কারাগারটিতে কাউকে না পাওয়া আরেকটি ভয়ঙ্কর সম্ভাবনার দিকে ইঙ্গিত করে। আর সেটি হচ্ছে, ধারণার চেয়ে অনেক বেশি মানুষকে এখানে হয়ত হত্যা এবং তাদের লাশ গুম করা হয়েছে।
Published : 10 Dec 2024, 10:52 AM
কারাগারের অন্ধকারে তিন দশকের বেশি সময়, কখনো আর পৃথিবীর আলো-বাতাস দেখবেন, সে আশা ছেড়েই দিয়েছিলেন।
কিন্তু অভাবনীয় এক পরিবর্তনে ৩৩ বছর পর সিরিয়ার কুখ্যাত কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে নিজ দেশ লেবাননে ফিরেছেন সুহেইল হামাউই।
সিএনএন জানিয়েছে, লেবাননের চেকা গ্রামে সুহেইল ফিরে এলে তাকে জানানো হয় উষ্ণ স্বাগতম।
মাত্র ১২ দিনের মাথায় সিরিয়ান বিদ্রোহীরা গত রোববার রাজধানী দামেস্কের দখল নিলে প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদের দুই যুগের শাসনের অবসান ঘটে।
ওইদিনই বিদ্রোহীরা স্বৈরশাসক বাশারের অনেক কারাগার থেকে বন্দিদের মুক্ত করে দেয় বিদ্রোহীরা। অনেকের সাথে মুক্তি পান ৬১ বছর বয়সী সুহেইলও।
“দারুন এক অনুভূতি, সত্যিই দারুন অনুভূতি। দেখছি, এখানে এখনো অনেক ভালোবাসা আছে, আমার পরিবারও এখানে আছে,” নিজের গ্রামে ফেরার পর এভাবেই নিচেজর অনুভূতি প্রকাশ করেন সুহেইল।
সুহেইলের যমজ নিকোলাস হামাউই ফিরে আসা ভাইকে ‘নায়কের চেয়েও বেশি’ উল্লেখ করে বলেন, তারা ফিরে আসাটা ‘পুনর্জন্মের’ মতো।
“ত্রেত্রিশটা বছর হারিয়ে গেছে কিন্তু মনে হচ্ছে আমরা যমজ হিসেবে পুনর্জন্ম লাভ করেছি। যেকোনো দিক থেকেই এটি পুনর্জন্ম,” বলছিলেন নিকোলাস।
ঘরে ফেরার পর সুহেইলও বুঝতে পারছিলেন সত্যিকার অর্থেই কতগুলো বছর হারিয়ে গেছে।
সুহেইল বলেন, “আমার নাতি-নাতনি আছে। কিন্তু আমার ছেলের কন্যাটি আমাকে দাদা বলে ডাক না দেওয়া পর্যন্ত বয়স টেরই পাইনি। তখনই বুঝতে পারলাম, আসলেই লম্বা একটা সময় জীবন থেকে হারিয়ে গেছে।”
ভয়াবহ নির্যাতনের স্মারক কুখ্যাত সেদনায়া কারাগার
বাশার আল-আসাদের পতনের পর সিরিয়ার রাজধানী দামেস্কের উপকণ্ঠে কুখ্যাত সেদনায়া বন্দিশালার সুড়ঙ্গে সুড়ঙ্গে বন্দিদের অনুসন্ধান চালানো হয়েছে। সিরিয়ার নাগরিক সুরক্ষা গোষ্ঠী হোয়াইট হেলমেটস জরুরি বিশেষজ্ঞ দল পাঠিয়ে এই অনুসন্ধান কাজ করে।
সেদনায়া কারাগারের মাটির নিচের বিভিন্ন কুঠুরিতে বন্দিরা থাকতে পারে এমন খবরে সেখানে বহু মানুষ বন্দিশালার বাইরে ভিড় করে।
সিএনএন জানিয়েছে, অনুসন্ধানের খবরে সেদনায়া কারাগারমুখী যানবাহনের লাইন কয়েক মাইল ছাড়িয়ে যায়। লাইনের শেষ মাথায় গাড়ি রেখে অনেককেই একটি পাহাড়ের দিকে হাঁটতে দেখা গেছে, যে জায়গাটি নির্বিচার আটক, নির্যাতন আর হত্যার সমার্থক হয়ে উঠেছে।
বাশারের শাসনকালে আটক কয়েক হাজার বন্দি এখনো সেদনায়া কারাগারের ‘রেড সেকশন’ নামের ভূগর্ভস্থ সেলে আটকে আছে, এমন খবর পেয়েই মানুষজন ভিড় করতে শুরু করে ওই এলাকায়।
তিন ভাই আর জামাতার খোঁজে দক্ষিণের শহর দেরা থেকে সেদনায়া কারাগারের কাছে হাজির হয়েছেন মেসুন লাবুত। সেখানকার পরিস্থিতিতে আবেগতাড়িত এই নারী যেন নিঃশ্বাসও ভুলে যাচ্ছিলেন।
“কারাগারের রেড সেকশনে পৌঁছাতে তারা (উদ্ধারকর্মীরা) কয়েকদিন ধরেই চেষ্টা করছে। সেখানে কোনো অক্সিজেন নেই, কারণ বাতাস চলাচলের জায়গাও নেই। শেষ পর্যন্ত তারা মারাও যেতে পারে। আল্লাহ তাদের সহায় হোন,” বলেন মেসুন।
হঠাৎই কারাগারের ‘আল্লাহু আকবার’ ধ্বনি আর ফাঁকা গুলি ছুড়ে কারাগারের দিকে ছুটতে দেখা যায় জনতার ভিড়কে। তবে কি রেড সেকশনে ঢোকার পথ মিলল? একজন পুরুষ ও নারীকে সেদিকে ছুটতে দেখা যায়। নারীর মুখে ছিল ‘ইয়া রব, ইয়া রব’ ধ্বনি।
তবে আশাহত হয়ে হয়েছে জনতাকে।
সেদনায়া কারাগারের ভেতরে রেড সেকশনে ঢোকার পথ বের করতে হোয়াইট হেলমেটের কর্মী ক্রমাগত ড্রিল আর হাতুড়ি চালিয়ে যাচ্ছিলেন কংক্রিটের শক্ত গাঁথুনির ওপর। শিকারী কুকুরও ছিল তাদের সঙ্গে। কিন্তু কোনো পথের সন্ধান মেলেনি।
অনুসন্ধান কর্যক্রম সমাপ্ত ঘোষণা করে হোয়াইট হেলমেট এক বিবৃতিতে জানায়, কারাগারে ‘কোনো গোপন কুঠুরি কিংবা বেজমেন্ট থাকার প্রমাণ পাওয়া যায়নি’।
হারিয়ে যাওয়া স্বজনদের সূত্র খুঁজতে জনতার একটি অংশ কারাগারের আরেকটি অংশে ঘুরছিলেন। সেখানে পতিত সরকারের সময়ের নথিপত্রের স্তূপ আঁতিপাতি করছিলেন তারা।
সেদনায়া কারাগারে আটক হাজার হাজার সিরীয় পরে গুমের শিকার হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে, যারা ‘কসাইখানা’ নামের এই কারাগারের অতল গহ্বরে হারিয়ে গেছে বলে মনে করা হয়।
একজন মানুষকে ক্ষতায় রাখার জন্য যথেচ্ছ আটক আর নিষ্ঠুর নির্যাতনের প্রতীক হয়ে উঠেছিল এই সেদনায়া কারাগার।
এক নারী তার ভাইয়ের ছবি হাতে কারাগারের বাইরে অপেক্ষায় ছিলেন। ভাইয়ের ছবিটি ১২ বছর আগে তোলা। তার বয়স এখন হতে পারে ৪২ বছরের মতো। ভাইয়ের ভাগ্যে কী ঘটেছে, তা জানতে পারেননি ওই নারী।
“সে বেঁচে আছে নাকি মারা গেছে, আমরা শুধু সেটা নিশ্চিত হতে চাই। ঈশ্বর জানে।”
সেদনায়ায় গুম হওয়া ব্যক্তিদের পরিবারের প্রতিনিধিত্ব করছে এমন একটি দল দাবি করেছে, কারাগারে এখনো অনেকে আটকা আছে বলে যে গুজব ছড়িয়েছে, সেটি হয়ত আসলেই গুজব।
তবে কারাগারটিতে কাউকে না পাওয়া আরেকটি ভয়ঙ্কর সম্ভাবনার দিকে ইঙ্গিত করে। আর সেটি হচ্ছে, ধারণার চেয়ে অনেক বেশি মানুষকে এখানে হয়ত হত্যা এবং তাদের লাশ গুম করা হয়েছে।