সরকারের অভিবাসন নীতির সমালোচনা করে বরখাস্ত লিনেকারকে ঘিরে বিবিসিতে অস্থিরতা

সাবেক এ তারকা ফুটবলারের প্রতি সমর্থন জানিয়ে অন্য উপস্থাপক ও ভাষ্যকারদের ওয়াক আউটে শনিবার নিয়মিত প্রোগ্রাম ‘ম্যাচ অব দ্য ডে’-র সম্প্রচারে ব্যাঘাত ঘটে।

নিউজ ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 12 March 2023, 06:18 AM
Updated : 12 March 2023, 06:18 AM

যুক্তরাজ্য সরকারের বিতর্কিত অভিবাসন নীতি নিয়ে সমালোচনার করা গ্যারি লিনেকারকে বরখাস্ত করে ভেতরে-বাইরে ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়েছে বিবিসি।

ফুটবল খেলা নিয়ে বিবিসি ওয়ানের আয়োজন ‘ম্যাচ অব দ্য ডে’-র হোস্ট সাবেক তারকা ফুটবলার লিনেকারকে শুক্রবার দায়িত্ব থেকে সরে যেতে বলে ব্রিটিশ গণমাধ্যমটি।

মূল উপস্থাপক না থাকার পাশাপাশি তার প্রতি সমর্থন জানিয়ে অন্য উপস্থাপক ও ভাষ্যকারদের ওয়াক আউটের কারণে শনিবার নিয়মিত ওই প্রোগ্রামে ব্যাঘাত ঘটে।

এর জন্য বিবিসির মহাপরিচালক টিম ডেভি লাইসেন্স ফি দেওয়া দর্শকদের কাছে ক্ষমাও চেয়েছেন বলে গণমাধ্যমটির এক প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে।

সরকারের চাপে লিনেকারকে বরখাস্ত করার কথাও অস্বীকার করেছেন ডেভি। 

শনিবার রাতে নির্ধারিত সময়ে ‘ম্যাচ অব দ্য ডে’ শুরু হলেও সেটি চলে মাত্র ২০ মিনিট। ছিল না কোনো কথোপকথন, বিশ্লেষণ নিয়ে হাজির হননি অ্যালান শিয়ারার বা ইয়ান রাইট, তাদের পরিবর্তে অন্য কাউকে দেখাও যায়নি।

শোনা যায়নি বিখ্যাত সূচনা সঙ্গীত, পর্দায় দেখা যায়নি ওপেনিং ক্রেডিটও। অনুষ্ঠান শুরু হয় ‘প্রিমিয়ার লীগ হাইলাইটস’ লেখা দিয়ে, এরপর সরাসরি নিয়ে যাওয়া হয় বোর্নমাউথ ও লিভারপুলের খেলার অংশবিশেষে।

লিনেকারকে বরখাস্ত করা নিয়ে ব্রিটিশ গণমাধ্যমটি যে ‘কঠিন সময়’ পার করছে তা স্বীকার নিয়ে এর মহাপরিচালক বলেন, “পরিস্থিতি ঠিক করতে চেষ্টা করছি আমরা।”

বিবিসি নিউজকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে ডেভি আরও বলেন, গ্যারি লিনেকারকে পর্দায় ফেরানোই হবে তার সফলতা।

সাবেক এই তারকা ফুটবলারের মতো ফ্রিল্যান্স কর্মীদের রাজনৈতিক পক্ষপাতজনিত নিয়মকানুন পর্যালোচনায় প্রস্তুতির কথাও জানিয়েছেন তিনি।

চাপের কাছে নতি স্বীকার করে পদত্যাগ করবেন না বলেও জানান বিবিসির এই মহাপরিচালক।

ডাউনিং স্ট্রিট ও সরকারবিরোধী টুইটে ক্ষিপ্ত মন্ত্রীদের চাপের মুখে নতি স্বীকার করে বিবিসির নির্বাহীরা লিনেকারকে সরিয়ে দিয়েছেন বলে বিরোধী দলগুলোর অভিযোগ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, তার প্রতিষ্ঠান কোনো রাজনৈতিক দলকে খুশি করতে কাজ করে না।

মঙ্গলবার টুইটারে লিনেকার সরকারের অবৈধ অভিবাসন বিলকে ‘অত্যন্ত নির্দয়’ অ্যাখ্যা দিয়ে গত শতকের ৩০ এর দশকে জার্মানিতে দেখা যাওয়া নীতির সঙ্গে এর কোনো পার্থক্য নেই বলে মন্তব্য করেন।

শুক্রবার তাকে বরখাস্ত করার পর বিবিসির নিরপেক্ষতা, সরকারের অভিবাসন নীতি ও বিবিসির চেয়ারম্যান রিচার্ড শার্পের অবস্থান ঘিরে বিতর্ক তুঙ্গে উঠে।

লিনেকারের প্রতি সমর্থন জানিয়ে অনেকেই অনুষ্ঠান না করার ও চাকরি ছাড়ার ঘোষণা দিলে কেবল ‘ম্যাচ অব দ্য ডে’-ই নয়, আরও অনেক অনুষ্ঠানও বিপাকে পড়ে।

ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনাক লিনেকারকে ‘মেধাবী উপস্থাপক’ অ্যাখ্যা দিয়ে শনিবার সন্ধ্যায় এক বিবৃতিতে বলেছেন, বিবিসির অভ্যন্তরীণ ঝামেলায় সরকারের হাত নেই।

“সবাই আমার সব ব্যাপারে সবসময় একমত হবে না, বিষয়টিকে আমি শ্রদ্ধার দৃষ্টিতেই দেখি। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে, যেটা সঠিক বলে মনে করছি, সেটাই করতে হবে আমাকে। এ কারণেই (ইংলিশ চ্যানেল পাড়ি দিয়ে আসা অবৈধ) নৌকা থামাতে আমি দ্ব্যর্থহীনভাবে বলে যাচ্ছি।

“গ্যারি লিনেকার অসাধারণ ফুটবলার ছিলেন, এখন মেধাবী উপস্থাপক। আমার বিশ্বাস, গ্যারি লিনেকার ও বিবিসির মধ্যে এখন যে পরিস্থিতি চলছে, তা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মিটে যাবে। কিন্তু এটা তাদের ব্যাপার, সরকারের নয়,” বলেছেন তিনি। 

সরকারের সংস্কৃতি, গণমাধ্যম ও খেলাধুলা দপ্তরের এক মুখপাত্রও ‘বিষয়টি একান্তই বিবিসির’ বলে মন্তব্য করেছেন। 

তবে কয়েকদিন আগে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সুয়েলা ব্রাভারম্যান ও সংস্কৃতি মন্ত্রী লুসি ফ্রেজার অভিবাসন নীতি বিষয়ক বিলে তাদের ভাষার সঙ্গে নাৎসি জার্মানির তুলনা করায় লিনেকারকে একহাত নিয়েছিলেন। 

লেবার পার্টির নেতা কিয়ের স্টার্মারসহ দলটির একাধিক লিনেকারের প্রতি সমর্থন ব্যক্ত করেছেন।

স্টার্মার বলেছেন, সরকারের উচিত লিনেকারের দিকে ‘তোপ না দেগে’ অভিবাসন ব্যবস্থাপনা ঠিক করায় মনোযোগী হওয়া।

বিবিসির কর্মকর্তারা সরকারের চাপে মাথা নত করেছে বলেও তিনি অভিযোগ করেন।  

লিবারেল ডেমোক্রেটিক নেতা এড ডেভি বিবিসি চেয়ারম্যান শার্পের পদত্যাগ দাবি করে বলেছেন, লিনেকারকে ঘিরে বিতর্কে বিবিসির ‘শীর্ষ কর্মকর্তাদের ব্যর্থতা’ উন্মোচিত হয়ে গেছে।

“আমরা বিবিসিতে এমন নেতৃত্ব চাই, যারা আমাদের গর্বিত ব্রিটিশ মূল্যবোধকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরতে এবং আজকের ক্রমশ অশান্ত রাজনীতি ও রক্ষণশীল গুণ্ডামিমার্কা কৌশল প্রতিহত করতে পারবে,” বলেছেন তিনি।

শনিবার বিবিসির সাবেক মহাপরিচালক গ্রেগ ডাইকও লিনেকার বিতর্কে ব্রিটিশ গণমাধ্যমটির সমালোচনা করেছেন। বলেছেন, এর মাধ্যমে বিবিসি নিজেই তার ‘বিশ্বাসযোগ্যতাকে ক্ষুণ্ন করেছে’।

“লিনেকারকে সরিয়ে দেওয়ার পদক্ষেপ এমন এক চিত্র হাজির করতে পারে, যাতে মনে হতে পারে, ‘বিবিসি সরকারের চাপে নতি স্বীকার করেছে’,” বলেছেন তিনি।

১৯৯৯ সাল থেকে ‘ম্যাচ অব দ্য ডে’ উপস্থাপনা করে আসা লিনেকার বিবিসির সর্বোচ্চ বেতনভোগী কর্মীদের একজন। কেবল ২০২০-২১ মৌসুমেই তিনি সাড়ে ১৩ লাখ পাউন্ড বেতন নিয়েছেন। তিনি ফ্রিল্যান্স ভিত্তিতে বিবিসিতে কাজ করতেন।

বিবিসির কর্মীদেরকে তাদের প্রতিষ্ঠানের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম নির্দেশনা কঠোরভাবে মেনে চলতে হয়, তবে এই নির্দেশনা ফ্রিল্যান্স কর্মীদের ক্ষেত্রে কীভাবে খাটবে তা নিয়ে দীর্ঘদিন ধরেই বিতর্ক চলছে।

লিনেকার এখন পর্যন্ত এ বিষয়ে প্রকাশ্যে কোনো মন্তব্য করেন। শনিবার তাকে মাঠে বসে লিচেস্টার সিটির খেলা দেখতে দেখা গেছে।