প্রায় ধ্বংসস্তূপে পরিণত হওয়া গাজার পুনর্গঠনে লাগবে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার, কত বছর যে লাগে তারও নেই ঠিক। কিন্তু এ নিয়ে বিস্তারিত কিছুই চুক্তিতে না থাকায় যুদ্ধপরবর্তী গাজার জন্য কী অপেক্ষা করছে তা অনিশ্চিত।
Published : 19 Jan 2025, 02:04 PM
মধ্যপ্রাচ্যকে উত্তাল করে রেখেছিল সোয়া এক বছরের যে রক্তক্ষয়ী সংঘাত তার অবসানে রোববার স্থানীয় সময় সকাল থেকে গাজায় শুরু হওয়ার কথা ছিল ইসরায়েল ও হামাসের মধ্যকার বহুল আকাঙ্ক্ষিত যুদ্ধবিরতি।
কিন্তু চুক্তির শর্ত অনুযায়ী হামাস কোন কোন জিম্মিকে মুক্তি দেবে তার তালিকা না দেওয়ায় যু্দ্ধবিরতি শুরুর সময় পিছিয়ে দিয়েছে তেল আবিব। এই জটিলতাই বলে দিচ্ছে দুই পক্ষের মধ্যে দূরত্ব যে কতখানি, যা গাজাবাসীর অপেক্ষার রাতকে হয়তো খানিকটা দীর্ঘায়িতই করবে।
চুক্তির ঘোষণা, এরপর তা অনুমোদনে ইসরায়েলের মন্ত্রিসভা ঘিরে অনেক নাটকীয়তার পর রোববার স্থানীয সময় সকাল সাড়ে ৮টা (বাংলাদেশ সময় দুপুর সাড়ে ১২টায়) থেকে গাজায় যুদ্ধবিরতি শুরু হওয়ার কথা ছিল; এরই ধারাবাহিকতায় এদিন বিকালেই তিন জিম্মিকে মুক্তি দেওয়ার কথা হামাসের, বিনিময়ে ইসরায়েলের কারাগার থেকে ছাড়া পাবে কয়েকশ ফিলিস্তিনিও।
সে লক্ষ্যে রোববার ভোরের আগেই ইসরায়েলি বাহিনী গাজার রাফাহ থেকে মিশর ও গাজার সীমান্তবর্তী ফিলাডেলফি করিডোরের দিকে সরতে শুরু করেছিল বলে হামাসপন্থি গণমাধ্যমের বরাত দিয়ে জানিয়েছে বার্তা সংস্থা রয়টার্স।
দুই পক্ষের মধ্যে যুদ্ধবিরতির চুক্তি করতে মিশর, কাতার ও যুক্তরাষ্ট্র মাসের পর মাস ধরে চেষ্টা চালিয়ে গেছে, শেষ পর্যন্ত ডনাল্ড ট্রাম্পের শপথ গ্রহণের আগে গলে বরফ।
চুক্তি অনুযায়ী, তিন ধাপে এই যুদ্ধবিরতি কার্যকর হওয়ার কথা।
প্রথম ধাপের সময়কাল ছয় সপ্তাহ। এই সময়ের মধ্যে হামাস তাদের হাতে থাকা ৯৮ জিম্মির ৩৩ জনকে মুক্তি দেবে। বিনিময়ে ইসরায়েল ছেড়ে দেবে তাদের হাতে আটক ও বন্দি থাকা প্রায় দুই হাজার ফিলিস্তিনিকে।
রোববার বিকালে রেডক্রসের মাধ্যমে হামাস তিন জিম্মিকে ছেড়ে দেওয়ার ৭দিন পর আরও ৪ নারী জিম্মিকে ছাড়বে বলে চুক্তির শর্ত জানিয়ে বলেছেন যুদ্ধবিরতির আলোচনায় যুক্তরাষ্ট্রকে নেতৃত্ব দেওয়া ব্রেট ম্যাকগার্ক। এরপর প্রতি ৭ দিন পরপর তিন জিম্মিকে ছাড়া হবে।
এই ধাপেই ইসরায়েলি সেনারা গাজার কিছু অংশ থেকে সরে যাবে আর উত্তর গাজার বাস্তুচ্যুত ফিলিস্তিনিরা তাদের বাড়ি ফেরার সুযোগ পাবে।
চুক্তি সম্পন্নে এখনও ক্ষমতাসীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের দল পরবর্তী প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের মধ্যপ্রাচ্য বিষক দূত স্টিভ উইটকফের সঙ্গে নিবিড়ভাবে কাজ করেছে।
অভিষেক যত ঘনিয়ে আসছিল ট্রাম্প ততই দ্রুত চুক্তি সম্পন্নে তাগাদা দিচ্ছিলেন; তাছাড়া ইসরায়েলি জিম্মিদের মুক্তি না দিলে হামাসকে যে ‘ভয়াবহ মূল্য চুকাতে’ হবে সে হুঁশিয়ারিও নিয়মিত দিয়ে গেছেন তিনি।
যুদ্ধপরবর্তী গাজা?
প্রায় ধ্বংসস্তূপে পরিণত হওয়া গাজার পুনর্গঠনে লাগবে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার, কত বছর যে লাগে তারও নেই ঠিক। কিন্তু এ নিয়ে বিস্তারিত কিছুই চুক্তিতে না থাকায় যুদ্ধপরবর্তী গাজার জন্য কী অপেক্ষা করছে তা অনিশ্চিত।
আর আদৌ এই যুদ্ধবিরতি কতদিন টেকে তা নিয়ে সন্দেহ তো আছেই।
দুই দশক ধরে ভূখণ্ডটির নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখা হামাস এ যুদ্ধে তাদের শীর্ষ নেতা ও কয়েক হাজার যোদ্ধা হারালেও ইসরায়েলি বাহিনী তাদের নিশ্চিহ্ন করতে পারেনি।
তেল আবিবের অঙ্গীকার ছিল, তারা হামাসকে আর গাজার ক্ষমতায় ফিরতে দেবে না, সেজন্য গাজাজুড়ে ব্যাপক তাণ্ডবও চালিয়েছে তারা।
২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর হামাসের হামলা ঠেকাতে ব্যর্থতা নেতানিয়াহু ও তার ডানপন্থি সরকারকে যে চাপে ফেলেছিল, জিম্মি মুক্তি তা খানিকটা শিথিল করলেও যুদ্ধে বিরতি নেতানিয়াহুর পতন আদৌ ঠেকাতে পারে কিনা তাও অস্পষ্ট।
এরই মধ্যে তার সরকারের কট্টরপন্থিরা হামাসের সঙ্গে যুদ্ধ না চালালে পদত্যাগের হুমকি দিয়ে বসে আছে।
একদিকে ওয়াশিংটন চাইছে দ্রুত যুদ্ধের অবসান, অন্যদিকে অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক মিত্ররা চাইছেন হামাসের বিলুপ্তি; দুইয়ের মাঝখানে বেশ বিপাকেই আছেন নেতানিয়াহু।
এদিকে যুদ্ধবিরতি যদি ভেস্তে যায় তাহলে অনেক জিম্মির আর বাড়ি ফেরা হবে না, সেটা আরও বড় চাপ হয়ে দাঁড়াতে পারে ইসরায়েলের এ ডানপন্থি রাজনীতিকের জন্য।
মধ্যপ্রাচ্যে ওলটপালট
ইসরায়েলের ভেতর চাপে থাকলেও মধ্যপ্রাচ্যের এই মুহূর্তের পরিস্থিতি নেতানিয়াহুর মুখে হাসি ফোটাতেই পারে।
যুদ্ধ শুরুর দেড় বছরের মাথায় অঞ্চলটিতে ইসরায়েলের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী ইরান দেখছে তার ‘প্রতিরোধের অক্ষ’ নুয়ে পড়েছে, দুই দফা ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েও তারা ইহুদি সংখ্যাগরিষ্ঠ রাষ্ট্রটির তেমন কোনো ক্ষতিই করতে পারেনি।
যে হিজবুল্লাহর ক্ষেপণাস্ত্র ভাণ্ডার ইসরায়েলের জন্য হুমকি ছিল, সেই হিজবুল্লাহও এখন চুপসে গেছে। তাদের শীর্ষ নেতারা মারা পড়েছে; বেশিরভাগ ক্ষেপণাস্ত্র ও সামরিক স্থাপনাও ধ্বংস হয়ে গেছে।
এই ধাক্কায় সিরিয়ায় আসাদ শাসনেরও অবসান ঘটেছে। যার ফলে ইরান মধ্যপ্রাচ্যে তার আরেক মিত্রকে হারিয়েছে, এই সুযোগে ইসরায়েলের সামরিক বাহিনী আবির্ভূত হয়েছে অপ্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে।
তবে কূটনৈতিক ফ্রন্টে তেল আবিব এখনো বেশ চাপেই আছে, বিশেষ করে গাজায় তারা যে ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছে, যে বিপুল পরিমাণ প্রাণহানি ঘটিয়েছে তা নিয়ে বিশ্বজুড়েই তারা প্রবল সমালোচনার মুখে আছে।
যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের গ্রেপ্তারি পরোয়ানা ঝুলছে নেতানিয়াহুর মাথায়, আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে আছে গণহত্যার অভিযোগ।
ইসরায়েল এই দুই আদালতে ওঠা অভিযোগগুলোকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত অ্যাখ্যা দিয়েছে। আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে অভিযোগ দায়ের করা দক্ষিণ আফ্রিকা ও তার সঙ্গে যুক্ত হওয়া দেশগুলোকে দিয়েছে ‘এন্টিসেমেটিক’ অভিধাও।
গাজার গণহত্যা নিয়ে পশ্চিমের অনেক দেশের সঙ্গে কূটনৈতিক টানা পোড়েনও চলছে তেল আবিবের।
নতুন দিনের প্রত্যাশা
যুদ্ধবিরতি শুরুর সময় পিছিয়ে গেলেও গাজার বিভিন্ন এলাকায় মানুষের মধ্যে উচ্ছ্বাসে ঘাটতি দেখা যাচ্ছে না। কেউ কেউ অবশ্য নানান আশঙ্কাও করছেন, তবে যুদ্ধবিরতি এখনই ভেস্তে যাবে এমন শঙ্কা বেশিরভাগই দেখছেন না।
আল জাজিরার এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, খান ইউনিসে আশ্রয় নেওয়া অনেকেই গাড়ি নিয়ে প্রস্তুত হয়ে আছেন। যুদ্ধবিরতি শুরু হলেই রওনা হবেন রাফায়, তাদের নিজ বাড়িতে।
অনেকেই সড়কে পড়ে থাকা ধ্বংসস্তূপ সরিয়ে নিচ্ছেন, অনেকেই রাস্তায় নেমে এসেছেন। চারদিকে আশার আমেজ।
তবে এর মধ্যেও ইসরায়েলের হামলা চলছে, তাতে হতাহতেরও খবর পাওয়া যাচ্ছে।
এদিকে হামাস জানিয়েছে, কারিগরি কারণে এখনও জিম্মিদের তালিকা প্রস্তুত করতে না পারলেও চুক্তি মেনে চলতে তারা দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।