প্রয়োজনে বলপ্রয়োগ করে হলেও গ্রিনল্যান্ড ও পানামা খাল দখলে ট্রাম্পের হুমকি যুক্তরাষ্ট্রের তাইওয়ান নীতিতে কী প্রভাব ফেলতে পারে তা নিয়ে সাম্প্রতিক দিনগুলোতে চীনের সোশাল মিডিয়ায় ব্যাপক আলোচনা চলছে।
Published : 16 Jan 2025, 04:45 PM
তাইওয়ানকে নিজেদের অংশ দাবি করে চীনের জোর তৎপরতায় ‘সংযম’ প্রদর্শন এবং গণতান্ত্রিকভাবে শাসিত দ্বীপটিকে নিজেদের করে নিতে বেইজিং যে নিয়মিত সামরিক হুমকিধামকি দিয়ে যাচ্ছে তা বন্ধে যুক্তরাষ্ট্রের সরকারগুলো বছরের পর বছর ধরে আহ্বান জানিয়ে এসেছে।
কিন্তু এবার যুক্তরাষ্ট্রের নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্প ‘প্রয়োজনে বলপ্রয়োগ করে হলেও’ গ্রিনল্যান্ড ও পানামা খাল দখলের যে হুমকি দিয়েছেন তা তাইওয়ান ঘিরে যুক্তরাষ্ট্রের দীর্ঘদিন ধরে দিয়ে আসা এ বার্তার প্রভাবকে খাটে করে দিয়েছে বলে চীনের অনেক ভাষ্যকারই মনে করছেন।
ট্রাম্পের মন্তব্য যুক্তরাষ্ট্রের তাইওয়ান নীতিতে কী প্রভাব ফেলতে পারে তা নিয়ে সাম্প্রতিক দিনগুলোতে চীনের সোশাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্ম ও পররাষ্ট্র নীতি বিশ্লেষকদের মধ্যে তুমুল আলোচনা দেখা যাচ্ছে বলে এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে বার্তা সংস্থা রয়টার্স।
অনেকে বলছেন, তাইওয়ান ঘিরে ওয়াশিংটন ও বেইজিংয়ের মুখোমুখি সামরিক অবস্থান নিকট ভবিষ্যতে বদলাবে এমন সম্ভাবনা দেখা না গেলেও ট্রাম্প যেভাবে আমেরিকান কূটনৈতিক রীতিনীতি ভাঙতে পছন্দ করেন, তা চীনের জন্য সুযোগও সৃষ্টি করতে পারে।
চীনা এক বিশেষজ্ঞের মতে, ট্রাম্প যে পররাষ্ট্র নীতিকে দেনা-পাওনার জায়গা থেকে দেখেন তেমন ইঙ্গিত তার প্রথম মেয়াদেই পাওয়া গেছে। এমনটা হলে তিনি তাইওয়ান নিয়ে নতুন চুক্তিতে আগ্রহী হলেও হতে পারেন।
সাংহাইয়ের ফুদান বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক অধ্যয়ন ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক জো মিংহাউ বলছেন, গ্রিনল্যান্ড, পানামা খাল এমনকি কানাডা দখলে ট্রাম্পের হুমকিকে গুরুত্বের সঙ্গে নেওয়া উচিত।
“পাশাপাশি, ট্রাম্পের লেনদেনবাদ, যা নিয়ে তিনিও বেশ সিরিয়াস, তা নিয়েও চিন্তাভাবনা করা দরকার। চীনের অনেকেই ট্রাম্পকে এখনও চুক্তি-প্রণেতা হিসেবেই দেখেন, এমনকি তাইওয়ানের মতো কঠিন ইস্যুতেও,” বলেছেন তিনি।
চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় অবশ্য বলছে, গ্রিনল্যান্ডের সঙ্গে তাইওয়ানের তুলনার চেষ্টাই ‘হাস্যকর’।
“তাইওয়ান ইস্যু হচ্ছে চীনের অভ্যন্তরীণ ব্যপার, কীভাবে এর নিষ্পত্তি হবে তা দেখবে চীনের জনগণ,” রয়টার্সকে পাঠানো এক বিবৃতিতে এমনটাই বলেছে তারা।
ট্রাম্পের মন্তব্যের কারণে তাইওয়ান ঘিরে নিত্যনতুন সংকট তৈরিতে চীনকে উৎসাহিত করতে পারে কিনা, এমন প্রশ্নের জবাবে তাইওয়ানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, “চীনা প্রজাতন্ত্র (তাইওয়ানের সাংবিধানিক নাম) একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম দেশ।”
“তাইওয়ানের সার্বভৌম মর্যাদার কোনো ধরনের বিকৃতিই তাইওয়ান প্রণালীর স্থিতাবস্থার বদল ঘটাবে না,” বিবৃতিতে বলেছে তারা।
এ প্রসঙ্গে মন্তব্য চাইলেও যুক্তরাষ্ট্রে ক্ষমতা হস্তান্তর কাজে নিয়োজিত ট্রাম্পের দল তাৎক্ষণিকভাবে তাতে সাড়া দেয়নি।
চীন সবসময়ই তাইওয়ানকে তার ভূখণ্ডের অংশ বলেই দাবি করে আসছে। দ্বীপটিকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিতে বলপ্রয়োগের সম্ভাবনাও কখনো খারিজ করেনি তারা।
বেইজিংয়ের জন্য ঝামেলার কারণ হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র, কেননা তাইওয়ানের আত্মরক্ষায় সহায়তা করতে ওয়াশিংটন আইনিভাবে বাধ্য; তবে সেই ‘কৌশলগত অস্পষ্টতা’ নীতিতে চীনের সঙ্গে যুদ্ধ বাধলে যুক্তরাষ্ট্রের সেনারা তাইওয়ানের পক্ষে ঢাল হয়ে দাঁড়াবে কিনা তাও পরিষ্কার নয়।
প্রেসিডেন্ট হিসেবে প্রথম মেয়াদে নিয়মিত অস্ত্র বিক্রিসহ তাইওয়ানের প্রতি দৃঢ় সমর্থন দেখিয়েছিলেন ট্রাম্প। কিন্তু গত বছরের নির্বাচনী প্রচারে তিনি বলেছিলেন, নিজেকে রক্ষা করতে চাইলে তাইওয়ানকে অবশ্যই যুক্তরাষ্ট্রকে অর্থ দিতে হবে। এদিকে তাইওয়ানও নিয়মিত প্রতিরক্ষা ব্যয় বৃদ্ধির প্রতিশ্রুতি দিয়ে যাচ্ছে।
রয়টার্স লিখেছে, চীনের দৃষ্টিতে তাইওয়ান ইস্যু যে গ্রিনল্যান্ড, কানাডা বা পানামা খালের তুলনায় পুরোপুরিই আলাদা, তা স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছে। তাদের ভাষ্যমতে, তাইওয়ান এখনি আইনত চীনের অংশ, যার ভবিষ্যতই হচ্ছে ‘মাতৃভূমির সঙ্গে একাত্ম’ হওয়া। বেইজিংয়ের এই দাবিকে তাইওয়ান নিয়মিতই প্রত্যাখ্যান করে আসছে।
এদিকে গ্রিনল্যান্ড নিয়ে ট্রাম্পের মন্তব্যের পর নিয়মিতই সেন্সরশিপের খাড়ায় পড়ে এমন চীনা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও তুমুল আলোচনা শুরু হয়েছে।
“যুক্তরাষ্ট্র যদি গ্রিনল্যান্ড দখল করতে পারে, তাহলে চীনেরও উচিত তাইওয়ান নিয়ে নেওয়া,” মাইক্রোব্লগ সাইট উইবুতে এমনটাই লিখেছেন হংকংয়ের সিটি ইউনিভার্সিটির আইনের অধ্যাপক ওয়াং জিয়াংগু।
চীনা সার্চ ইঞ্জিন বাইদু পরিচালিত একটি ব্লগে এক মন্তব্যকারীও একই কথা লিখেছেন।
“ট্রাম্প যদি গ্রিনল্যান্ড নেন, তাহলে চীনেরও উচিত হবে এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে তাইওয়ানকে নিয়ে নেওয়া। ট্রাম্পকে তার কথার বিষয়ে সিরিয়াসই মনে হচ্ছে, এখান থেকে কী ফায়দা নিতে পারি আমাদেরও সেদিকে মনোযোগ দেওয়া দরকার,” বলেছেন ‘হংতু সুমেং’ নাম নিয়ে লেখা ওই মন্তব্যকারী।
সেন্ট্রাল চায়না নরমাল ইউনিভার্সিটির স্কুল অব পলিটিক্স অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের সহযোগী অধ্যাপক শেন ফেই চীনা নিউজ পোর্টাল নেটইজিতে লেখা নিবন্ধে বলেছেন, ট্রাম্পের কাছে গ্রিনল্যান্ড যেমন, ঠিক তেমন-ই তাইওয়ানও চীনের নিরাপত্তা স্বার্থের খুবই গুরুত্বপূর্ণ অংশ।
তবে দুটি ইস্যু পুরোপুরি একও নয়, কেননা ট্রাম্প যা করছেন তা অন্য একটি দেশের সার্বভৌমত্বের জন্য সরাসরি হুমকি, মত ফেইয়ের।
“তাইওয়ান চীনের অন্তর্নিহিত ভূখণ্ড এবং এটি পুরোপুরি চীনের অভ্যন্তরীণ বিষয়। অন্য দেশের সার্বভৌমত্বের সঙ্গে এর কোনো সম্পর্কই নেই,” বলেছেন তিনি।
তবে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক থিঙ্ক ট্যাঙ্ক জার্মান মার্শাল ফান্ডের তাইওয়ান বিশেষজ্ঞ বনি গ্লেসারের মতে, তাইওয়ান নিয়ে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংকে আরও অনেক বিষয় বিবেচনায় নিতে হচ্ছে। বিশেষ করে দেশের সামরিক সক্ষমতা নিয়ে তার মূল্যায়ন এবং তাইওয়ানে বলপ্রয়োগ করলে চীনকে কী ধরনের মূল্য চুকাতে হতে পারে সেগুলোও ভাবতে হচ্ছে।
“গ্রিনল্যান্ড আর তাইওয়ানকে বেইজিং সমান্তরাল চোখে দেখবে কিনা তা নিয়ে সন্দেহ আছে আমার। চীনারা বিশ্বাস করে তাইওয়ান সবসময়ই এবং এখনো চীনেরই অংশ, তারা এর জন্য পয়সা খরচ করবে না এবং তাইওয়ানের কোনো সরকারই নিজেদের ভূখণ্ড বিক্রি করতে রাজিও হবে না,” বলেছেন এ নারী বিশ্লেষক।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের সাবেক এক কর্মকর্তা এবং সিঙ্গাপুরের এস রাজানাথন স্কুল অব ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের জ্যেষ্ঠ ফেলো ড্রিউ থমসন বলছেন, গ্রিনল্যান্ড নিয়ে ট্রাম্পের মন্তব্যে তাইওয়ান ঘিরে চীনের দাবিকে জোরাল করবে এমনটা ভাবা ‘বেশ হাস্যকরই’ হবে।
“ট্রাম্প যদি সত্যিই যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ হাসিল ও সুরক্ষায় সামরিক শক্তির ব্যবহার বাতিল করতে রাজি না হন, তাহলে তার এমন মন্তব্য ও অবস্থান তাইওয়ানের সুরক্ষায় যুক্তরাষ্ট্রকে সামরিক ব্যবস্থা নিতে বাধ্য হতে হয় এমন কোনো পদক্ষেপ নেওয়ার ক্ষেত্রে বেইজিংকে আরও নিরুৎসাহিত করবে বলেই আমি মনে করি,” বলেছেন তিনি।
“চীনের জন্য এটা বেশ শক্তিশালী প্রতিবন্ধক,” ভাষ্য তার।