“ইসরায়েলের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে জড়িত ইউএনআরডব্লিউএ কর্মীদের অবশ্যই জবাবদিহি করতে হবে," বলছেন নেতানিয়াহু।
Published : 29 Oct 2024, 11:33 AM
ইসরায়েল ও তাদের অধিকৃত পূর্ব জেরুজালেম থেকে ফিলিস্তিনি শরণার্থী বিষয়ক জাতিসংঘ সংস্থা ইউএনআরডব্লিউএ’র কার্যক্রম তিন মাসের মধ্যে নিষিদ্ধ করে পার্লামেন্টে বিল পাস করেছে ইহুদি দেশটি।
এর ফলে ইউএনআরডব্লিউএ কর্মীদের সঙ্গে ইসরায়েলি কর্মকর্তাদের যোগাযোগও নিষিদ্ধ হবে; তাতে গাজা ও ইসরায়েল অধিকৃত পশ্চিম তীরে জাতিসংঘ সংস্থাটির কার্যক্রম মারাত্মকভাবে ব্যাহত হবে।
বিবিসি লিখেছে, যুদ্ধবিধ্বস্ত অঞ্চলে ত্রাণ পৌঁছাতে গাজার সব সীমান্ত নিয়ন্ত্রণকারী ইসরায়েলি সামরিক বাহিনীর সঙ্গে ইউএনআরডব্লিউএ'র সহযোগিতা অপরিহার্য। সেখানকার ভূমিতে কাজ করা জাতিসংঘের প্রধান সংস্থা এটিই।
নতুন আইনের কারণে ইসরায়েলের ভেতরে ইউএনআরডব্লিউএ কর্মীদের আর আইনি দায়মুক্তি থাকবে না এবং পূর্ব জেরুজালেমে সংস্থাটির সদরদপ্তর বন্ধ হয়ে যাবে।
জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস বলেছেন, “এই আইনগুলো বাস্তবায়ন হলে তা ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংঘাত নিরসন এবং সামগ্রিকভাবে এই অঞ্চলের শান্তি ও নিরাপত্তার জন্য ক্ষতিকর হবে।”
ইউএনআরডব্লিউএ প্রধান ফিলিপ লাজারিনি বলেন, “এ আইনগুলো ফিলিস্তিনিদের ভোগান্তিকে আরও বাড়িয়ে দেবে।”
ইসরায়েলের নতুন পদক্ষেপে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, জার্মানিসহ বেশ কয়েকটি দেশ গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে।
যুক্তরাজ্যের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডেভিড ল্যামি একে ‘সম্পূর্ণ ভুল' পদক্ষেপ হিসেবে বর্ণনা করেছেন। অন্যদিকে দেশটির প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমার বলেছেন, নতুন আইন “ফিলিস্তিনিদের জন্য ইউএনআরডব্লিউএর প্রয়োজনীয় কাজকে অসম্ভব করে তুলবে, গাজায় পুরো আন্তর্জাতিক মানবিক সহায়তাকে বিপন্ন করবে।"
মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলেছে, গাজায় মানবিক ত্রাণ বিতরণে জরুরি ভূমিকা পালন করেছে ইউএনআরডব্লিউএ। ২০ লাখের বেশি মানুষের এই ছিটমহলের প্রায় সবাই সংস্থাটির ত্রাণ ও সেবার ওপর নির্ভরশীল।
অন্যদিকে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু বলেছেন, “ইসরায়েলের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে জড়িত ইউএনআরডব্লিউএ কর্মীদের অবশ্যই জবাবদিহি করতে হবে।"
তবে তিনি বলেছেন, “গাজায় টেকসই মানবিক সহায়তা অবশ্যই থাকতে হবে।"
এক্স পোস্টে তিনি বলেন, “ইসরায়েলের নিরাপত্তার জন্য যাতে হুমকি না হয়, এমনভাবে গাজায় বেসামরিক নাগরিকদের মানবিক সহায়তা প্রদান অব্যাহত রাখার প্রশ্নে আমরা আমাদের আন্তর্জাতিক অংশীদারদের সঙ্গে কাজ করতে প্রস্তুত আছি।”
বিবিসি লিখেছে, ইসরায়েল কয়েক দশক ধরেই ইউএনআরডব্লিউএ’কে নিয়ে আপত্তি জানিয়ে আসছে, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এই বিরোধিতা আরও তীব্র হয়েছে।
ইউএনআরডব্লিউএ কর্মীরা গাজায় হামাসের সঙ্গে ‘আঁতাত করেছে’ অভিযোগ করে ইসরায়েল দাবি করেছে, ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর হামাস ইসরায়েলে যে হামলা চালিয়েছিল, তাতে জাতিসংঘের সংস্থাটির ১৯ কর্মী অংশ নিয়েছিল।
জাতিসংঘ এই দাবি তদন্ত করে অভিযুক্তদের মধ্যে নয়জনকে বরখাস্ত করেছে। তবে সংস্থাটি বলেছে, ইসরায়েল বড় মাত্রার এ অভিযোগের পক্ষে প্রমাণ সরবরাহ করেনি। ইউএনআরডব্লিউএ জোর দিয়ে বলেছে, গাজায় কাজ চালিয়ে নিতে হামাসের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক রক্ষা করে চলতে হয়।
ইসরায়েলের পার্লামেন্ট নেসেট সোমবার সন্ধ্যায় বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতায় নিষেধাজ্ঞার দুটি বিলে অনুমোদন পায়।
বিলটি উপস্থাপনের সময় নেসেটের পররাষ্ট্র ও নিরাপত্তা কমিটির চেয়ারম্যান ইউলি এডেলস্টেইন 'সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের ঢাল' হিসেবে ইউএনআরডব্লিউকে ব্যবহারের অভিযোগ করেন।
তিনি পার্লামেন্টে বলেন, “সন্ত্রাসী সংগঠন (হামাস) ও ইউএনআরডব্লিউ ‘র মধ্যে গভীর সম্পর্ক রয়েছে এবং ইসরায়েল এটি সহ্য করতে পারে না।”
ইউএনআরডব্লিউএ কয়েক দশক ধরে গাজার লাখ লাখ ফিলিস্তিনিকে স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষাসহ বিভিন্ন সেবা ও সহায়তা দিয়ে আসছে।
গত বছর যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে সংস্থাটির উপস্থিতি বেসামরিক নাগরিকদের কাছে মানবিক সহায়তা পৌঁছানোর প্রচেষ্টার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয়ে উঠেছে। গাজার প্রায় সবাই বাসিন্দাই বেঁচে থাকার জন্য সহায়তার উপর নির্ভরশীল।
ইসরায়েলের নিষেধাজ্ঞাকে ‘নজিরবিহীন’ হিসেবে বর্ণনা করে নিন্দা জানিয়েছেন ইউএনআরডব্লিউএ কমিশনার জেনারেল ফিলিপ লাজারিনি।
তিনি বলেছেন, এই পদক্ষেপ জাতিসংঘ সনদকে বিরোধিতা করে এবং আন্তর্জাতিক আইনের অধীনে ইসরায়েল রাষ্ট্রের যে বাধ্যবাধকতা আছে, সেটিকেও লঙ্ঘন করে।
গাজার মানুষ ‘নরক যন্ত্রণা’ সহ্য করে আসছে মন্তব্য করে তিনি বলেন, “ইসরায়েলের নিষেধাজ্ঞা সাড়ে ছয় লাখের বেশি ছেলে-মেয়েকে শিক্ষা থেকে বঞ্চিত করবে; শিশুদের পুরো একটি প্রজন্মকে ঝুঁকিতে ফেলবে।”
পূর্ব জেরুজালেম, গাজাসহ ইসরায়েল অধিকৃত পশ্চিম তীরের প্রায় আড়াই লাখ ফিলিস্তিনি ইউএনআরডব্লিউএ নিবন্ধিত।
গাজার উত্তরাঞ্চলে যেখানে হামাস যোদ্ধাদের বিরুদ্ধে ইসরায়েলি সেনাদের সামরিক অভিযান চলছে, সেখানে হাজার হাজার মানুষ ক্রমবর্ধমান গুরুতর অবস্থার মধ্যে বসবাস করছে।
জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক প্রধান ফলকার টুর্ক শুক্রবার বলেছেন, “ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী পুরো জনগোষ্ঠীকে বোমা হামলা, অবরোধ ও অনাহারের ঝুঁকিতে ফেলছে।”
অনেক ফিলিস্তিনি মনে করেন, ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী গাজার উত্তরে ‘আত্মসমর্পণ কর অথবা মর’ পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করছে; যার ফলে আনুমানিক চার লাখ মানুষ দক্ষিণে বাস্তচ্যুত হচ্ছে। এরপর উত্তরে থাকা হামাস যোদ্ধাদের অবরোধ করা হবে।
এ ধরনের কোনো পরিকল্পনা থাকার কথা অস্বীকার করে ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী বলেছে, বেসামরিক লোকজনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হচ্ছে।
গত বছরের ৭ অক্টোবর হামাসের হামলায় ১২০০ জনের মৃত্যু এবং ২৫১ জন জিম্মি হওয়ার পর ইসরায়েল অভিযান শুরু করে।
তাতে ৪২ হাজার ৭১০ জনেরও বেশি ফিলিস্তিনি মারা গেছে বলে হামাস পরিচালিত স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের পরিসংখ্যানে উঠে এসেছে।