রমাণ সামনে এনেছে তা উপেক্ষা করা যায় না।
“এটি এই সিদ্ধান্তে নিয়ে যায় যে, কানাডায় জননিরাপত্তার জন্য হুমকি হয়ে ওঠা অপরাধমূলক কার্যক্রম মোকাবেলা করা প্রয়োজন। এজন্যই আমরা ব্যবস্থা নিয়েছি।”
সব অভিযোগ তীব্রভাবে অস্বীকার করে ভারত বলছে, কানাডা তার দাবির সমর্থনে কোনো প্রমাণ সরবরাহ করেনি।
বিবিসি লিখেছে, নিজ্জার হত্যায় ভারতীয় এজেন্টদের জড়িত থাকার বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ কানাডার কাছে রয়েছে- এই কথা ট্রুডো বলার পর থেকে দিল্লি ও অটোয়ার মধ্যে সম্পর্কের টানাপড়েন চলছে।
এ নিয়ে হইচইয়ের মধ্যে কানাডাকে কয়েক ডজন কূটনৈতিককে প্রত্যাহার করতে এবং ভিসা পরিষেবা স্থগিত করতে বলেছে ভারত।
সোমবার ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক বিবৃতিতে বলা হয়, কানাডার অভিযোগ শিখ বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনকারীদের মাধ্যমে প্রভাবিত।
কানাডার ভারপ্রাপ্ত হাই কমিশনার স্টুয়ার্ট রস হুইলারসহ ছয় কূটনীতিককে ১৯ অক্টোবরের মধ্যে ভারত ছাড়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
কানাডার পদক্ষেপের ব্যাখ্যা দিতে হুইলারকে তলব করেছিল ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
ওই বৈঠকের পর হুইলার সাংবাদিকদের বলেন, ভারতের চাওয়া অনুযায়ী প্রমাণ দিয়েছে কানাডা, এখন অভিযোগের তদন্ত করা দরকার।
“আমাদের দেশ এবং আমাদের দেশের জনগণ উভয়ের স্বার্থেই এর মূলে যাওয়া প্রয়োজন।“
দিল্লির প্রতিক্রিয়ায় হাই কমিশনার সঞ্জয় কুমার ভার্মার ৩৬ বছরের বর্ণাঢ্য কর্মজীবনের কথা তুলে ধরা হয়েছে।
“কানাডা সরকার তার বিরুদ্ধে যে অভিযোগ তুলেছে, তা হাস্যকর এবং তার সঙ্গে অবমাননাকর আচরণ করা হচ্ছে।”
ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এও বলেছে, তারা তাদের শীর্ষ দূত ও অন্যান্য কূটনীতিকদের প্রত্যাহার করে নিচ্ছে।
“তাদের নিরাপত্তার প্রশ্নে কানাডার বর্তমান সরকারের ওপর আমাদের কোনো আস্থা নেই। তাই হাই কমিশনারও লক্ষ্যবস্তু হওয়া অন্যান্য কূটনীতিক ও কর্মকর্তাদের প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত নিয়েছে ভারত সরকার।”
সোমবারই কানাডীয় পুলিশ বলেছিল, “আমাদের দেশের জননিরাপত্তার জন্য উল্লেখযোগ্য হুমকি তৈরি হওয়ায় চলমান তদন্ত সম্পর্কে তথ্য প্রকাশে অস্বাভাবিক পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে।”
আরসিএমপি কমিশনার মাইক ডুহেমে সোমবার এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, প্রাণনাশের এক ডজনের বেশি বিশ্বাসযোগ্য ও আসন্ন হুমকি রয়েছে। খালিস্তানপন্থি আন্দোলনের সদস্যদের ওপর এ হুমকি রয়েছে বলে তার ভাষ্য।
পরোয়ানার প্রশ্নে ওই হুমকিগুলো ‘যথেষ্ট গুরুতর’ বলেও মন্তব্য করেন কমিশনার ডুহেমে।
“আমরা এমন একটা জায়গায় পৌঁছেছি- যেখানে আমাদের মনে হয়েছে, ভারত সরকারের মুখোমুখি হওয়া জরুরি।”
কানাডার কর্মকর্তারা বলেছেন, এক ডজন ভারতীয় এজেন্ট অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িত ছিল।
তবে তারা ২০২৩ সালের জুনে শিখ বিচ্ছিন্নতাবাদী নেতা নিজ্জার হত্যার সঙ্গে সরাসরি যুক্ত কি না তা নিশ্চিত করা হয়নি।
ব্রিটিশ কলম্বিয়ার সারে শহরে একটি শিখ মন্দিরের বাইরে দুই মুখোশধারী বন্দুকধারীর গুলিতে প্রাণ হারিয়েছিলেন হরদীপ সিং নিজ্জার। শিখদের পৃথক আবাসভূমির দাবিতে চলমান খালিস্তান আন্দোলনের সোচ্চার এই সমর্থক প্রকাশ্যে এ নিয়ে কথা বলতেন।
এ কারণে ভারত অতীতে তাকে একজন সন্ত্রাসী হিসাবে বর্ণনা করে বলেছিল, নিজ্জার বিচ্ছিন্নতাবাদী জঙ্গি গোষ্ঠীর নেতৃত্বে আছেন। এই অভিযোগকে ভিত্তিহীন বলে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছিল তার সমর্থকরা।
তার হত্যাকাণ্ডকে 'টার্গেটেড অ্যাটাক' বলে বর্ণনা করেছে কানাডা পুলিশ।
২০২৩ সালের সেপ্টেম্বরে ট্রুডো কানাডার পার্লামেন্টকে বলেছিলেন, কানাডার গোয়েন্দা সংস্থার তথ্যের ওপর ভিত্তি করে এই হত্যাকাণ্ডে ভারতের জড়িত থাকার অভিযোগ আনা হয়েছে।
কানাডার মাটিতে ওই হত্যাকাণ্ডকে ট্রুডো নিজের দেশের সার্বভৌমত্বের লঙ্ঘন বলে আখ্যা দিয়েছিলেন।
বিবিসি লিখেছে, গত বছরের অক্টোবরে ভারত ভিসা প্রসেসিং পুনরায় শুরু করার পরে দুই দেশের মধ্যে শীতল সম্পর্ক কিছুটা গলেছে বলে মনে করা হয়েছিল।
তবে গত সপ্তাহে কানাডার পররাষ্ট্রমন্ত্রী মেলানি জোলি তার দেশের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ককে ‘উত্তেজনাপূর্ণ' এবং ‘অত্যন্ত কঠিন' বলে বর্ণনা করেন।
তিনি এও বলেন, কানাডার মাটিতে নিজ্জারের মতো আরও হত্যাকাণ্ডের আশঙ্কা রয়েছে।
ভারতের ধর্মীয় সংখ্যালঘু শিখদের বাস মূলত পাঞ্জাব প্রদেশে, এর বাইরে বাইরে কানাডাতেই শিখ সম্প্রদায়ের সবচেয়ে বেশি মানুষ বাস করে।