গুমের অভিযোগ অস্বীকার করে পাকিস্তান সরকার বলছে, নিখোঁজদের অনেকেই বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠীতে যোগ দিয়েছে অথবা দেশ ছেড়ে পালিয়েছে।
Published : 24 Mar 2025, 12:42 AM
সায়রা বালুচ যখন প্রথমবার মর্গে পা রাখেন, তখন তার বয়স ছিল সবে ১৫ বছর।
আবছা আলোর সেই ঘরে তিনি কেবল কান্নার শব্দ, গুন গুন করে প্রার্থনা আর পায়ের নাড়াচাড়া দেখছিলেন।
প্রথম যে মৃতদেহ দেখেছিলেন, সে নির্যাতনের শিকার বলে সায়রার মনে হয়েছিল। তার চোখ নেই, উপড়ে ফেলা হয়েছে দাঁত, বুকের ওপর পোড়া দাগ।
“আমি আর অন্য লাশের দিকে তাকাতে পারলাম না। আমি বেরিয়ে গেলাম,” বলছিলেন সায়রা।
তবে লাশটি যে পুলিশ কর্মকর্তা ভাই নয়- তা ভেবে স্বস্তি পেয়েছিলেন। পাকিস্তানের অন্যতম সংঘাতপূর্ণ অঞ্চল বেলুচিস্তানে ২০১৮ সালে সন্ত্রাসবিরোধী অভিযানে গ্রেপ্তার হওয়ার পর বছরখানেক নিখোঁজ ছিলেন তার ভাই।
সায়রা সেদিন বেরিয়ে এলেও অন্যরা মর্গের ভেতরে বেওয়ারিশ লাশের মাঝে স্বজনের খোঁজ চালিয়ে যেতে থাকে। একের পর এক মর্গ ঘুরে স্বজনের সন্ধান–মর্মন্তুদ এ কাজই পরে সায়রার নিত্যকর্ম হয়ে দাঁড়ায়।
সবগুলো মর্গের চিত্র একই রকম: মাথার ওপর টিউব লাইট জ্বলছিল, পচা ও অ্যান্টিসেপটিকের দুর্গন্ধে বাতাস ছিল ভারী।
ভাইয়ের খোঁজেই মর্গে মর্গে ঘুরতেন সায়রা। কিন্তু ভাইয়ের লাশ দেখতে হবে–এ তিনি ভাবতেও পারতেন না। সাত বছর হয়ে গেল, এখনো তিনি ভাইয়ের খোঁজ পাননি।
মানবাধিকার কর্মীরা বলছেন, গত দুই দশকে হাজার হাজার বালুচকে গুম করেছে পাকিস্তানের নিরাপত্তা বাহিনী। বিচ্ছিন্নতাবাদী বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে কয়েক দশকের অভিযানে বেআইনিভাবে আটক, অপহরণ, নির্যাতন ও হত্যার মত অভিযোগ রয়েছে তাদের বিরুদ্ধে।
এসব অভিযোগ অস্বীকার করে পাকিস্তান সরকার বলছে, নিখোঁজদের অনেকেই বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠীতে যোগ দিয়েছে অথবা দেশ ছেড়ে পালিয়েছে।
বিবিসি লিখেছে, অন্তর্ধানের কয়েক বছর বাদে কেউ কেউ ট্রমায় আক্রান্ত এবং ভেঙে পড়া অবস্থায় ফিরে এসেছেন, কিন্তু অনেকেই আর ফেরেন না। তাদের স্থান হয় বেলুচিস্তান জুড়ে থাকা অজ্ঞাত কবরে; তাদের দেহ এতটাই বিকৃত হয়ে যায় যে- শনাক্ত আর করা যায় না।
সেখানে এমন অনেক নারী রয়েছেন, যাদের জীবনের আরেক নাম অপেক্ষা। তাদের মিছিলে দেখা যায় তরুণী থেকে বৃদ্ধা–সব বয়সী নারীকেই। তাদের মুখে লেগে থাকে শোকের ছায়া, হাতে থাকে পরিবারের হারিয়ে যাওয়া পুরুষের বিবর্ণ ছবি।
বিবিসির সাংবাদিকরা যখন তাদের বাড়িতে যান, তারা ভাঙা কাপে সুলেমানি চা খেতে দেন। তাদের অনেকে জোর দিয়ে বলেন, তাদের বাবা, ভাই বা ছেলেরা নির্দোষ। রাষ্ট্রীয় নীতির বিরুদ্ধে সরব হওয়ায় তাদের নিশানা করা হয়েছে। তাদেরকে যেভাবে শাস্তি দেওয়া হচ্ছে, তাতে পুরো পরিবারকেই পুড়তে হচ্ছে।
সায়রা তাদেরই একজন। তিনি বলেন, পুলিশ ও রাজনীতিকদের কাছে ধরনা দেওয়ার পরও তার ভাইয়ের হদিশ মেলেনি। এরপর তিনি নিয়মিত বিক্ষোভে যোগ দিতে শুরু করেন।
২০১৮ সালের অগাস্টে আফগানিস্তান সীমান্তবর্তী নুশকি শহর থেকে মুহাম্মদ আসিফ বালুচসহ ১০ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। পরদিন টিভিতে দেখে তার অবস্থান জানতে পারে পরিবার; তাকে ভীত ও আলুথালু দেখাচ্ছিল।
কর্তৃপক্ষের ভাষ্য, তারা ‘আফগানিস্তানে পালিয়ে যাওয়া সন্ত্রাসী’। অথচ আসিফের পরিবার বলছে, তিনি বন্ধুদের সঙ্গে বনভোজনে গিয়েছিলেন।
সায়রার ভাষ্য, ভাই আসিফই ছিলেন তার ‘সেরা বন্ধু’; তিনি ছিলেন রসিক, সবসময় প্রফুল্ল থাকতেন।
“আমার মা এটা ভেবে কষ্ট পান যে, আসিফ হয়ত সেরকম করে হাসতেও ভুলে গেছে।”
আসিফ যেদিন নিখোঁজ হন, সেদিন সায়রা স্কুলের পরীক্ষায় দারুণ ফলাফল করেন। সেই খবর তিনি ভাইকে জানাতে উদগ্রীব ছিলেন। আসিফ তার বোনকে প্রাদেশিক রাজধানী কোয়েটায় বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার উৎসাহ দিয়ে আসছিলেন।
“আমি তখন জানতাম না যে- আমি প্রথমবার কোয়েটায় যাব তার মুক্তির দাবিতে বিক্ষোভে অংশ নেওয়ার জন্য,” বলেন সায়রা।
মুহাম্মদ আসিফ বালুচ আর ফিরে আসেননি।
নিষ্ফল ভূমি, নির্জন সড়ক
বিবিসি লিখেছে, পাকিস্তানের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের বেলুচিস্তানে ভ্রমণ করলে মনে হবে অন্য এক জগতে পা পড়েছে।
আয়তনে পাকিস্তানের প্রায় ৪৪ শতাংশ। দেশটির সবচেয়ে বড় এ প্রদেশ গ্যাস, কয়লা, তামা ও সোনায় সমৃদ্ধ। বেলুচিস্তানের বিস্তার পৌঁছেছে আরব সাগর পর্যন্ত।
এই আরব সাগরের ধারে দুবাই যেন বালি থেকে জন্ম নেওয়া ঝলমলে এক শহর, সেখানে দেখা যায় সারিসারি আকাশচুম্বী অট্টালিকা। অথচ বেলুচিস্তান যেন সময়ের আবর্তে আটকে আছে।
নিরাপত্তাজনিত কারণে পাকিস্তানের এ প্রদেশের অনেক এলাকায় প্রবেশাধিকার সীমিত এবং বিদেশি সাংবাদিকদের সেখানে তেমন প্রবেশ করতে দেওয়া হয় না।
বিবিসি লিখেছে, সেখানে ঘুরে বেড়ানোও কষ্টকর। সড়কগুলো দীর্ঘ ও নির্জন, অনুর্বর পাহাড় কেটে তৈরি করা রাস্তা গেছে মরুভূমির মধ্য দিয়ে। যত বেশি ভেতরে প্রবেশ করা যায়, ঘর-বাড়ি তত কমে আসে। এক সময় আর রাস্তা থাকে না। পথ চলতে হয় পুরনো চাকার দাগ দেখে।
বিদ্যুৎ রয়েছে কোথাও কোথাও, পানিও যেন দুষ্প্রাপ্য। স্কুল ও হাসপাতালের অবস্থা শোচনীয়।
বাজারে পুরুষরা মাটির দোকানের বাইরে বসে ক্রেতার জন্য অপেক্ষা করে, তবে ক্রেতাদের আনাগোনা খুবই কম। পাকিস্তানের অন্য জায়গায় কিশোর তরুণর যখন ক্যারিয়ার গড়ার স্বপ্ন দেখে, বেলুচিস্তানের তরুণরা সেখানে কেবল পালানোর কথা ভাবে–হয় করাচি, নয়ত উপসাগরীয় যে কোনো দেশে–যেখানে এই শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতি থেকে মুক্তি মিলবে।
ব্রিটিশ ভারত ভাগ হওয়ার পর প্রভাবশালী উপজাতি নেতাদের বিরোধিতার মধ্যেও ১৯৪৮ সালে বেলুচিস্তান পাকিস্তানের অংশ হয়ে যায়। ওই নেতারা একটি স্বাধীন রাষ্ট্র চেয়েছিলেন।
কিছু ক্ষেত্রে তাদের প্রতিবাদ সশস্ত্র প্রতিরোধের রূপ পায়, যার মূলে ছিল বছরের পর বছর ধরে চলে আসা ক্ষোভ। তাদের অভিযোগ, বেলুচিস্তানের উন্নয়নে বিনিয়োগ না করে পাকিস্তান সম্পদ সমৃদ্ধ এ অঞ্চলকে কেবল শোষণ করে গেছে।
বেলুচিস্তান লিবারেশন আর্মির (বিএলএ) মত সংগঠনগুলো তাদের আক্রমণের ধার বাড়িয়েছে। নিরাপত্তা বাহিনীর বিরুদ্ধে বোমা হামলা, চোরাগোপ্তা হামলা আরও বাড়িয়েছে তারা। বিএলএকে ‘সন্ত্রাসী সংগঠন’ হিসেবে বিবেচনা করে পাকিস্তান।
চলতি মাসের শুরুর দিকে বোলান পাসে একটি ট্রেন ছিনতাই করে শত শত যাত্রীকে জিম্মি করে বিএলএ। তারা জিম্মিদের মুক্তির বিনিময়ে বেলুচিস্তানের নিখোঁজ ব্যক্তিদের মুক্তি দাবি করে।
এই জিম্মিদশা চলে ৩০ ঘণ্টার বেশি সময় ধরে। কর্তৃপক্ষের বর্ণনা অনুযায়ী, ৩৩ জন বিএলএ ‘সন্ত্রাসী’, ২১ জন বেসামরিক জিম্মি এবং চারজন সামরিক সদস্য ওই ঘটনায় নিহত হয়েছেন। তবে অনেক যাত্রী এখনো নিখোঁজ– এমন কথাও ভাসছে বাতাসে।
বিবিসি লিখেছে, বেলুচিস্তানে এসব নিখোঁজের ঘটনা ইসলামাবাদের বিদ্রোহ দমন কৌশলের অংশ বলে মনে করেন অনেকে। সেই সঙ্গে ভিন্নমত দমন, বালুচদের জাতীয়তাবাদী চেতনা দুর্বল করা এবং স্বাধীন বেলুচিস্তান দাবি ঠেকানোও এর উদ্দেশ্য বলে তাদের ধারণা।
নিখোঁজদের অনেকেই সন্দেহভাজন বালুচ জাতীয়তাবাদী গোষ্ঠীর সদস্য বা সমর্থক, যাদের দাবি আরও স্বায়ত্তশাসন বা স্বাধীনতা। কিন্তু তাদের একটি বড় অংশ সাধারণ মানুষ, যাদের কোনো রাজনৈতিক পরিচয় নেই।
বেলুচিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী সরফরাজ বুগতি বিবিসিকে বলেছেন, গুমের ঘটনা একটি বিষয়। কিন্তু বড় মাত্রায় এসব ঘটনা ঘটছে- এমন ধারণাকে ‘প্রপাগান্ডা’ বলে উড়িয়ে দেন তিনি।
“বেলুচিস্তানের প্রতিটি শিশুকে 'নিখোঁজ ব্যক্তি, নিখোঁজ ব্যক্তির' কথা শোনানো হয়েছে। কিন্তু কে কাকে গুম করল তা কে বের করবে?
“আত্মগোপনের ঘটনাও রয়েছে। গোয়েন্দা সংস্থা, পুলিশ, এফসি (ফ্রন্টিয়ার কন্সটাবুলারি) বা অন্য কেউ বা আমি বা আপনি কাউকে গুম করেছি কি না তা আমি কীভাবে প্রমাণ করব?”
পাকিস্তান সেনাবাহিনীর মুখপাত্র লেফটেন্যান্ট জেনারেল আহমেদ শরিফ সম্প্রতি এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, “রাষ্ট্র নিয়মতান্ত্রিকভাবে নিখোঁজ ব্যক্তিদের বিষয়টি সমাধান করছে।”
সরকারি পরিসংখ্যান তুলে ধরে তিনি বলেন, ২০১১ সাল থেকে বেলুচিস্তানে গুমের ২,৯০০ এরও বেশি ঘটনার মধ্যে ৮০ শতাংশের সমাধান করা হয়েছে।
তবে অধিকারকর্মীরা দাবি করছেন, গুমের ঘটনা সংখ্যা প্রায় ৭ হাজার। তবে এ বিষয়ে নির্ভরযোগ্য একক কোনো পরিসংখ্যান নেই; কোনো পক্ষের দাবি যাচাই করারও উপায় নেই।
‘চুপ থাকা সমাধান নয়’
জান্নাত বিবির মত নারীরা সরকারি হিসাব মানতে নারাজ। তিনি তার ছেলে নজর মুহাম্মদের সন্ধান অব্যাহত রেখেছেন। তার দাবি অনুযায়ী, ২০১২ সালে একটি হোটেলে নাশতা খাওয়ার সময় ছেলেকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়।
“আমি তাকে খুঁজতে সব জায়গায় গেছি। এমনকি আমি ইসলামাবাদেও গেছি। আমি যা পেয়েছি তা হল মারধর আর প্রত্যাখ্যান।”
৭০ বছর বয়সী এই বৃদ্ধা কোয়েটার উপকণ্ঠে একটি ছোট্ট মাটির বাড়িতে বাস করেন। অদূরেই রয়েছে নিখোঁজদের একটি প্রতীকী কবরস্থান।
বিস্কুট ও দুধের কার্টন বিক্রির ছোট্ট একটি দোকান চালান জান্নাত, নিখোঁজদের তথ্য চেয়ে বিক্ষোভে যোগ দিতে গিয়ে প্রায়ই তিনি বাসা ভাড়াও জোটাতে পারেন না। তবে তিনি ততটুকুই ধার করেন, যতটুকু চলার জন্য না হলেই নয়।
জান্নাত বলেন, “চুপ করে থাকা কোনো সমাধান নয়।”
বিবিসি যেসব পরিবারের সঙ্গে কথা বলেছে, তাদের বেশিরভাগের স্বজন ২০০৬ সালের পর নিখোঁজ হয়েছেন।
ওই বছরই বালুচ নেতা নবাব আকবর বুগতি সামরিক অভিযানে নিহত হন, আর তাতে রাষ্ট্রবিরোধী বিক্ষোভ ও সশস্ত্র বিদ্রোহী তৎপরতা বৃদ্ধি পায়।
বিবিসি লিখেছে, এর প্রতিক্রিয়ায় সরকার কঠোর পদক্ষেপ নিয়েছে, গুমের সংখ্যা যেমন বেড়েছে, তেমনই সড়কে পড়ে থাকা মৃতদেহের সংখ্যাও বেড়েছে।
২০১৪ সালে কোয়েটা থেকে ২৭৫ কিলোমিটার দক্ষিণে খুজদার শহর সংলগ্ন মফস্বল শহর টুটাকে নিখোঁজ ব্যক্তিদের গণকবর আবিষ্কৃত হয়।
ততোদিনে লাশগুলো এতোটাই বিকৃত হয়ে গিয়েছিল যে শনাক্ত করা সম্ভব হয়নি। টুটাকের এই চিত্র পাকিস্তানে আলোড়ন তোলে–কিন্তু বেলুচিস্তানের মানুষের কাছে এই ভয়াবহতা অপরিচতি ছিল না।
মাহরাং বালুচের বাবা, বালুচদের অধিকারের জন্য লড়াইয়ের জাতীয়তাবাদী নেতা নিখোঁজ হন ২০০৯ সালের শুরুর দিকে। আবদুল গাফফার ল্যাঙ্গোভ পাকিস্তানি সরকারি চাকরি করতেন, কিন্তু নিরাপদ বেলুচিস্তান গড়তে তিনি চাকরি ছেড়েছিলেন।
তিন বছর পরে মাহরাংয়ের ফোনে একটি কল আসে, বলা হয়-তার বাবার মৃতদেহ প্রদেশের দক্ষিণের জেলা লাসবেলায় পাওয়া গেছে।
“আমার বাবার লাশ যখন এসেছিল, তখন তিনি একই পোশাকে ছিলেন, কিন্তু ছেঁড়া। তার ওপর বাজেভাবে নির্যাতন চালানো হয়।”
বাবার শেষ দিনগুলো নিয়ে পাঁচবছর দুঃস্বপ্ন দেখেছেন মাহরাং। তিনি বাবার কবরে গিয়ে নিজেকে সান্ত্বনা দিতেন এই বলে যে- বাবা আর বেঁচে নেই; তার ওপর আর নির্যাতন চালানো যাবে না।
এরপর ২০১৭ সালে তার ভাইকে নিরাপত্তা বাহিনী তুলে নিয়ে যায় এবং প্রায় তিন মাস আটকে রাখে।
মাহরাং বলেন, “এটা ভয়ংকর ছিল। আমি আমার মাকে বিশ্বাস করিয়েছিলাম যে– আমার বাবার সাথে যা ঘটেছে, তা আমার ভাইয়ের সাথে ঘটবে না। কিন্তু সেটাই হয়েছে।”
তিনি বলেন, “কল এলে আমি আমার ফোনের দিকে তাকাতে ভয় পেতাম, কারণ হয়ত আমার ভাইয়ের লাশ খুঁজে পাওয়ার খবর আসবে।”
মাহরাং বলেন, তিনি ও তার মা পরস্পরকে সাহস যুগিয়েছেন।
“আমাদের ছোট্ট বাড়িটি ছিল–আমাদের জন্য সবচেয়ে নিরাপদ জায়গা, যেখানে আমরা মাঝে মাঝে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে কাঁদতাম। বাইরে আমাদের দেখাত শক্তিশালী নারী হিসেবে, যাদের নিষ্পেষণ করা যাবে না।”
মাহরাং গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের সিদ্ধান্ত নেন। মৃত্যুর হুমকি, আইনি ঝামেলা এবং ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞার পরও ৩২ বছর বয়সী এই নারী এখন প্রতিবাদী আন্দোলনে নেতৃত্ব দিচ্ছেন।
“নিপীড়ন ছাড়া নিজেদের ভূমিতে বসবাসের অধিকার আমরা চাই। আমরা আমাদের সম্পদ, আমাদের অধিকার চাই। আমরা চাই ভয় ও সহিংসতার এই সংস্কৃতির অবসান ঘটুক।”
মাহরাং সতর্ক করে দিয়েছেন, গুমের ফলে মানুষ নীরব হওয়ার বদলে আরও প্রতিরোধী হয়ে ওঠে।
“তারা মনে করে, লাশ ফেলে দিলে এর অবসান হবে। কিন্তু এভাবে প্রিয়জনকে হারানোর কথা কীভাবে ভুলতে পারে কেউ? কোনো মানুষই এটা সহ্য করতে পারে না।”
বিবিসিকে সাক্ষাৎকার দেওয়ার কয়েক সপ্তাহ বাদে গত শনিবার মাহরাং গ্রেপ্তার হয়েছেন।
কোয়েটায় ১৩ জনের বেওয়ারিশ লাশ দাফনের পর বিক্ষোভের নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন তিনি। কর্তৃপক্ষ দাবি করেছে, তারা বোলান পাসে ট্রেন ছিনতাইয়ের পরে নিহত ‘সন্ত্রাসী’, যদিও এই ভাষ্য স্বাধীনভাবে যাচাই করা যায়নি।
এর আগে মাহরাং বলেছিলেন, “আমাকে যে কোনো সময় গ্রেপ্তার করা হতে পারে। কিন্তু আমি ভয় পাই না। এটা আমাদের জন্য নতুন কিছু নয়।”
তিনি যখন ভবিষ্যতের জন্য লড়ছেন, ততোক্ষণে নতুন প্রজন্ম রাস্তায় নেমেছে।
১০ বছর বয়সী মাসুমা যখন তার স্কুল ব্যাগ শক্ত করে আঁকড়ে ধরে বিক্ষোভকারীদের ভিড়ের মধ্যে অগ্রসর হতে থাকে, তার চোখ প্রতিটি মুখ খুঁটিয়ে দেখে– বাবার মত দেখতে কাউকে খুঁজে ফেরে।
সে বলে, “একবার এক ব্যক্তিকে দেখে আমি ভেবেছিলাম, তিনি আমার বাবা। আমি দৌড়ে তার কাছে যাই এবং তারপর বুঝতে পারি যে- তিনি অন্য কেউ।”
মাসুমা বলে, “সবার বাবা কাজ শেষে বাসায় আসে। আমি আমার বাবাকে কখনো পাইনি।”
মাসুমার বয়স যখন মাত্র তিন মাস, তখন এক গভীর রাতে কোয়েটায় অভিযানের সময় নিরাপত্তা বাহিনী তার বাবাকে ধরে নিয়ে যায়।
তখন তার মাকে বলা হয়েছিল, কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই তিনি ফিরবেন। তবে তিনি কখনোই ফেরেননি।
বিবিসি লিখেছে, মাসুমা এখন শ্রেণিকক্ষের চেয়ে বিক্ষোভেই বেশি সময় ব্যয় করে। তার সঙ্গে সবসময় স্কুল ব্যাগে বাবার ছবি থাকে।
প্রতিবার পড়তে বসার আগে সে বাবার ছবি বের করে দেখে।
“আমি সবসময় ভাবি, বাবা হয়ত আজ বাড়ি আসবে।”
মাসুমা যখন মিছিলে দাঁড়িয়ে অন্যদের সঙ্গে স্লোগান দিচ্ছিল, শোকাহত পরিবারের ভিড়ে তার ছোট্ট অবয়ব খুঁজে পাওয়া কঠিন।
বিক্ষোভ শেষ হতেই নিরিবিলি এক কোণায় পাতলা মাদুরের ওপর আড়াআড়িভাবে বসে পড়ে সে। স্লোগান আর গাড়ির শব্দ যখন ম্লান হয়ে আসে, তখন সে তার ভাঁজ করা চিঠিগুলো বের করে আনে। এই চিঠিগুলো সে বাবাকে লিখেছে, কিন্তু কখনো পাঠাতে পারেনি।
ভাঁজ খোলার সঙ্গে সঙ্গে তার আঙুলগুলো কাঁপতে থাকে, বিড়বিড় করে সে অস্থির কণ্ঠে চিঠিগুলো পড়তে থাকে।
“প্রিয় বাবা জান, তুমি কখন ফিরে আসবে? আমি যখনই খাই, পানি পান করি, আমি তোমাকে মিস করি। বাবা, তুমি কোথায়? আমি তোমাকে খুব মিস করি। আমি একা। তুমি ছাড়া আমি ঘুমাতে পারি না। আমি শুধু তোমার সাথে দেখা করতে চাই, তোমার মুখ দেখতে চাই।”