কাঠামোগত এ চুক্তি স্বাক্ষরে ইউক্রেইনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি শুক্রবার হোয়াইট হাউজ যাচ্ছেন, জানিয়েছেন ডনাল্ড ট্রাম্প।
Published : 27 Feb 2025, 04:49 PM
দুষ্প্রাপ্য ধাতু, গুরুত্বপূর্ণ খনিজ, তেল-গ্যাসসসহ ইউক্রেইনের প্রাকৃতিক সম্পদ যৌথভাবে কাজে লাগাতে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে একটি চুক্তির শর্তে একমত হওয়ার কথা জানিয়েছে কিইভ।
কাঠামোগত এ চুক্তি স্বাক্ষরে ইউক্রেইনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি শুক্রবার হোয়াইট হাউজ যাচ্ছেন, জানিয়েছেন ডনাল্ড ট্রাম্প।
ক্ষমতায় বসার পর থেকেই মার্কিন এ প্রেসিডেন্ট যেভাবে রাশিয়ার দিকে ঝুঁকছিলেন, তাতে আতঙ্কিত হয়ে পড়া ইউক্রেইন এই চুক্তির মাধ্যমে ওয়াশিংটনকে আগের পথে ধরে রাখার চেষ্টা করছে।
চুক্তি হলে ইউক্রেইনকে তাদের খনিজ সম্পদ থেকে আয়ের কিছু অংশ যুক্তরাষ্ট্রকে দিতে হবে, অবশ্য এর বিনিময়েও তারা আটলান্টিকের ওপারের মিত্র দেশটির কাছ থেকে নিরাপত্তা সহায়তা পাবে না, জানিয়েছে বার্তা সংস্থা রয়টার্স।
ভবিষ্যতে রাশিয়ার যে কোনো আগ্রাসন প্রতিহতে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা মিত্রদের কাছ থেকে নিরাপত্তা নিশ্চয়তার প্রতিশ্রুতি আদায়ে জেলেনস্কি এখন মরিয়া। ওয়াশিংটন এখন পর্যন্ত তার এ চাপের কাছে নত হয়নি, তবে ইউরোপের কয়েকটি দেশ ইউক্রেইনে বিদেশি সেনা পাঠানোর বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করছে।
ইউরোপীয় ইউনিয়ন যে ৩৪টি খনিজকে ‘গুরুত্বপূর্ণ’ বিবেচনা করে তার ২২টিই ইউক্রেইনে আছে বলে দেশটির অর্থ মন্ত্রণালয়ের দেওয়া তথ্য বলছে। এসবের মধ্যে শিল্প ও নির্মাণখাতে ব্যবহৃত উপাদান, ফেরোঅ্যালয়, মূল্যবান ও লৌহজাত নয় এমন ধাতু এবং দুষ্প্রাপ্য অনেক মৌল রয়েছে।
কিইভ বলছে, তাদের অব্যবহৃত খনিজ সম্পদের পরিমাণ কয়েক ট্রিলিয়ন ডলার। যদিও এই খাতের বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যুদ্ধ এবং দীর্ঘদিন অপ্রতুল বিনিয়োগের কারণে ঝুঁকিপূর্ণ একটি খাত থেকে বিনিয়োগকারীদের বলার মতো মুনাফা পেতে বছরের পর বছরও লেগে যেতে পারে।
ইউক্রেইনে কী কী খনিজ আছে
লিথিয়াম আয়ন ব্যাটারির জন্য সবচেয়ে বেশি লাগে গ্রাফাইট; এটি পারমাণবিক চুল্লি থেকে শুরু করে পেন্সিল পর্যন্ত অসংখ্য জিনিসের অপরিহার্য উপাদান। বিশ্বের মোট গ্রাফাইটের ৬ শতাংশই ইউক্রেইনের কাছে আছে বলে জানাচ্ছে দেশটির ভূতাত্ত্বিক জরিপ সংস্থা।
দেশটিতে আনুমানিক ৫ লাখ মেট্রিক টন লিথিয়াম আছে বলেও ভাষ্য দেশটির ভূতাত্ত্বিক জরিপ সংস্থার, এটি বৈশ্বিক রিজার্ভের ১-২%।
এর পাশাপাশি ইউক্রেইনে আছে ইউরোপের সবচেয়ে বড় টাইটেনিয়াম রিজার্ভ, যা দিয়ে আগামী ২৫ বছর যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের চাহিদা পুরোপুরি মেটানো যাবে।
পারমাণবিক বিদ্যুৎ উৎপাদনের মূল তেজস্ক্রিয় উপাদান ইউরেনিয়ামের বৈশ্বিক রিজার্ভের ২ থেকে ৪ শতাংশ মিলতে পারে ইউক্রেইনের কাছে। এই ইউরেনিয়ামের ওপর বিশ্ব এখনও চীন ও রাশিয়ার ওপর অনেক বেশি নির্ভরশীল। রাশিয়া ইউক্রেইনে হামলা চালানোর পর পশ্চিমা দেশগুলো রাশিয়া থেকে জ্বালানি নেওয়া বন্ধ করলে কমিয়ে দিলে ইউরেনিয়ামের বৈশ্বিক বাজারে একটা বড় ধাক্কা লাগে।
ইনস্টিটিউট অব জিওলজির তথ্য অনুযায়ী, ইউক্রেইনের কাছে টেলিভিশন ও আলোজসজ্জার জন্য গুরুত্বপূর্ণ ল্যানথানাম ও সিরিয়াম, বায়ু বিদ্যুতের টারবাইন ও বৈদ্যুতিক গাড়ির ব্যাটারিতে ব্যবহৃত নিওডিমিয়াম এবং পারমাণবিক শক্তি থেকে শুরু করে লেজার পর্যন্ত নানান কিছুতে ব্যবহারে অপরিহার্য ইরবিয়াম ও ইট্রিয়াম আছে।
প্রাকৃতিক সম্পদের কতটা এখনো ইউক্রেইনের নিয়ন্ত্রণে
২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে শুরু হওয়া যুদ্ধে ইউক্রেইনের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, রাশিয়া এখন দেশটির এক-পঞ্চমাংশ নিয়ন্ত্রণও করছে।
যুদ্ধের আগে ইউক্রেইনের ইস্পাত শিল্পের চালিকাশক্তি ছিল যে কয়লা, তার সিংহভাগই ছিল পূর্বাঞ্চলে। ওই এলাকা এখন রাশিয়ার নিয়ন্ত্রণে।
ইউক্রেইনের থিঙ্ক ট্যাঙ্ক উই বিল্ড ইউক্রেইন ও ন্যাশনল ইনস্টিটিউট অব স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিস ২০২৪ সালের প্রথমভাগের তথ্য উপাত্তের বরাতে ইউক্রেইনের প্রায় ৪০ শতাংশ ধাতু সম্পদ রাশিয়ার নিয়ন্ত্রণে চলে গেছে বলে ধারণা দিয়েছিল। তবে কোন কোন ধাতু, কতখানি মস্কোর সেনাদের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে তার বিস্তারিত বলেনি তারা।
২০২৪ সালের দ্বিতীয় ভাগ তো বটেই এখনও রুশ সেনারা ক্রমাগত একের পর এক ইউক্রেইনের শহর দখলে নিচ্ছে। মস্কোর বাহিনীর দখলে নেওয়ার চেষ্টার মধ্যে জানুয়ারিতে কিইভ তাদের একমাত্র কোক কয়লা খনি বন্ধ করে দিয়েছে, এই খনিটির অবস্থান ছিল পোকরোভস্ক শহরের বাইরে।
যুদ্ধের মধ্যে রাশিয়া অন্তত দুটি লিথিয়াম ভাণ্ডারেরও নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে, একটি দোনেৎস্কে, অন্যটি দক্ষিণপূর্বের জাপোরিঝিয়ায়। কিইভের হাতে এখনও মধ্যাঞ্চলীয় কিরিভোহরাদের লিথিয়াম খনিটি রয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে চুক্তিতে কী কী শর্ত
শুক্রবার ইউক্রেইন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে যে খনিজ চুক্তি স্বাক্ষর করতে যাচ্ছে তার কাঠামোতে মোটাদাগে বলা হয়েছে, ইউক্রেইনের খনিতে থাকা দুষ্প্রাপ্য পদার্থ ও গুরুত্বপূর্ণ খনিজ, যেগুলো উচ্চতর প্রযুক্তির মূল উপাদান, এবং তেল-গ্যাস উত্তোলন ও বিক্রিতে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউক্রেইন যৌথভাবে কাজ করবে।
আরও বলা হয়েছে, ইউক্রেইনের সম্পদ থেকে প্রাপ্ত আয় সংগ্রহ ও পুনর্বিনিয়োগে দুই দেশ মিলে পুনর্গঠন বিনিয়োগ তহবিল বানানো হবে। তহবিলের ব্যবস্থাপনায় থাকবেন উভয় দেশের প্রতিনিধিরা।
ইউক্রেন তার রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন প্রাকৃতিক সম্পদ থেকে প্রাপ্ত আয়ের ৫০% এই তহবিলে দেবে। তহবিলের অর্থ ইউক্রেইনের ‘নিরাপত্তা, সুরক্ষা ও সমৃদ্ধির’ বিকাশে পুনর্বিনিয়োগ করা হবে।
যুক্তরাষ্ট্র ‘স্থিতিশীল ও অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধশালী ইউক্রেইন’ গড়ে তুলতে দীর্ঘমেয়াদী আর্থিক প্রতিশ্রুতি দেবে।
এই তহবিলের উদ্দেশ্য হচ্ছে ইউক্রেইনের নানান প্রকল্পে বিনিয়োগ করা এবং প্রাকৃতিক সম্পদ, অবকাঠামো, বন্দর ও রাষ্ট্রীয় মালিকানধীন নানান এন্টারপ্রাইজসহ সরকারি-বেসরকারি সম্পদে বিনিয়োগ আকৃষ্ট করা।
চুক্তিতে ইউক্রেইনে ‘দীর্ঘস্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠা এবং অর্থনৈতিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা শক্তিশালী’ করার কথাও বলা হয়েছে। দীর্ঘস্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠায় নিরাপত্তা নিশ্চয়তা পেতে ইউক্রেইনের চেষ্টায় সমর্থন দেবে মার্কিন সরকার, এমন কথা থাকলেও চুক্তিতে যুক্তরাষ্ট্র নিরাপত্তা নিশ্চয়তা দেবে এমন কিছুর উল্লেখ নেই।
রয়টার্স এই চুক্তির খসড়া দেখেছে, যাতে বলা হয়েছে মার্কিন বাণিজ্যমন্ত্রী স্কট বেসেন্ট ও ইউক্রেইনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আন্দ্রি সিবিহা এই চুক্তিতে স্বাক্ষর করবেন।
যুক্তরাষ্ট্র কেন এ চুক্তি চায়
ইউক্রেইনকে খনিজ চুক্তির মাধ্যমে বেধে ফেলতে যুক্তরাষ্ট্র যে চাপ দিচ্ছে, তার অন্যতম প্রধান কারণ হচ্ছে চীন। বৈদ্যুতিক গাড়ি, অস্ত্রশস্ত্র, ইলেকট্রনিক্সের ভেতরে যে চুম্বক ব্যবহৃত হয় তা বানাতে যে দুষ্প্রাপ্য পদার্থ লাগে, এশিয়ার এ দেশটি তার সবচেয়ে বড় উৎপাদক।
যুক্তরাষ্ট্রই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় এই দুষ্প্রাপ্য ধাতুখাত সৃষ্টি করেছিল, মার্কিন সামরিক বিজ্ঞানীরা এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত দুষ্প্রাপ্য পদার্থের চুম্বকও বানিয়েছেন, কিন্তু গত তিন দশকে চীন ধীরে ধীরে এই পুরো খাত কব্জা করে নিয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্র এই দুষ্প্রাপ্য পদার্থগুলোর জন্য বেইজিংয়ের ওপর ভয়াবহ নির্ভরশীল, যা দীর্ঘদিন ধরে ওয়াশিংটনের মাথাব্যথারও কারণ। মার্কিন ভূতাত্ত্বিক জরিপ সংস্থার ২০২৫ সালের এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, যুক্তরাষ্ট্র যত দুষ্প্রাপ্য মৌল আমদানি করে, তার ৭০ শতাংশই আসে চীন থেকে।
যুক্তরাষ্ট্রের দুষ্প্রাপ্য ধাতুর খনি আছে একটা, দুষ্প্রাপ্য এ খনিজ প্রক্রিয়াজাত করার সক্ষমতাও তাদের নেই।