Published : 01 May 2025, 12:04 AM
যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দীর্ঘ-প্রতিক্ষীত খনিজ চুক্তি সই করতে চলেছে ইউক্রেইন। বুধবারেই এই চুক্তি সইয়ের আশা করা হচ্ছে। কয়েকটি সূত্র কিইভ পোস্ট ও অন্যান্য পত্রিকাকে একথা জানিয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্র গত তিন বছরে রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধে ইউক্রেইনকে কোটি কোটি ডলার সামরিক সহায়তা দিয়েছে। সেই সহায়তার বিনিময় দাবি করেই যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্প ইউক্রেইনকে এই চুক্তি করার প্রস্তাব দিয়েছিলেন।
ট্রাম্প বলেছিলেন, “যুক্তরাষ্ট্র ইউক্রেইনকে ৩০ হাজার কোটি ডলার দিয়েছে। আমরা সেই অর্থ ফেরত চাই। আমরা বড় সমস্যায় থাকা একটি দেশকে সাহায্য করেছি...কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের করদাতারা এখন তাদের অর্থ ফেরত পেতে চায়।”
গত ফেব্রুয়ারিতে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে খনিজ সম্পদ নিয়ে একটি চুক্তির কাঠামো প্রস্তুত হওয়ার কথা জানিয়েছিলেন ইউক্রেইনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি।
ওই মাসেই দুষ্প্রাপ্য ধাতু, গুরুত্বপূর্ণ খনিজ, তেল-গ্যাসসসহ ইউক্রেইনের প্রাকৃতিক সম্পদ যৌথভাবে কাজে লাগাতে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে একটি চুক্তির শর্তেও কিইভ একমত হওয়ার কথা জানায়।
সেটি ছিল খসড়া চুক্তি। সেই চুক্তির বিস্তারিত খুঁটিনাটি চূড়ান্ত করে তা সই করার জন্য ইউক্রেইনের অর্থমন্ত্রী ইউলিয়া স্ভিরিদেঙ্কো বুধবার ওয়াশিংটন ডিসি যাওয়ার পথে রয়েছেন বলে জানিয়েছেন ইউক্রেইনের প্রধানমন্ত্রী ডেনিস শ্যামিহাল।
‘আগামী ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই চুক্তিটি সই হতে পারে’ বলে জানান তিনি। যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউক্রেইন দুপক্ষই চুক্তির মৌলিক বিষয়বস্তুগুলোতে একমত থাকায় এটি সই হতে সময় লাগবে না বলে মনে করা হচ্ছে।
ওদিকে, বার্তা সংস্থাকে রয়টার্সকে এক সূত্র বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র মূল খনিজ চুক্তির সঙ্গে ইউক্রেইনকে আরও দুটি ডকুমেন্ট সই করার জন্য চাপ দিতে পারে। যেগুলো সইয়ের জন্য কিইভ এখনও প্রস্তুত নয়।
তবে শেষ পর্যন্ত বাড়তি দুটি ডকুমেন্টও সই হয়ে যেতে পারে বলেও জানান ওই সূত্র।
যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে চুক্তিতে কী কী শর্ত:
খনিজ চুক্তির কাঠামোতে মোটাদাগে বলা হয়েছে, ইউক্রেইনের খনিতে থাকা দুষ্প্রাপ্য পদার্থ ও গুরুত্বপূর্ণ খনিজ, যেগুলো উচ্চতর প্রযুক্তির মূল উপাদান, এবং তেল-গ্যাস উত্তোলন ও বিক্রিতে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউক্রেইন যৌথভাবে কাজ করবে।
আরও বলা হয়েছে, ইউক্রেইনের সম্পদ থেকে প্রাপ্ত আয় সংগ্রহ ও পুনর্বিনিয়োগে দুই দেশ মিলে পুনর্গঠন বিনিয়োগ তহবিল বানানো হবে। তহবিলের ব্যবস্থাপনায় থাকবেন উভয় দেশের প্রতিনিধিরা।
ইউক্রেন তার রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন প্রাকৃতিক সম্পদ থেকে প্রাপ্ত আয়ের ৫০% এই তহবিলে দেবে। তহবিলের অর্থ ইউক্রেইনের ‘নিরাপত্তা, সুরক্ষা ও সমৃদ্ধির’ বিকাশে পুনর্বিনিয়োগ করা হবে।
যুক্তরাষ্ট্র ‘স্থিতিশীল ও অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধশালী ইউক্রেইন’ গড়ে তুলতে দীর্ঘমেয়াদী আর্থিক প্রতিশ্রুতি দেবে।
এই তহবিলের উদ্দেশ্য হচ্ছে ইউক্রেইনের নানা প্রকল্পে বিনিয়োগ করা এবং প্রাকৃতিক সম্পদ, অবকাঠামো, বন্দর ও রাষ্ট্রীয় মালিকানধীন নানান এন্টারপ্রাইজসহ সরকারি-বেসরকারি সম্পদে বিনিয়োগ আকৃষ্ট করা।
চুক্তিতে ইউক্রেইনে ‘দীর্ঘস্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠা এবং অর্থনৈতিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা শক্তিশালী’ করার কথাও বলা হয়েছে। দীর্ঘস্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠায় নিরাপত্তা নিশ্চয়তা পেতে ইউক্রেইনের চেষ্টায় সমর্থন দেবে মার্কিন সরকার, এমন কথা থাকলেও চুক্তিতে যুক্তরাষ্ট্র নিরাপত্তা নিশ্চয়তা দেবে এমন কিছুর উল্লেখ নেই।
ইউক্রেইনে কী কী খনিজ আছে:
লিথিয়াম আয়ন ব্যাটারির জন্য সবচেয়ে বেশি লাগে গ্রাফাইট; এটি পারমাণবিক চুল্লি থেকে শুরু করে পেন্সিল পর্যন্ত অসংখ্য জিনিসের অপরিহার্য উপাদান। বিশ্বের মোট গ্রাফাইটের ৬ শতাংশই ইউক্রেইনের কাছে আছে বলে জানাচ্ছে দেশটির ভূতাত্ত্বিক জরিপ সংস্থা।
দেশটিতে আনুমানিক ৫ লাখ মেট্রিক টন লিথিয়াম আছে বলেও ভাষ্য দেশটির ভূতাত্ত্বিক জরিপ সংস্থার, এটি বৈশ্বিক রিজার্ভের ১-২%।
এর পাশাপাশি ইউক্রেইনে আছে ইউরোপের সবচেয়ে বড় টাইটেনিয়াম রিজার্ভ, যা দিয়ে আগামী ২৫ বছর যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের চাহিদা পুরোপুরি মেটানো যাবে।
পারমাণবিক বিদ্যুৎ উৎপাদনের মূল তেজস্ক্রিয় উপাদান ইউরেনিয়ামের বৈশ্বিক রিজার্ভের ২ থেকে ৪ শতাংশ মিলতে পারে ইউক্রেইনের কাছে। এই ইউরেনিয়ামের ওপর বিশ্ব এখনও চীন ও রাশিয়ার ওপর অনেক বেশি নির্ভরশীল। রাশিয়া ইউক্রেইনে হামলা চালানোর পর পশ্চিমা দেশগুলো রাশিয়া থেকে জ্বালানি নেওয়া বন্ধ করলে কমিয়ে দিলে ইউরেনিয়ামের বৈশ্বিক বাজারে একটা বড় ধাক্কা লাগে।
ইনস্টিটিউট অব জিওলজির তথ্য অনুযায়ী, ইউক্রেইনের কাছে টেলিভিশন ও আলোজসজ্জার জন্য গুরুত্বপূর্ণ ল্যানথানাম ও সিরিয়াম, বায়ু বিদ্যুতের টারবাইন ও বৈদ্যুতিক গাড়ির ব্যাটারিতে ব্যবহৃত নিওডিমিয়াম এবং পারমাণবিক শক্তি থেকে শুরু করে লেজার পর্যন্ত নানান কিছুতে ব্যবহারে অপরিহার্য ইরবিয়াম ও ইট্রিয়াম আছে।
প্রাকৃতিক সম্পদের কতটা এখনও ইউক্রেইনের নিয়ন্ত্রণে:
২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে শুরু হওয়া যুদ্ধে ইউক্রেইনের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, রাশিয়া এখন দেশটির এক-পঞ্চমাংশ নিয়ন্ত্রণও করছে।
যুদ্ধের আগে ইউক্রেইনের ইস্পাত শিল্পের চালিকাশক্তি ছিল যে কয়লা, তার সিংহভাগই ছিল পূর্বাঞ্চলে। ওই এলাকা এখন রাশিয়ার নিয়ন্ত্রণে।
ইউক্রেইনের থিঙ্ক ট্যাঙ্ক উই বিল্ড ইউক্রেইন ও ন্যাশনল ইনস্টিটিউট অব স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিস ২০২৪ সালের প্রথমভাগের তথ্য উপাত্তের বরাতে ইউক্রেইনের প্রায় ৪০ শতাংশ ধাতু সম্পদ রাশিয়ার নিয়ন্ত্রণে চলে গেছে বলে ধারণা দিয়েছিল। তবে কোন কোন ধাতু, কতখানি মস্কোর সেনাদের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে তার বিস্তারিত বলেনি তারা।
২০২৪ সালের দ্বিতীয় ভাগ তো বটেই এখনও রুশ সেনারা ক্রমাগত একের পর এক ইউক্রেইনের শহর দখলে নিচ্ছে। মস্কোর বাহিনীর দখলে নেওয়ার চেষ্টার মধ্যে জানুয়ারিতে কিইভ তাদের একমাত্র কোক কয়লা খনি বন্ধ করে দিয়েছে, এই খনিটির অবস্থান ছিল পোকরোভস্ক শহরের বাইরে।
যুদ্ধের মধ্যে রাশিয়া অন্তত দুটি লিথিয়াম ভাণ্ডারেরও নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে, একটি দোনেৎস্কে, অন্যটি দক্ষিণপূর্বের জাপোরিঝিয়ায়। কিইভের হাতে এখনও মধ্যাঞ্চলীয় কিরিভোহরাদের লিথিয়াম খনিটি রয়েছে।