“মানুষ আর কেন আর লড়াই করতে চাইবে? কেন মরতে চাইবে অপ্রতিরোধ্যকে প্রতিরোধ করার জন্য?”
Published : 13 Apr 2024, 08:02 PM
রাশিয়া ২০২৪ সালেই ইউক্রেইনকে যুদ্ধে হারিয়ে দিতে পারে বলে সতর্ক করেছেন ব্রিটিশ জয়েন্ট ফোর্সেস কমান্ডের সাবেক কমান্ডার জেনারেল স্যার রিচার্ড ব্যারনস।
বিবিসি-কে তিনি বলেন, এবছর যুদ্ধে ইউক্রেইনের হেরে যাওয়ার ‘মারাত্মক ঝুঁকি’ আছে। কারণ, তার মতে, ইউক্রেইন হয়ত মনে করা শুরু করতে পারে যে, তারা এ যুদ্ধে জিততে পারবে না।
“আর যখন এমন চিন্তা সেই পর্যায়ে পৌঁছায়, তখন মানুষ আর কেন আর লড়াই করতে চাইবে? কেন মরতে চাইবে অপ্রতিরোধ্যকে প্রতিরোধ করার জন্য?”
যদিও ইউক্রেইন এখনও সে পর্যায়ে পৌঁছায়নি। তবে তাদের বাহিনী যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার মতো গোলাবারুদ, সেনা ও আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার চরম ঘাটতিতে ভুগছে।
ইউক্রেনীয়দের বহুল প্রত্যাশিত পাল্টা আক্রমণ রুশ সেনাদের হটাতে ব্যর্থ হয়েছে এবং রাশিয়া এরই মধ্যে গ্রাষ্মকালীন আক্রমণের প্রস্তুতি শুরু করেছে।
সুতরাং কেমন হবে যুদ্ধ পরিস্থিতি? এর কৌশলগত লক্ষ্যই বা কী হতে পারে?
জেনারেল ব্যারনস বলেন, রাশিয়ার আসছে আক্রমণের স্বরূপ বেশ স্পষ্ট। আমরা রাশিয়াকে সম্মুখ সারিতে আক্রমণাত্মক হতে দেখছি। কামান, গোলাবারুদসহ নতুন অস্ত্রের ব্যবহার এবং লোকবল বৃদ্ধি কারণে তারা সুবিধাজনক অবস্থানে আছে।
তিনি বলেন, এই গ্রীষ্মের কোনও এক সময়ে আমরা রাশিয়ার বড় ধরনের আক্রমণ দেখতে পেতে পারি। সেই আক্রমণে রুশ সেনারা জোরাল হামলা চালিয়ে ছোট ছোট জয় পাওয়া নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার চাইতে বরং ইউক্রেইনের প্রতিরোধ ভেঙে দেওয়ার অভিপ্রায় নিয়ে এগুতে পারে।
আর যদি তেমনটি ঘটে, তবে রুশ বাহিনীর বাধা ভেঙে এগিয়ে যাওয়ার ঝুঁকি আছে। এরপর তারা এমন সব এলাকার দখল নিতে পারে যেখানে ইউক্রেইনের সশস্ত্র বাহিনী তাদের থামাতে পারবে না।
কোথায় হবে আক্রমণ?
গত বছর রাশিয়া জানত, ইউক্রেইন ঠিক কোথায় পাল্টা আক্রমণ করতে পারে- জাপোরিজিয়া থেকে দক্ষিণে আজভ সাগরের দিকে। তারা সে অনুযায়ী পরিকল্পনা করেছিল এবং সফলভাবে ইউক্রেইনের অগ্রযাত্রা ব্যর্থ করে দিয়েছিল।
কিন্তু এখন পরিস্থিতি সম্পূর্ণ উল্টোে। এবার রাশিয়া সেনা সমাবেশ করবে এবং তারা এরপর কোথায় আক্রমণ করবে সে সম্পর্কে কিইভকে ধন্দ্বে রাখবে।
হোয়াইট হল থিংকট্যাংক ‘দ্য রয়্যাল ইউনাইটেড সার্ভিসেস ইনস্টিটিউট’ (রুসি) এর স্থলযুদ্ধ বিষয়ক ঊর্ধ্বতন রিসার্চ ফেলো ড. জ্যাক ওয়াটলিং বলেন, “ইউক্রেনীয়দের জন্য চ্যালেঞ্জ হল, রাশিয়া তাদের বাহিনী কোথায় মোতায়েন করবে তা ঠিক করে নিতে পারে।”
ফ্রন্টলাইন খুবই দীর্ঘ এবং ইউক্রেনীয়দেরকে এর পুরোটাই রক্ষায় সক্ষম হতে হবে। সেটি তাদের নিশ্চয়ই পারার কথা নয়। ফলে, ইউক্রেইনের সামরিক বাহিনী অবস্থান হারাবে। প্রশ্ন হল, কতটা? আর কোন অঞ্চলের জনসংখ্যা এতে আক্রান্ত হবে?
তার মতে, এটি ঠিক যে, রাশিয়ার জেনারেল স্টাফরা তাদের হামলার লক্ষ্যবস্তু হিসেবে এখনও কোন জায়গা চূড়ান্ত করতে পারেননি। আপাতত: তিনটি বড় লক্ষ্যবস্তু চিহ্নিত করা যায়, যেখানে রাশিয়া আক্রমণ শানাতে পারে। সেগুলো হল: খারকিভ,ডনবাস এবং জাপোরিজিয়া।
খারকিভ:
ওয়াটলিং বলেছেন, “খারকিভ নিশ্চিতভাবেই অরক্ষিত।”
রুশ সীমান্তের কাছে বিপজ্জনকভাবে অবস্থিত ইউক্রেইনের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর খারকিভ মস্কোর জন্য একটি লোভনীয় লক্ষ্য। শহরটিতে বর্তমানে প্রতিদিনই রুশ ক্ষেপণাস্ত্র হামলা হচ্ছে। সেগুলো প্রতিরোধের জন্য পর্যাপ্ত আকাশ প্রতিরক্ষার ব্যবস্থা করতে পারেনি ইউক্রেইন।
ব্রিটিশ জয়েন্ট ফোর্সেস কমান্ডের সাবেক কমান্ডার জেনারেল রিচার্ড ব্যারনস বলেন, “আমি মনে করি প্রথম লক্ষ্য হিসাবে এবছর রাশিয়া আক্রমণ শানাবে ডনবাসে এবংতাদের চোখ থাকবে খারকিভের ওপর। রাশিয়ার সীমান্ত থেকে যার দূরত্ব ২৯ কিলোমিটারের মতো।”
খারকিভের পতন হলেও কি ইউক্রেইন কার্যকর সত্তা হিসাবে টিকে থাকতে পারবে? জবাব হচ্ছে, হ্যাঁ। কিন্তু খারকিভের পতন ইউক্রেইনের সেনাদের মনোবল এবং দেশটির অর্থনীতির জন্যও বড় ধাক্কা হবে।
ডনবাস:
পূর্ব ইউক্রেইনের এ অঞ্চলটিতে ২০১৪ সাল থেকেই যুদ্ধ চলছে। মস্কো-সমর্থিত বিচ্ছিন্নতাবাদীরা এ অঞ্চলকে নিজেদের ‘পিপলস রিপাবলিক’ ঘোষণা করেছে।
২০২২ সালে রাশিয়া ডনবাসের লুহান্সক ও দোনেৎস্ককে অবৈধভাবে নিজ ভূখণ্ডের সঙ্গে যুক্ত করে নেয়। গত ১৮ মাস ধরে সেখানে বেশিরভাগ স্থলযুদ্ধ হয়ে আসছে।
প্রথমে এ অঞ্চলের বাখমুত এবং পরে আভদিভকা শহর ধরে রাখার অনেক চেষ্টা করেছিল ইউক্রেইন। কিন্তু তারা দুটো শহরই খুইয়েছে। এসময় নিজেদের কিছু সেরা সেনাও হারিয়েছে ইউক্রেইন।
ইউক্রেইনের দাবি, তাদের প্রতিরোধ লড়াইয়ের মুখে রাশিয়ার পক্ষে প্রচুর সেনা হতাহতের ঘটনা ঘটছে। তাদের কথা সত্য। কিন্তু রাশিয়ার আরও প্রচুর সেনা আছে, যাদেরকে তারা যুদ্ধে পাঠাতে পারে। কিন্তু ইউক্রেইনের এত সেনা নেই।
ইউরোপে যুক্তরাষ্ট্রের বাহিনীর কমান্ডার জেনারেল ক্রিস্টোফার কাভোলি সতর্ক করে বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র দ্রুতই ইউক্রেইনে আরও বেশি অস্ত্র ও গোলাবারুদ দেওয়ার ব্যবস্থা না করলে ইউক্রেইনীয় বাহিনী যুদ্ধক্ষেত্রে আরও বেশি মার খাবে।
জাপোরিজিয়া:
এ শহরও মস্কোর জন্য একটি লোভনীয় পুরস্কারস্বরূপ। দক্ষিণাঞ্চলীয় এই ইউক্রেনীয় শহর রাশিয়ার ফ্রন্টলাইনের খুব কাছাকাছি অবস্থিত।
রাশিয়ার দিক থেকে এ শহরটি এখনও কন্টকাকীর্ণ। কারণ, শহরটিতে পারমাণবিক স্থাপনায় হামলা নিয়ে রাশিয়া-ইউক্রেইন দুপক্ষেই পাল্টাপাল্টি দোষারোপ চলছে।
তছাড়া, পারমাণবিক কেন্দ্রটি রাশিয়া পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে থাকলেও সেটি পরিচালনার কাজে রুশদের পাশাপাশি কিছু ইউক্রেইনীয় কর্মীও নিয়োজিত আছে।
ওদিকে, গতবছর ইউক্রেইনের হামলার আশঙ্কায় জাপোরিজিয়ার দক্ষিণে রাশিয়া যে শক্তিশালী প্রতিরক্ষা গড়েছে, সেখান থেকে লড়াইয়ে অগ্রসর হওয়াও এখন রাশিয়ার জন্য কঠিন হবে।
তবে এবছরের যুদ্ধে রাশিয়ার কৌশলগত লক্ষ্য যে কেবল ভূখন্ড দখল করা তা নাও হতে পারে; বরং ইউক্রেইনের লড়াইয়ের মনোবল ভেঙে দেওয়া এবং ইউক্রেইনের যুদ্ধ ব্যর্থ হবে- একথা দেশটির পশ্চিমা সমর্থকদের বুঝিয়ে দেওয়াটাই রাশিয়ার লক্ষ্য হতে পারে।
‘দ্য রয়্যাল ইউনাইটেড সার্ভিসেস ইনস্টিটিউট’ (রুসি) এর স্থলযুদ্ধ বিষয়ক ঊর্ধ্বতন রিসার্চ ফেলো জ্যাক ওয়াটলিংয়ের বিশ্বাস, ইউক্রেইনের যুদ্ধ নিয়ে রাশিয়া হতাশার একটি আবহই তৈরি করতে চাইছে।
তবে রাশিয়ার আক্রমণই যে চূড়ান্তভাবে সংঘাতের অবসান ঘটাবে তা নয়। সেটি অন্যপক্ষে যা-ই ঘটিয়ে থাকুক না কেন।
ওয়াটলিং মনে করেন, যুদ্ধের পরিণতি যা হতে পারে তা হচ্ছে, রাশিয়া অগ্রগতি অর্জন করবে, কিন্তু বিরাট কোনও সাফল্য পাবে না। নিপ্রো নদীর পুরো অববাহিকা জুড়ে শক্তি প্রয়োগ করার মতো বিশাল এবং দক্ষ বাহিনী তারা পাবে না। কিন্তু তারপরও যুদ্ধ পরিস্থিতি রাশিয়ার অনুকূলেই যাবে।
একটি বিষয় নিশ্চিত যে, রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের ইউক্রেইনে আক্রমণে ক্ষ্যান্ত দেওয়ার কোনও ইচ্ছা নেই। তিনি একজন জুয়াড়ির মতোই খেলে যাবেন।
তার রণকৌশল হচ্ছে, যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া যতক্ষণ না ইউক্রেইন সমর্থন হারায়; আর পশ্চিমারা ইউক্রেইনের সুরক্ষায় আরও সহায়তা দিতে ব্যর্থ না হয়।
ইউক্রেইনকে সহায়তা করা নিয়ে সব নেটো বৈঠক, সব সম্মেলন এমনকী সব উদ্দীপ্ত ভাষণের পরও পুতিনই সঠিক হওয়ার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। কারণ, সহায়তা পাওয়ার দিক থেকে ইউক্রেইনের জন্য এবছর যে খুব আশাব্যাঞ্জক না- তেমন আভাস পাওয়া গেছে গতবছরই।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট বাইডেনের ইউক্রেইনকে আরও সাহায্য দেওয়ার আবেদন কংগ্রেসের রিপাবলিকানরা নিজেদের দেশের সীমান্ত সুরক্ষার শর্তে গতবছর আটকে দিয়েছিল। আবার ইউরোপীয় ইউনিয়নেরও ইউক্রেইনকে একাধিক বছরের আর্থিক সাহায্য দেওয়ার সিদ্ধান্ত পিছিয়ে গিয়েছিল।
সূত্র: বিবিসি।