দেশটির উত্তরপশ্চিমাঞ্চলীয় সাগাইং এলাকায় সরকারি বাহিনীর চালানো বিমান হামলায় শিশুসহ প্রায় ১০০ জন নিহত হন।
Published : 12 Apr 2023, 05:25 PM
মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী চলতি সপ্তাহে একটি গ্রামে বিদ্রোহীদের আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে প্রাণঘাতী হামলা চালানোর কথা স্বীকার করে ওই হামলায় বেসামরিক নিহতের দায় সামরিক শাসনবিরোধী বিদ্রোহীদের ওপর চাপিয়েছে।
তারা বলছে, ওই হামলায় বেসামরিকরা যদি মারা গিয়েও থাকে, তার কারণ তারা বাধ্য হয়ে সন্ত্রাসীদের সহায়তা করছিল।
মঙ্গলবার দেশটির উত্তরপশ্চিমাঞ্চলীয় সাগাইং এলাকায় এই বিমান হামলায় চালানো হয়, এতে শিশুসহ প্রায় ১০০ জন নিহত হয়েছেন বলে বিভিন্ন গণমাধ্যমের প্রতিবেদনের বরাত দিয়ে জানিয়েছে বার্তা সংস্থা রয়টার্স।
প্রাণহানির এই সংখ্যাই হামলাটিকে সম্প্রতি মিয়ানমার সেনাবাহিনীর একের পর চালানো বিমান হামলার মধ্যে সবচেয়ে প্রাণঘাতী হামলায় পরিণত করেছে।
২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে হওয়া এক সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে নোবেল শান্তি পুরস্কারজয়ী অং সান সু চি নেতৃত্বাধীন বেসামরিক সরকারকে হটিয়ে ক্ষমতা দখল করে দেশটির সামরিক বাহিনী। এতে দেশটিতে এক দশক ধরে চলা গণতান্ত্রিক সংস্কারের অবসান ঘটে। এরপর থেকে টালমাটাল সময় পার করছে মিয়ানমার ।
সামরিক শাসনবিরোধীদের অনেকেই হাতে অস্ত্র তুলে নিয়েছেন, জাতিগত সংখ্যালঘু সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে ঐক্যবদ্ধ হয়েছেন তারা। এর পাল্টায় সামরিক বাহিনীও বিমান হামলা ও ভারি অস্ত্রশস্ত্র দিয়ে আঘাত হানছে। কখনো কখনো বেসামরিক এলাকায়ও তাদের হামলা হচ্ছে।
জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস সাগাইংয়ে বিমান হামলার নিন্দা জানিয়ে দায়ীদের জবাবদিহিতার আওতায় আনার আহ্বান জানিয়েছেন।
“মিয়ানমারজুড়ে লোকজনের ওপর সহিংস অভিযান বন্ধে সামরিক বাহিনীর প্রতি আহ্বানও পুনর্ব্যক্ত করেছেন তিনি,” বলেছেন তার মুখপাত্র।
মঙ্গলবার সামরিক বাহিনী নিয়ন্ত্রিত সম্প্রচারমাধ্যম মায়াবতী টিভিতে জান্তার মুখপাত্র জ মিন তুন বলেছেন, “সরকারবিরোধী ন্যাশনাল ইউনিটি গভর্নমেন্টের (এনইউজি) আয়োজিত ওই অনুষ্ঠানে হামলা হয়েছে তাদের সশস্ত্র পিপলস ডিফেন্স ফোর্সের (পিডিএফ) জন্য, ওই অঞ্চলে শান্তি ও স্থিতিশীলতা পুনরুদ্ধারের লক্ষ্যে এই হামলা হয়েছে।”
হামলার পর পিডিএফ এক সদস্য বলেছিলেন, তাদের স্থানীয় একটি দপ্তরের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে জান্তার ওই বিমান হামলাটি হয়।
“উদ্বোধনী অনুষ্ঠান চলাকালে আমরা ওই হামলাটি চালিয়েছিলাম। পিডিএফের সদস্যরা নিহত হয়েছে। তারা দেশের সরকারের, দেশের জনগণের বিরোধিতা করছে। মাঠ পর্যায় থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, আমরা তাদের অস্ত্রের গুদামে হামলা চালিয়েছি, হামলার পর যা বিস্ফোরিত হয়, যে কারণে লোকজন মারা গেছে,” বলেছেন জ মিন তুন।
বেসামরিক হতাহতের প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “তাদেরকে (বিদ্রোহী) সহায়তায় বাধ্য হওয়া কিছু লোকও সম্ভবত মারা গেছে।”
হামলায় নিজেদের সদস্য নিহত হলেও, পিডিএফ ‘বেসামরিক মরেছে বলে দাবি জানিয়েছে’ অভিযোগ করে জ মিন তুন বলেন, ছবিতেই দেখা যাচ্ছে সাগাইংয়ে হামলায় নিহতদের কারও কারও গায়ে সামরিক পোশাক, কারও গায়ে বেসামরিক পোশাক।
পিডিএফ সদস্যদের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ তুলে যেসব এলাকার লোকজন তাদের সমর্থন দিচ্ছে না সেখানে তারা ‘বৌদ্ধ সন্ন্যাসী, শিক্ষক ও নিরীহ বাসিন্দাদের’ হত্যা করছে বলেও দাবি করেন জান্তার এ মুখপাত্র।
জ মিন তুনের বক্তব্য ব্যাপকভাবে গণমাধ্যমে আসার আগেই সাগাইংয়ে হামলার নিন্দা জানিয়ে জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক প্রধান ভলকার তুর্ক বলেন, “হতাহতদের মধ্যে নৃত্য প্রদর্শন করা স্কুল শিক্ষার্থী ও অন্যান্য বেসামরিকরাও আছে বলেই প্রতীয়মান হচ্ছে।”
সামরিক বাহিনীর এই হামলায় ৮০ থেকে ১০০ জন নিহত হয়েছে বলে ওই অঞ্চলের বাসিন্দাদের উদ্ধৃত করে জানিয়েছে বিবিসি বার্মিজ, রেডিও ফ্রি এশিয়া বার্মিজ ও ইরাবতী নিউজ পোর্টাল।
আর পিডিএফের এক সদস্যের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ১৬ শিশুসহ প্রায় ১০০টি মৃতদেহ দাহ করা হয়েছে।
“নিহতের সঠিক সংখ্যা এখনও অস্পষ্ট। বিভিন্ন স্থানে শরীরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে,” বলেছেন নাম-পরিচয় অজানা রাখতে চাওয়া ওই পিডিএফ সদস্য।
মিয়ানমারের জান্তাবিরোধী যোদ্ধাদের হালকা অস্ত্রশস্ত্র বিমান বাহিনীর বিরুদ্ধে কার্যকর কোনো প্রতিরোধ গড়তেই সক্ষম নয়।
গত বছরের অক্টোবরে দেশটির উত্তরের কাচিন রাজ্যে একটি কনসার্টে সামরিক জঙ্গিবিমানের হামলা অন্তত ৫০ বেসামরিক, গায়ক ও একটি জাতিগত সংখ্যালঘু সশস্ত্র গোষ্ঠীর সদস্যদের প্রাণ কেড়ে নিয়েছিল।
এনইউজি-র মুখপাত্র কেয়াও জ বলেছেন, মঙ্গলবার গ্রামবাসীদের ওপর জঙ্গিবিমান থেকে ফেলা বোমা ও এরপর হেলিকপ্টার থেকে গুলিবর্ষণে ১০০-র কাছাকাছি লোক নিহত হয়েছে তাদের ধারণা।
এই হামলাকে মিয়ানমারের ‘সামরিক বাহিনীর আরেকটি কাণ্ডজ্ঞানহীন, বর্বর ও নির্মম আক্রমণ’ বলেও অভিহিত করেছেন তিনি।
এদিকে বেসামরিকদের ওপর বর্বরতা চালানোর অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করে সামরিক বাহিনী বলছে, তারা দেশকে অস্থিতিশীল করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ‘সন্ত্রাসীদের’ বিরুদ্ধে লড়ছে।
বিগত ৬০ বছরের বেশিরভাগ সময়জুড়ে মিয়ানমার শাসন করা সামরিক বাহিনীর ভাষ্য হচ্ছে, তারাই একমাত্র প্রতিষ্ঠান, বৈচিত্রময় এ দেশকে যারা এক রাখতে সক্ষম।
অভ্যুত্থানের পরপরই আটক সু চি এখন বিভিন্ন অপরাধের দায়ে সামরিক আদালতের দেওয়া ৩৩ বছর কারাদণ্ডের রায় ভোগ করছেন। ৭৭ বছর বয়সী এই রাজনীতিক তার বিরুদ্ধে আনা সব অভিযোগ অস্বীকার করছেন। কিছুদিন আগে জান্তা সু চির দলকে বিলুপ্তও ঘোষণা করেছে।
আরও পড়ুন: