ফাঁস হওয়া চ্যাটে কোনো নাম বা কোথায় হামলা হবে তা ছিল না, ছিল না এমন কোনো তথ্যও যার দরুন মার্কিন সেনারা পাল্টা নিশানায় পরিণত হতে পারতেন। কেবল ছিল নিশানায় থাকা হুতি নেতার অবস্থান, কী কী দিয়ে হামলা হতে যাচ্ছে সেসব।
Published : 27 Mar 2025, 12:48 PM
ইরানসমর্থিত ইয়েমেনের হুতিদের ওপর গোপনীয়তার চাদরে ঢেকে রাখা এক অভিযান শুরুর দুই ঘণ্টা আগেই মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রী পিট হেগসেথ সশস্ত্র গোষ্ঠীটির গুরুত্বপূর্ণ এক নেতাকে হত্যা পরিকল্পনার তথ্য জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা মাইক ওয়াল্টজের খোলা সিগনালের গ্রুপে জানিয়ে দিয়েছিলেন।
বুধবার মার্কিন ম্যাগাজিন দ্য আটলান্টিক ওই চ্যাটের স্ক্রিনশট প্রকাশ করেছে। ওয়াল্টজ ‘ভুল করে’ ওই গ্রুপে আটলান্টিকের প্রধান সম্পাদক জেফরি গোল্ডবার্গকে যুক্ত করে নিয়েছিলেন, যার সূত্রে এ সাংবাদিকের কাছে জাতীয় নিরাপত্তার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট মার্কিন শীর্ষ কর্তাদের আলাপ ফাঁস হয়ে যায়।
একটি বাণিজ্যিক ম্যাসেজিং অ্যাপে, যেখানে সম্ভবত সবাই নিজ নিজ ব্যক্তিগত ফোনের সাহায্যে আলাপচারিতা সারতেন, সেখানে এভাবে হামলা সংক্রান্ত অতি গুরুত্বপূর্ণ পরিকল্পনা শেয়ার হওয়ায় ওয়াশিংটনের রাজনৈতিক মহলে তুমুল শোরগোল চলছে; এ ফাঁসের ঘটনার জেরে ডেমোক্র্যাটরা প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্পের জাতীয় নিরাপত্তা দলের সদস্যদের বরখাস্ত করারও দাবি তুলছেন, জানিয়েছে বার্তা সংস্থা রয়টার্স।
এনক্রিপ্টেড মেসেজিং অ্যাপ সিগনালে হওয়া ১৫ মার্চের চ্যাট যে গোল্ডবার্গও দেখেছে তা প্রকাশের পর হওয়া তীব্র প্রতিক্রিয়া নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করছে রিপাবলিকান প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রশাসন।
হেগসেথ বারবার বলছেন, তিনি যুদ্ধ পরিকল্পনা শেয়ার করেননি। গ্রুপ আলাপচারিতায় কোনো শ্রেণিবদ্ধ গোপন আলোচনা শেয়ার হয়নি বলে দাবি করছেন ট্রাম্প ও তার অন্য উপদেষ্টারাও।
যদিও এসব মানতে নারাজ ডেমোক্র্যাট আর সাবেক মার্কিন কর্মকর্তারা। তাদের হিসাবে, মার্কিন অভিযানের আগে যেসব তথ্য খুবই গোপনীয়তার সঙ্গে সংরক্ষিত রাখা হয়, তার মধ্যে সময়সীমা এবং কোথায়, কাকে নিশানা করা হচ্ছে তার বিস্তারিতও অন্তর্ভুক্ত।
“আমার মনে হচ্ছে, এটা ঈশ্বরের অসীম কৃপা যে আমরা এখন মৃত পাইলটদের জন্য শোক করছি না,” প্রতিনিধি পরিষদের গোয়েন্দা সংক্রান্ত কমিটির শুনানিতে এমনটাই বলেছেন কানেটিকাটের ডেমোক্র্যাট প্রতিনিধি জিম হাইমস।
সেনেটের পেন্টাগন তদারকি কমিটির প্রধান রিপাবলিকান রজার উইকারও চ্যাট ফাঁসের ঘটনার স্বতন্ত্র তদন্তের পক্ষে অবস্থান নিয়ে বলেছেন, যেসব কথাবার্তা দেখা যাচ্ছে তা এতই সংবেদনশীল যে, ‘আমি হলে সেগুলো গোপনই রাখতাম’।
যদি হুতি নেতারা জানতেন তাদের ওপর শিগগিরই হামলা হতে যাচ্ছে, তাহলে তারা পালিয়ে জনবহুল এমন কোনো স্থানে অবস্থান নিতে পারতেন যেখানে হামলা চালানো কঠিন হয়ে যেত এবং বেশি বেসামরিক হতাহত হওয়ার সম্ভাবনা দেখে শেষ মুহূর্তে হামলা বাতিল করতে হতো।
ফাঁস হওয়া চ্যাটে কোনো নাম বা কোথায় হামলা হবে তা ছিল না বলেই মনে হচ্ছে, প্রকাশিত হয়নি এমন কোনো তথ্যও যার দরুন অভিযানের দায়িত্বে থাকা মার্কিন সেনারা পাল্টা নিশানায় পরিণত হতে পারতেন। তবে ছিল নিশানায় থাকা হুতি নেতার অবস্থান এবং কী কী দিয়ে হামলা হচ্ছে সে সংক্রান্ত তথ্য।
অভিযানের পরিকল্পনা সম্বন্ধে অবগত পেন্টাগনের কর্মকর্তারা হেগসেথ যে সময়ে গ্রুপে ওই টেক্সট শেয়ার করেছেন তখন সেটি ‘গোপনীয়’ ছিল বলেই মনে করছেন, নাম প্রকাশ না করার শর্তে রয়টার্সকে এমনটাই বলেছেন এক মার্কিন কর্মকর্তারা।
তাই যদি হয়, তাহলে হেগসেথ কখন, কীভাবে ওই ‘গোপনীয়’ তথ্য ‘প্রকাশযোগ্য’ এমন শ্রেণিতে রূপান্তর করলেন, কিংবা আদৌ করেছেন কিনা তা নিয়েও প্রশ্ন উঠছে।
তবে এই ঘটনায় হেগসেথ বা জাতীয় নিরাপত্তা সংশ্লিষ্ট কারও চাকরি যাওয়ার সম্ভাবনা উড়িয়ে দিয়েছে হোয়াইট হাউজ। সবার ওপরই প্রেসিডেন্টের আস্থা বিদ্যমান, বলেছে তারা।
ট্রাম্প সিগনালে চ্যাটের তথ্য সামনে আসাকে ‘ফাঁস’ মানতেও নারাজ। তার মতে, এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে যা চলছে তা মূলত ‘উইচ হান্ট’।
তিনি প্রতিরক্ষামন্ত্রীর প্রশংসা করে বলেছেন, “হেগসেথ চমৎকার কাজ করছেন।”
গোল্ডবার্গ প্রথম দিকে চ্যাটের বিস্তারিত প্রকাশে রাজি হননি, অবশ্য বুধবার তিনি ওই অবস্থান থেকে সরে আসেন।
আরও বার্তা প্রকাশের বিষয়ে রয়টার্স আটলান্টিক ম্যাগাজিনের মন্তব্য চাইলেও তাৎক্ষণিকভাবে তাদের দিক থেকে সাড়া পাওয়া যায়নি।
আটলান্টিকের প্রকাশিত স্ক্রিনশটগুলোতে দেখা গেছে, সিগনালের ওই গ্রুপে হেগসেথ ‘টিম আপডেট’ শিরোনামে বার্তা পাঠানো শুরু করেন।
“টাইম নাও (১১৪৪ইটি): ওয়েদার ইজ ফেভারেবল. জাস্ট কনফার্মড ডব্লিউ/সেন্টকম উই আরও এ গো ফর মিশন লঞ্চ”
“১২১৫ইটি: এফ-১৮স লঞ্চ (ফার্স্ট স্ট্রাইক প্যাকেজ)”
“১৩৪৫:‘ট্রিগ্রার বেইজড’ এফ-১৮ ফার্স্ট স্ট্রাইক উইনডো স্টার্টস (টার্গেট টেরোরিস্ট ইজ হিজ নৌন লোকেশন সো শুড বি অন টাইম – অলসো, স্ট্রাইক ড্রোনস লঞ্চ (এমকিউ-৯স)”
“১৪১০: মোর এফ-১৮স লঞ্চ (সেকেন্ড স্ট্রাইক প্যাকেজ)”
“১৪১৫: স্ট্রাইক ড্রোনস অন টার্গেট (দিজ ইজ হোয়েন ট্য ফার্স্ট বম্বস উইল ডেফিনিটলি ড্রপ, পেন্ডিং আর্লিয়ার ‘টিগ্রার বেইজড’ টার্গেটস)
“১৫৩৬ এফ-১৮ সেকেন্ড স্ট্রাইক স্টার্টস – অলসো, ফার্স্ট সি-বেইজড টমাহক লঞ্চড।”
“মোর টু ফলো (পার টাইমলাইন)”
“উই আর কারেন্টলি ক্লিন অন ওপিএসইসি”
“গডস্পিড টু আওয়ার ওয়ারিওর্স।”
এই চ্যাটের কয়েকঘণ্টা পর জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা মাইক ওয়াল্টজ হুতি গোষ্ঠীর শীর্ষ ক্ষেপণাস্ত্র বিশেষজ্ঞকে হত্যার কথা নিশ্চিত করেন।
“তিনি যে বান্ধবীর ভবনে ঢুকেছিলেন সে বিষয়ে আমরা নিশ্চিত হতে পেরেছিলাম, এখন ওই ভবনটি পুরোপুরি ধসিয়ে ফেলা হয়েছে,” যুক্তরাষ্ট্র যে হুতি নেতাদের বিরুদ্ধে নজরদারি অভিযান চালাচ্ছে, তা জানিয়ে বলেন ওয়াল্টজ।
মার্কিন সামরিক বাহিনীর হামলায় কী ধরনের ভবন ধসে পড়েছে, ভবনটির ভেতরে কতজন ছিল, কোনো বেসামরিক হতাহতের ঘটনা ঘটেনি বলে পেন্টাগন যে বিবৃতি দিয়েছে, তা ঠিক কিনা তাৎক্ষণিকভাবে তা নিশ্চিত হতে পারেনি রয়টার্স।
বুধবার হাওয়াইতে হেগসেথ তাকে নিয়ে ওঠার বিতর্ককে একপ্রকার উড়িয়েই দিয়েছেন। সাংবাদিকদের বলেছেন, “তিনি যা লিখেছিলেন তাতে কোনো স্থানের নাম ছিল না, কোন পথে হামলা হবে, বিমান কোন পথে যাবে, কোনো সূত্র, কোনো প্রক্রিয়া কিছুরই উল্লেখ ছিল না।”
জ্যামাইকায় থাকা মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও সিগনালের চ্যাট গ্রুপে এক সাংবাদিককে যুক্ত করে ‘কেউ একজন বড় ভুল করেছে’ বলে স্বীকার করে নিলেও হেগসেথের শেয়ার করা বার্তা অভিযানে প্রভাব ফেলেছে কিনা এমন উদ্বেগ খারিজ করে দিয়েছেন।
যুক্তরাষ্ট্রের শীর্ষ কর্মকর্তারা কীভাবে, কোথায় কোনো গোপনীয় কথা বলবেন, বা আদৌ বলতে পারেন কিনা, তার নানারকম নির্দেশিকা রয়েছে। সিগনালের গ্রুপে হেগসেথের শেয়ার করা তথ্যে সেসব নির্দেশিকার কোনোটি লঙ্ঘিত হয়েছে কিনা, তা স্পষ্ট হওয়া যায়নি।
জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা মাইক ওয়াল্টজ চ্যাটের আলাপ ‘ফাঁস’ হওয়ার সম্পূর্ণ দায় নিজের কাঁধে নিলেও এই ঘটনায় কোনো ধরনের ক্ষয়ক্ষতি হয়নি বলে দাবি করেছেন।
“কোনো স্থানের কথা বলা হয়নি, কোনো উৎস বা প্রক্রিয়ার কথাও ছিল না। ছিল না কোনো যুদ্ধ পরিকল্পনা। শিগগির যে হামলা হবে তা বিদেশি অংশীদারদের আগেই জানানো হয়েছিল,” বুধবার সোশাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্ম এক্সে এমনটাই লিখেছেন তিনি।
একইদিন এক শুনানিতে মার্কিন জাতীয় গোয়েন্দা সংস্থার পরিচালক তুলসী গ্যাবার্ড বলেছেন, প্রতিরক্ষা সংক্রান্ত কোন কোন তথ্য গোপনীয় বলে বিবেচিত হবে তা ‘নির্ধারণের এখতিয়ার প্রতিরক্ষামন্ত্রী হেগসেথেরই’।
ইয়েমেনে অভিযান নিয়ে মার্কিন সামরিক বাহিনী এখন পর্যন্ত তেমন কিছুই জানায়নি। ইরানসমর্থিত গোষ্ঠীটির ওপর কতগুলো হামলা হয়েছে, হামলায় কোনো শীর্ষ নেতাকে নিশানা বা তাকে হত্যা করা হয়েছে কিনা, তা তো বাদই অভিযানের কোনো নাম আছে কিনা, তাও জানায়নি তারা।