বছরের পর বছর বাড়তে বাড়তে ২০২৪ সালে তুরস্কের অস্ত্র রপ্তানি পৌঁছেছে রেকর্ড ৭১০ কোটি ডলারে, দশককাল আগেও যা ছিল মাত্র ১৯০ কোটি ডলার।
Published : 17 Mar 2025, 07:04 PM
তুরস্ক সবসময় তার প্রতিরক্ষাকে অগ্রাধিকার তালিকায় শীর্ষেই রেখেছে; শুরুর দিকে অন্যদের কাছ থেকে অস্ত্র কিনে চাহিদা মেটালেও এখন আর তার দরকার পড়ছে না। উল্টো বিশ্বের অনেক দেশেরই চোখ এখন আঙ্কারার বানানো কিছু যুদ্ধাস্ত্রের দিকে।
নেটোর দ্বিতীয় সর্ববৃহৎ সৈন্যবাহিনী এখন অস্ত্র রপ্তানিতে স্বতন্ত্র জায়গা করে নিয়েছে, ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যের বাজারে তার কিছু আইকনিক পণ্যের চাহিদাও ব্যাপক।
বছরের পর বছর বাড়তে বাড়তে ২০২৪ সালে তুরস্কের অস্ত্র রপ্তানি পৌঁছেছে রেকর্ড ৭১০ কোটি ডলারে, দশককাল আগেও যা ছিল মাত্র ১৯০ কোটি ডলার।
এই অগ্রযাত্রার নেপথ্যে কী? তুরস্কের সক্ষমতাই বা কতটুকু? কেনইবা এগুলো গুরুত্বপূর্ণ— এক প্রতিবেদনে সংক্ষিপ্ত আকারে সেসবই তুলে আনার চেষ্টা করেছে আল জাজিরা।
দেশে অস্ত্র উৎপাদনে আগ্রহ
অনেকদিন ধরেই সামরিক খাতে স্বনির্ভর হতে চাইছে পশ্চিম এশিয়ার এ দেশটি, যার ধারাবাহিকতায় ১৯৮৫ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় প্রতিরক্ষা খাত উন্নয়ন ও সহায়তা প্রশাসন কার্যালয়- সাগেব।
শুরুর দিকে অনেকগুলো বছর সাগেবের নজর ছিল গবেষণা ও অস্ত্র আধুনিকায়নে আন্তর্জাতিক সহযোগিতায়। কিন্তু নানা সময়ে অস্ত্র কেনায় নানান বিধিনিষেধ, কোথায় ব্যবহার করা যাবে, কোথায় না—এসব কারণে দেশটি স্থানীয়ভাবে উৎপাদনে মনোযোগ সরিয়ে আনে।
২০১০-এর দশকে তারা স্থানীয় নকশার দিকেও গুরুত্বারোপ শুরু করে, একই সময়ে তাদের নিজস্ব প্রতিরক্ষা সরঞ্জামের উৎপাদনও ব্যাপক বাড়তে থাকে।
এখন তুরস্কের প্রতিরক্ষা খাতের কয়েক হাজার উৎপাদক ভূমি, আকাশ ও নৌপথে কার্যকর অস্ত্র ও সরঞ্জাম বানাতে সক্ষম, যাদের স্বীকৃতি মিলছে আন্তর্জাতিক ক্রেতাদের কাছ থেকেও।
তুর্কি ড্রোনের কথা জানেন?
যুদ্ধাস্ত্র নিয়ে যাদের বিন্দুমাত্র আগ্রহ আছে, তারা নিশ্চয়ই বায়রাকতার টিবিটু-র নাম শুনেছেন। ২০১৪ সালে প্রথম মোতায়েন হওয়া মনুষ্যবিহীন এই উড়ন্ত যান বা ড্রোন এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি বিক্রি হওয়া তুর্কি প্রতিরক্ষা পণ্য।
মাঝারি উচ্চতায় উড়তে সক্ষম, দীর্ঘস্থায়ী, ২০০ কেজি ওজন বহনে সক্ষম আনকা-এস এবং ৭০ কেজি ওজন বহনে সক্ষম ভেস্তেল কারায়েল ড্রোনের মতো আরও কয়েকটি উড়ন্ত যানের চাহিদাও ব্যাপক।
আকাশপথে আসা হুমকি শনাক্ত ও নিস্ক্রিয় করতে সক্ষম এমন—কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন এমন প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাপনা ‘স্টিল ডোম’ বানাতেও কাজ করছে রিসেপ তায়িপ এরদোয়ানের দেশ।
কাজ চলছে দেশে বানানো প্রথম পঞ্চম প্রজন্মের যুদ্ধবিমান ‘কান’ বানানোরও, যা পুরনো মার্কিন এফ-সিক্সটিনের স্থলাভিষিক্ত হবে, সক্ষমতা বাড়াবে তুর্কি বিমান বাহিনীর।
ভাণ্ডারে আরও যা যা আছে
তুরস্কের সাঁজোয়া যান নিয়েও অনেকের আগ্রহ আছে। এর মধ্যে মূল যুদ্ধ ট্যাঙ্ক আলতাই বানানোই হয়েছে জার্মানির লেপার্ড ও মার্কিন আব্রামকে টক্কর দিতে।
তুর্কি সেনাবাহিনীর একটি মাইন-প্রতিরোধী যানও আছে, কিরপি, বিদ্রোহ দমন অভিযানে এটি ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়। আঙ্কারার ভাণ্ডারে আরও আছে কাপলান ও পারসের মতো অত্যাধুনিক পদাতিক যুদ্ধযান।
তুরস্কের জন্য নতুন নৌযান বানানোর লক্ষ্যে ২০০৪ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ন্যাশনাল শিপ প্রজেক্ট- মিলগেম। এর হাত ধরেই তুরস্ক বানিয়েছে আডা-শ্রেণির করভেটস ও ইস্তাম্বুল-শ্রেণির ফ্রিগেটস। আরও অত্যাধুনিক যুদ্ধজাহাজ ও ডুবোজাহাজ বানানোর পরিকল্পনাও আছে তাদের।
তুরস্কের কাছে যেসব নৌযান আছে তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয় হচ্ছে ড্রোনবাহী উভচর যান টিসিজি আনাদোলু, এটিই তুর্কি নৌবাহিনীর সবচেয়ে বড় জাহাজ, মোতায়েন হয়েছে ২০২৩ সালে।
আন্তর্জাতিক বাজারে যেসব তুর্কি যুদ্ধাস্ত্র ও সরঞ্জামের চাহিদা রয়েছে, তার দীর্ঘ তালিকায় আরও আছে অত্যাধুনিক গোলাবারুদ, বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাপনা, স্বল্প পাল্লার ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র বোরা ও দীর্ঘপাল্লার আতমাকা ক্ষেপণাস্ত্র।
যুদ্ধাস্ত্র উৎপাদনে কেন ঝুঁকতে হলো?
মূলত ‘অভ্যন্তরীণ বিষয়ে’ বিদেশি হস্তক্ষেপই আঙ্কারাকে দেশে সামরিক সরঞ্জাম বানাতে উদ্দীপ্ত করেছে।
১৯৭০ এর দশকের মাঝামাঝি সাইপ্রাসে তুরস্কের হস্তক্ষেপ ঘিরে যুক্তরাষ্ট্র আঙ্কারার ওপর অস্ত্র নিষেধাজ্ঞা দেয়।
১৯৯০ এর দশকের শুরুর দিকে জার্মানি দেশটিতে অস্ত্র রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। কারণ? তুরস্কের কাছে তারা যেসব সাঁজোয়া যান বিক্রি করেছে সেগুলো আঙ্কারা দেশের ভেতরে ব্যবহার করেছে; অথচ বিক্রির চুক্তিতে স্পষ্টভাষায় লেখা ছিল—এসব সাঁজোয়া যান কেবল তখনই ব্যবহার করা যাবে যখন তুরস্ক নেটোভুক্ত নয় এমন কোনো দেশ দ্বারা আক্রান্ত হবে।
এরপর যুক্তরাষ্ট্র ২০২০ সালের দিকেও তুরস্কের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে, রাশিয়ার এস-৪০০ বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাপনা কেনায়। ততদিনে অবশ্য আঙ্কারা অস্ত্র উৎপাদনকারী দেশ হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করে ফেলেছে।
এখন তুরস্কজুড়ে প্রায় তিন হাজার অস্ত্র নির্মাতা কোম্পানি আছে।
রপ্তানি বাজারে অবস্থান
গত কয়েক বছরে তুরস্কের অস্ত্র রপ্তানি বেড়ে এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে তাদের কব্জায় এখন বৈশ্বিক অস্ত্র রপ্তানির ১ দশমিক ৭ ভাগ। ২০২০ থেকে শুরু করে ২০২৪ সাল পর্যন্ত দেশটি বিশ্বের প্রতিরক্ষা রপ্তানিকারকদের তালিকায় একাদশ স্থানেই আছে, বলছে স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্চ ইনস্টিটিউট (সিপ্রি)।
পর্যবেক্ষকদের তথ্য অনুযায়ী, গত বছর তুরস্কের রপ্তানি করা অস্ত্র পৌঁছেছে ১৭৮টি দেশে; যা ২০১৫-২০১৯ সালের তুলনায় ১০৩ শতাংশ বেড়েছে।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে তুরস্কের অস্ত্রের প্রধান ক্রেতা সংযুক্ত আরব আমিরাত, পাকিস্তান ও কাতার, বলছে সিপ্রি।
দেশটির সমরাস্ত্রের মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয়—স্বল্প উচ্চতায় উড়তে সক্ষম দীর্ঘস্থায়ী বায়রাকতার ইরাক, ইউক্রেইন, কেনিয়া, বাংলাদেশ, জাপানসহ ৩১টি দেশে রপ্তানি হচ্ছে বলে খবর পাওয়া গেছে।
এই ড্রোনের উৎপাদক বায়কার গত বছর নিজস্ব জেট ইঞ্জিন বানাতে ৩০ কোটি ডলার বিনিয়োগের ঘোষণা দিয়েছে। তাদের লক্ষ্য হচ্ছে- তাদের আকিনচি ড্রোনের জন্য স্থানীয় ইঞ্জিন এবং এখনও নির্মাণাধীন মনুষ্যবিহীন ড্রোন যুদ্ধবিমান কিজিলেলমার জন্য টার্বোফ্যান ইঞ্জিন বানানো। এতদিন উভয় যানের ক্ষেত্রেই তারা ইউক্রেইনের ইঞ্জিন ব্যবহার করেছে।