তবে ভারতের সর্বোচ্চ আদালত বলেছে, একজন ব্যক্তির জুটি বাঁধার অধিকারকে কেবল তার লিঙ্গ পরিচয়ের ভিত্তিতে সীমাবদ্ধ করে দেওয়া উচিত নয়।
Published : 17 Oct 2023, 02:11 PM
সমলিঙ্গ সম্পর্কের অধিকারকে স্বীকৃতি দিলেও সমকামী বিয়ের বৈধতা প্রশ্নে কোনো সিদ্ধান্ত দেয়নি ভারতের সর্বোচ্চ আদালত। বহুল আলোচিত এক মামলার রায়ে দেশটির সুপ্রিম কোর্ট বলেছে, আদালত সমলিঙ্গ বিয়ের বৈধতা দিতে পারে না, এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে পারে কেবল আইনসভা।
ভারতের প্রধান বিচারপতি ধনঞ্জয় যশবন্ত চন্দ্রচূড় নেতৃত্বাধীন পাঁচ বিচারকের সাংবিধানিক বেঞ্চ মঙ্গলবার এ মামলার রায় ঘোষণা করে।
বিচারপতি চন্দ্রচূড় বলেছেন, একজন ব্যক্তির জুটি বাঁধার অধিকারকে কেবল তার লিঙ্গ পরিচয়ের ভিত্তিতে সীমাবদ্ধ করে দেওয়া উচিত নয়। বিবাহ নামের প্রতিষ্ঠানটিও অনড়, অটল কোনো বিষয় নয়। বিয়ের ধারণা বদলায়। এ নিয়ে দেশে দেশে সার্বজনীন কোনো আইনও নেই। তবে কোনো দেশে বিয়ে নিয়ে কেমন আইন হবে, সেটা একান্তই পার্লামেন্টের এখতিয়ার।
সে কারণে সরকারের প্রস্তাবে সায় দিয়ে আদালত একটি কমিটি করতে বলেছে, যে কমিটি সমলিঙ্গের জুটিদের সামাজিক এবং আইনি বিভিন্ন অধিকার নিশ্চিত করতে কাজ করবে।
ভারতে বিশেষ বিয়ে আইনে সমলিঙ্গের মানুষের বিয়ের বিষয়টি না থাকা অবৈধ কি না, সেই প্রশ্নও ছিল এ মামলায়। আদালত বলছে, বিচারবিভাগ কেবল আইনের প্রয়োগে জোর দিতে পারে, আইন তৈরি করে সমকামীদের বিয়ের বৈধতা দিতে পারে না। এটি পার্লামেন্টের কাজ।
বিবিসি জানিয়েছে, সর্বোচ্চ আদালতের এই রায়ে হতাশ ভারতের এক কোটি ‘এলজিবিটিকিউপ্লাস’ জনগোষ্ঠী।
অন্যদিকে দেশটির সরকার ও ধর্মীয় ব্যক্তিরা সমকামীদের আবেদনের তীব্র বিরোধিতা করে আসছিল। তাদের ভাষ্য, এই বিয়ের বৈধতা দেওয়া হলে তা ভারতীয় সংস্কৃতির বিরুদ্ধে যাবে।
সরকারের তরফ থেকে সমলিঙ্গ বিয়ের বিরোধিতায় আদালতে বলা হয়, এটি একটি ‘শহুরে অভিজাত দৃষ্টিভঙ্গি’। স্বামী-স্ত্রী-সন্তান নিয়ে ভারতীয় পরিবারের একক ধারণার সঙ্গে সমলিঙ্গের বিয়ের ধারণাটি যায় না। আর এ বিষয়ে বিতর্ক ও আলোচনার জন্য পার্লামেন্ট ও আইনসভাই সঠিক জায়গা।
সুপ্রিম কোর্ট ওই বক্তব্যের প্রথম অংশের সঙ্গে দ্বিমত করে বলেছে, ভারতে সমলিঙ্গের মানুষের ইতিহাস অনেক পুরনো, সুতরাং এটা ‘শহুরে অভিজাত দৃষ্টিভঙ্গি’ বলা ঠিক হবে না। কিন্তু কেবল আইনপ্রণেতারাই যে এ ধরনের বিয়ের বৈধতা দিয়ে আইন করতে পারে, সে বিষয়ে সাংবিধানিক বেঞ্চ একমত।
সমকামী ও অধিকারকর্মীরা বলছেন, ভারতের আইনে তাদের বিয়ের স্বীকৃতি না দেওয়ার বিষয়টি তাদের ‘দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক’ করে রেখেছে। এজন্য বিয়ের আইনি বৈধতা পেতে তারা আবেদন করেছিলেন।
একই বিষয়ে দেশের বিভিন্ন হাই কোর্টে জমে থাকা মামলাগুলো এক জায়গায় করে গত জানুয়ারিতে একসঙ্গে শুনানির সিদ্ধান্ত নিয়েছিল প্রধান বিচারপতি চন্দ্রচূড়ের বেঞ্চ। এপ্রিল ও মে মাসে ২১ দিন শুনানি শেষে বিষয়টি রায়ের জন্য অপেক্ষমাণ ছিল।
মঙ্গলবার রায় ঘোষণার সময় প্রধান বিচারপতি ছাড়াও বেঞ্চে ছিলেন বিচারপতি সঞ্জয় কিষাণ কউল, বিচারপতি এস রবীন্দ্র ভট্ট, বিচারপতি হিমা কোহলি এবং বিচারপতি এস নরসিংহ।
এর আগে ২০১৮ সালে সমকামী যৌনতাকে বৈধতা দেয় আদালত। ভারত ছাড়াও এশিয়ায় সমলিঙ্গের সম্পর্কের অনুমতি রয়েছে কেবল তাইওয়ান ও নেপালে।
স্পেশাল ম্যারেজ অ্যাক্ট
ভারতীয় সংবিধানের ২১ ধারা অনুযায়ী এলজিবিটিকিউপ্লাস (নারী ও পুরুষ সমকামী, উভকামী, রূপান্তরকামী, কিম্ভুত ও অন্যান্য) ব্যক্তিদের সঙ্গী পছন্দের অধিকার রয়েছে। তবে ১৯৫৪ সালে হওয়া স্পেশাল ম্যারেজ অ্যাক্টে বা বিশেষ বিয়ে আইনে কেবল বিভিন্ন বর্ণ ও ধর্মের লোকদের মধ্যে বিবাহের অনুমতি দিয়েছে।
বিচারপতি এস রবীন্দ্র ভাট রায় ঘোষণার সময় বলেন, প্রধান বিচারপতির সঙ্গে তিনি একমত যে, সমকামীতা শহুরে কিংবা অভিজাত কোনো ধারণা নয় এবং বিশেষ বিয়ে আইনের বিষয়ে বিচারবিভাগ কোনোকিছু যোগ করতে পারে না।
তবে প্রধান বিচারপতি তার মন্তব্যে এলজিবিটিকিউপ্লাস দম্পত্তিদের সন্তান দত্তক নেওয়ার অধিকারের স্বীকৃতি দিলেও বিচারপতি রবীন্দ্র ভাট এ অধিকারসহ আরও কিছু বিষয়ে দ্বিমত পোষণ করেন।
“কিন্তু বিয়ে যদি সামাজিক আইন হিসেবেই স্বীকৃত হয়, তাহলে একই রকমের আইন চালু করতে চাওয়া সমাজের কোনো অংশ কি আদালতের দ্বারস্থ হতে পারে? সমকামীদের জন্য আদালত আইনি কাঠামো তৈরি করতে পারে না, কারণ এটি আইনসভার কাজ।”
বিয়ে মৌলিক অধিকার নয়: প্রধান বিচারপতি
জীবনসঙ্গী বেছে নেওয়াকে জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ বলে মনে করেন প্রধান বিচারপতি চন্দ্রচূড়।
তিনি বলেন, কেউ এটিকে জীবনের সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত হিসাবে বিবেচনা করতে পারে৷ বিয়ের মাধ্যমে অনেক বৈষয়িক সুবিধা রয়েছে।
“ভারতীয় সংবিধানের ২১ ধারায় জীবন ও স্বাধীনতার অধিকারের বিষয়টি নিশ্চিত করা হয়েছে। সংবিধানে বিয়ে কোনো মৌলিক অধিকার নয়। আইনি গুরুত্বের ভিত্তিকে কোনো আইনকে মৌলিক অধিকারের ভেতরে ফেলা যায় না। তবে সাংবিধানিক মূল্যবোধে বৈবাহিক সম্পর্কের বেশ কয়েকটি দিক রয়েছে। যেমন- মানুষের মর্যাদার অধিকার, জীবন ও ব্যক্তিস্বাধীনতার অধিকার।
“এই আদালত আইনি সীমাবদ্ধতার কারণে বিশেষ বিয়ে আইনের সাংবিধানিক বৈধতা বাতিল করতে পারে না। আদালত কেবল আইনি বিষয়গুলো স্পষ্ট করবে।”
প্রধান বিচারপতি বলেন, কোনো ইউনিয়ন বা সংঘে যুক্ত হওয়ার অধিকারের মধ্যে রয়েছে কারও সঙ্গী বেছে নেওয়ার অধিকার এবং সেই স্বীকৃতির অধিকার। এ ধরনের স্বীকৃতি দিতে ব্যর্থতা সমকামী দম্পতিদের প্রতি বৈষম্যে হবে।
অবিবাহিত বা সমকামী দম্পতি চাইলে সন্তান দত্তক নিতে পারে, প্রধান বিচারপতি এমন সিদ্ধান্ত দিলেও বেঞ্চের অন্য বিচারকরা তাতে সায় দেননি।
‘ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের অধিকার বৈধ বিবেচনা করা উচিৎ’
প্রধান বিচারপতি চন্দ্রচূড় বলেছেন, “ভালোবাসা অনুভব করার ক্ষেত্রে আমরা অনন্য নাও হতে পারি, কিন্তু এই ভালোবাসাই আমাদের মানুষ করে তোলে। এই সম্পর্কগুলোর অনেক রূপ হতে পারে এবং ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের অধিকার অবশ্যই বাধাহীন হতে হবে।
“এমনকি কোনো বিশেষ বৈবাহিক সম্পর্ককে আইন অনুমোদন না দিলেও সমাজের চোখে সেটিকে বৈধ বিবেচনা করা উচিৎ।”
বিয়ের জন্য একটি নতুন আইন তৈরি করতে পার্লামেন্ট বা রাজ্যসভাকে আদালত বাধ্য করতে পারে না বলেও মত দেন প্রধান বিচারপতি।
তিনি বলেন, “সমকামী বিয়ের অনুমতি না দেওয়ায় আমরা বিশেষ বিয়ে আইনকে অসাংবিধানিক বলতে পারি না। অথবা এ আইন বা অন্যান্য আইনি ধারার খসড়া পুনরায় লিখতে পারি না।”
“বিচার বিভাগ আইন তৈরি করতে পারে না। আদালত আইন তৈরি করতে পারে না, তবে আইনের প্রয়োগ করতে পারে।”
সুযোগ বাড়ানোর প্রস্তাব
বিবিসি জানিয়েছে, সমকামীদের দাবি নিয়ে ভারতের মন্ত্রিপরিষদ সচিবের নেতৃত্বে একটি বিশেষজ্ঞ প্যানেল গঠনের প্রস্তাব করা হয়েছে। সেখানে সমকামীদের বিয়ে নয়, তাদের মর্যাদা ও সুযোগ-সুবিধা দেওয়ার বিষয়টি প্রস্তাব করা হয়েছে। সরকারের পক্ষে সলিসিটর জেনারেল তুষার মেহতার দেওয়া ওই প্রস্তাব গ্রহণ করেছেন প্রধান বিচারপতি চন্দ্রচূড়।
সমলিঙ্গের বিয়েকে বৈধতা না দিলেও তাদের অধিকার রক্ষায় বেশ কিছু সুপারিশ করেছে সুপ্রিম কোর্ট।
সরকারের প্রতি সুপারিশ
লিঙ্গ পরিচয় বা যৌনতার কারণে সমকামী সম্প্রদায় যাতে বৈষম্যের শিকার না হয়, সেটি নিশ্চিত করা।
জনসাধারণের জন্য যেসব পণ্য ও সেবা উন্মুক্ত, সেখানে সমলিঙ্গ সম্প্রদায়ও যেন বৈষম্যের শিকার না হয়।
এলজিবিটিকিউপ্লাস-দের সম্পর্কে জনগণকে জানানো যে, এটি স্বাভাবিক বিষয়, কোনো মানসিক ব্যাধি নয়।
নির্যাতন ও সহিংসতার ক্ষেত্রে তাদের জন্য হটলাইন চালু করা।
সহিংসতা বা বৈষম্যের শিকার সমকামী ব্যক্তিদের জন্য সব জেলায় সেইফ হাউজ তৈরি ও প্রচার করা।
সমকামীদের লিঙ্গ পরিচয় বা যৌন চাহিদার পরিবর্তনে চিকিৎসক বা অন্যদের চিকিৎসা অবিলম্বে বন্ধ করা।
সমকামী শিশুদের কেবল লিঙ্গ পরিবর্তনে তাদের অস্ত্রোপচারে করতে বাধ্য করা যাবে না। বিশেষ করে এমন বয়সে, যখন তারা বিষয়টি বুঝতে ও সম্মতি দিতে অক্ষম।
লিঙ্গ পরিচয়ের আইনি শর্ত হিসেবে কোনো ব্যক্তিকে হরমোনাল থেরাপি বা বন্ধ্যাকরণ কিংবা অন্য চিকিৎসা পদ্ধতির মধ্যে দিয়ে যেতে হবে না।
পুলিশের প্রতি নির্দেশনা
সমকামী দম্পতিকে থানায় ডেকে নিয়ে বা বাড়িতে গিয়ে তাদের লিঙ্গ পরিচয় বা যৌন প্রবণতা সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করার ক্ষেত্রে হয়রানি করা যাবে না।
যে পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছে, সেই পরিবারে সমকামীদের ফিরে যেতে বাধ্য করা হবে না, যদি তারা না চায়। পরিবারের লোকজন তাদের চলাফেরা বাধাগ্রস্ত করলে এবং তারা যদি পুলিশে অভিযোগ করে সে বিষয়ে পুলিশ ব্যবস্থা নেবে। তাদের স্বাধীনতা রক্ষা করবে। তাদের অভিযোগগুলো পুলিশ যাচাই করে সুরক্ষা নিশ্চিত করবে।
পুরনো খবর-
ভারতে সমকামী বিয়ে কি বৈধতা পাবে? সিদ্ধান্তের পথে সুপ্রিম কোর্ট