ইসরায়েল গাজার উত্তরের বাসিন্দাদের দক্ষিণে সরে যাওয়ার নির্দেশ এরই মধ্যে দিয়েছে। ইসরায়েলের সামরিক অভিযানের পরবর্তী ধাপ যে আসন্ন, এ তারই লক্ষণ।
Published : 13 Oct 2023, 11:56 PM
ইসরায়েল গাজায় স্থল অভিযানের প্রস্তুতি নিচ্ছে বলেই প্রতীয়মান হচ্ছে। উত্তর গাজার ১১ লাখ অধিবাসীকে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে দক্ষিণে সরে যেতে বলেছে ইসরায়েল।
আর এ সময়ের মধ্যে গাজা সীমান্তে হাজার হাজার সেনা, টাংক এবং গোলাবারুদ জড়ো করছে ইসরায়েল। তবে গাজার ঘনবসতিপূর্ণ শহুরে এলাকাগুলোতে স্থল বাহিনী পাঠিয়ে অভিযান চালানোয় পুরোদস্তুর ঝুঁকি আছে।
তাছাড়া, সম্ভাব্য এই স্থল অভিযান চালানোর সম্ভাবনা কতটুকু, সেটি এখনও স্পষ্ট নয়। স্থল হামলা হলে তা কতদূর গড়াতে পারে এবং কতদিন চলতে পারে তা বিশ্লেষণ করে দেখার চেষ্টা করেছে বিবিসি।
কখন হতে পারে এই অভিযান?
স্থল অভিযান চালানোর জন্য যে ছক কষা প্রয়োজন তা শুরু হয়ে গেছে।
ইসরায়েল ডিফেন্স ফোর্সেস (আইডিএফ) এর প্রবীণ সদস্য এবং গাজায় এর আগে বিভিন্ন অভিযান পরিচালনাকারী মেজর জেনারেল অ্যামোস গিলিড বলেছেন, পরবর্তী পদক্ষেপের বিষয়ে জনগণের সমর্থন পেতে একটি ঐক্য সরকার গড়া ইসরায়েলের প্রথম কাজ।
ইসরায়েলে এরই মধ্যে মার্কিন ও ইউরোপীয় রাজনীতিবিদদের উচ্চ-পর্যায়ের কূটনৈতিক সফেরের কারণে ইসরায়েলের পক্ষে আন্তর্জাতিক সমর্থন জোরদার হয়েছে। যদিও যুদ্ধ বেশিদিন চলতে থাকলে এবং বেসামরিক মানুষ হতাহতের সংখ্যা বাড়তে থাকলে এই সংহতি আলগা হয়ে পড়তে পারে।
ওদিকে, সামরিক প্রস্তুতির কথা বলতে গেলে, ইসরায়েল এরইমধ্যে গাজা সীমান্তের কাছে সেনা সমাবেশ করেছে। ৩ লাখ রিজার্ভ সেনাও প্রস্তুত রেখেছে। এর সঙ্গে আছে ১ লাখ ৬০ হাজারেরও বেশি সদস্যের একটি স্ট্যান্ডিং ফোর্সও।
সদ্যই ইসরায়েলে ঢুকে হামাসের নজিরবিহীন হামলার পর ইসরায়েলি সেনাদের মধ্যে এখন গাজায় লড়াই করার জন্য মনোবল চাঙ্গা। তারা লড়াইয়ের জন্য প্রস্তুত হয়ে আছে।
হামাসের হামলার খবর পাওয়া মাত্রই শ্রীলংকা থেকে প্রথম ফ্লাইট ধরে ইসরায়েলে ফিরে এসেছেন এক রিজার্ভ সেনা। তার কথায়, “এটা (ইসরায়েল) আমাদের স্বদেশ। আমাদেরকে এর জন্য লড়তে হবে।”
শান্তি এবং বসবাসের অধিকারের জন্য লড়তে সেলসম্যানের কাজ ছেড়ে ছুটে এসেছেন আরেক রিজার্ভ ইসরায়েলি সেনা। লড়াইয়ে নেমে পড়তে ইসরায়েলিরা যে এখন ঐক্যবদ্ধ এটি তারই লক্ষণ।
কিন্তু ঘড়ি টিক টিক করছে। সেনারা লড়াই শুরুর জন্য নির্দেশ পাওয়ার অপেক্ষায় আছে। সেনারা যত দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করবে, ততই তাদের মনোবল এবং প্রস্তুতি ধরে রাখা কঠিন হবে।
ইসরায়েল গাজার উত্তরের বাসিন্দাদের দক্ষিণে সরে যাওয়ার নির্দেশ এরই মধ্যে দিয়েছে। ইসরায়েলের সামরিক অভিযানের পরবর্তী ধাপ যে আসন্ন, এ তারই লক্ষণ।
আক্রমণের প্রস্তুতি:
ইসরায়েলের প্রথম কাজই হল নিজ ভূখন্ডের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। সেইসঙ্গে হামাস যোদ্ধাদের হত্যা করা কিংবা ধরা এবং জেরা করা। যে যোদ্ধারা সীমান্ত পেরিয়ে ইসরায়েলে ঢুকে হত্যা করেছে ১৩০০ জনের বেশি ইসরায়েলিকে এবং ধরে নিয়ে গিয়ে জিম্মি করেছে অন্তত ১৫০ জনকে।
ইসরায়েল এরই মধ্যে হামাসের হামলার পাল্টা জবাবে গাজায় গোষ্ঠীটির সামরিক শাখা এবং অবকাঠামোতে জোর বিমান হামলা চালাচ্ছে।
গত ছয়দিনে ইসরায়েলের বিমানবাহিনী গাজায় ৬ হাজারের বেশি বোমা ফেলেছে। যেখানে ২০১১ সালে লিবিয়ার গোটা যুদ্ধের সময়টিতে নেটো মিত্রবাহিনী ফেলেছিল ৭ হাজার ৭০০ বোমা।
গাজায় ইসরায়েলের বিমান হামলায় এখন পর্যন্ত ১৫০০ জনের বেশি মানুষ নিহত হয়েছে। গাজায় ইসরায়েলের স্থল হামলার পরিকল্পনা গুটিকয়েকজনের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে এবং গোপনই রাখা হবে। কিন্তু ইসরায়েল এর জন্য প্রস্তত হয়ে আসছে বহু বছর ধরে।
দক্ষিণের আরবান ওয়ারফেয়ার সেন্টারে সেনাদের প্রশিক্ষণ দিয়েছে ইসরায়েল। সেখানে তারা শিখেছে কীভাবে গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকা একের পর এক ভবনের সারি এবং সুড়ঙ্গের মধ্য দিয়ে যুদ্ধ করতে হয়। হামাস এমন হাজারেরও বেশি সুড়ঙ্গ তৈরি করেছে বলে ধারণা করা হয়।
জেরুজালেম পোস্ট পত্রিকার সাবেক সম্পাদক এবং ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর ওপর কয়েকটি বইয়ের লেখক ইয়াকোভ কাটজ বলেছেন, সেনাবাহিনীকে এই কাজের জন্য বিশেষজ্ঞ ব্রিগেডে রূপান্তরিত করা হয়েছে। যেসব ব্রিগেডে আছে ট্যাংক এবং পদাতিক বাহিনী, প্রকৌশলীসহ সাঁজোয়া বুলডোজারও।
শহুরে লড়াইক্ষেত্র এবং সুড়ঙ্গ:
ইসরায়েল ডিফেন্স ফোর্সেস (আইডিএফ) এর সাবেক কমান্ডার ও জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা মেজর জেনারেল ইয়াকভ আমিড্রোর স্বীকার করেছেন যে, হামাসের সঙ্গে লড়াই করা কঠিন হবে। তিনি বলেন, হামাস যোদ্ধারা প্রবেশপথগুলোতে এবং রাস্তার অলি-গলিতে ফাঁদ কিংবা বিস্ফোরক ডিভাইস পেতে রাখবে।
ইসরায়েলের ধারণা, হামাসের প্রায় ৩০ হাজার যোদ্ধা আছে। তাদের অস্ত্রের মধ্যে আছে স্বয়ংক্রিয় রাইফেল, রকেট চালিত গ্রেনেড, ট্যাংক বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র।
হামাসের আরও আছে রকেটের এক বিশাল ভান্ডার। যেগুলো তারা ইসরায়েলে নিক্ষেপ করে আসছে। লেখক ইয়াকভ কাটজ বলেন, হামাস নিজস্বভাবে আত্মঘাতী ড্রোনসহ ছোট ছোট ড্রোনও তৈরি করছে।
তাছাড়া, হামাসের কাছে ভূমি থেকে আকাশে নিক্ষেপণযোগ্য ক্ষেপণাস্ত্রও কিছু কিছু সরবরাহ হয়ে থাকতে পারে বলে জানান কাটজ।
হামাসের যা নেই তা হচ্ছে, সাঁজোয়া যান, ট্যাংক এবং গোলাবারুদ- যেগুলো ইসরায়েলের আছে। কিন্তু স্থল অভিযানের ক্ষেত্রে ইসরায়েলের বড় চ্যালেঞ্জ হল ঘনবসতিপূর্ণ শহুরে এলাকার ঘিঞ্জি পরিবেশে লড়াই করা।
কাটজ বলেন, ইসরায়েলি সেনারা দরকার না পড়লে সুড়ঙ্গে ঢুকে লড়াই করতে যাবে না। কারণ, সুড়ঙ্গের আদ্যপান্ত হামাসেরই ভাল জানা থাকবে। তাই ইসরায়েলি সেনারা সুড়ঙ্গে না ঢুকে বরং বিস্ফোরক দিয়ে সেগুলো ধ্বংস করবে।
জিম্মিদের ভাগ্য:
হামাস ইসরায়েলে ঢুকে হামলা চালানোর পর যে ইসরায়েলিদেরকে ধরে নিয়ে গিয়ে জিম্মি করেছে তাদের ভাগ্যে কী ঘটবে সেটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এই জিম্মিদের কারণে গাজায় কোনওরকম স্থল আক্রমণ শানানো ইসরায়েলের জন্য কঠিন হবে।
ইসরায়েলের মেজর জেনারেল গিলিড জিম্মি মুক্তির আলোচনায় জড়িত ছিলেন। সে আলোচনার মাধ্যমে গিলাদ শালিত নামের এক ইসরায়েলি সেনা মুক্তি পান। এই সেনাকে হামাস ২০০৬ সাল থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত ৫ বছর আটকে রেখেছিল। ১ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি বন্দি মুক্তির বিনিময়ে শালিতকে মুক্তি দেওয়া হয়েছিল।
গিলিড বলেন, সেনাবাহিনীকে তাদের ভাগ্যের বিষয়টি বিবেচনায় নিতে হলেও “আমরা যদি বাস্তবিক কিছু না করি, তাহলে আমরা হয়ত আরও চ্যালেঞ্জিং সমস্যায় পড়ে যাব।”
তবে মেজর জেনারেল আমিড্রোর বলেন, জিম্মিরা কোনও কাজেই বাধা হয়ে দাঁড়াবে না। “আমরা শেষ পর্যন্ত হামাসের সঙ্গে লড়ে যাব এবং অভিযান চলাকালেই আমাদেরকে ওইসব জিম্মিকে খুঁজে বের করতে হবে।”
ইসরায়েলের লক্ষ্য কী?
ইসরায়েল বলে আসছে, তাদের লক্ষ্য ফিলিস্তিনের মুক্তিকামী সশস্ত্র গোষ্ঠী হামাসকে ধ্বংস করা।
৩০ বছর ইসরায়েল ডিফেন্স ফোর্স (আইডিএফ)- এ কাজ করা মেজর জেনারেল গিলিড বলেছেন, গাজায় আগের অভিযানগুলোতে মূলত হামাসকে দমিয়ে রাখার চেষ্টা চলেছে। এবার আমাদেরকে তার চেয়ে বেশিকিছু, আরও নাটকীয় কিছু করার দরকার পড়বে।
চূড়ান্ত সামরিক পদক্ষেপ নেওয়া হলে ওই অঞ্চলে ইসরায়েলের অন্যান্য আরও শত্রু- যেমন: হিজবুল্লাহ এবং ইরানকেও নিবৃত্ত করা যাবে বলেই বিশ্বাস করেন এই ইসরায়েলি জেনারেল।
ওদিকে, ইসরায়েলি সেনাবাহিনী নিয়ে রচিত গ্রন্থের লেখক কাটজ মনে করেন, ইসরায়েলের লক্ষ্য আরও বাস্তবসম্মত হবে। হামাসের আর কখনও ফের ইসরায়েলে হামলা চালানোর সক্ষমতা যাতে না হয় সেটি তারা নিশ্চিত করবে।
তিনি বলেন, ইসরায়েল গাজা আবার দখল করতে চায় না। সেখানে থাকা ২০ লক্ষাধিক অধিবাসীর দেখভালও করতে চায় না।
তবে, সাম্প্রতিক কয়েকটি যুদ্ধের দিকে তাকালে দেখা যায়, আগ্রাসন পরিকল্পনা অনুযায়ী এগোয় না বললেই চলে। এমনকী বিশ্বের সবচেয়ে আধুনিক সেনাবাহিনীও জলদিই নিশ্চল হয়ে পড়ে। ইরাক, আফগানিস্তানের ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের যেমনটি হয়েছে এবং অতিসম্প্রতি ইউক্রেইনে রাশিয়ার আগ্রাসনে যেমনটি দেখা যাচ্ছে।
মধ্যপ্রাচ্যের ‘ইন্সটিটিউট অব স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজ’ এর লেফটেন্যান্ট জেনারেল টম বেকেট বলেন, মাত্র ২৫ মাইল দীর্ঘ ভূখন্ড গাজায় সামরিক অভিযানের ব্যাপকতার মাত্রা অবশ্য ওইসব যুদ্ধের মতো হবে না। কিন্তু এর ফল কী হবে তা বোঝা মুশকিল।
তিনি বলেন, সামরিক একটি সংগঠন হিসাবে হামাসকে পরাস্ত করায় ইসরায়েলের অভিযান যতই সফল হোক সেটি কোনও ব্যাপার নয়। হামাসের রাজনৈতিক আধিপত্য এবং তাদের প্রতি জনগণের সমর্থন থাকবেই।
“ইসরায়েল গাজাকে নিয়ন্ত্রণের জন্য তা পুনর্দখল করুক কিংবা অভিযান চালিয়ে চলেই আসুক, এ ভূখন্ড ওইসব মানুষেরই থাকবে- প্রতিরোধই যাদের অস্তিত্ব,” বলেন বেকেট।