Published : 13 Mar 2025, 12:33 AM
অস্ট্রেলিয়ার এক ব্যক্তি সম্পূর্ণ এক কৃত্রিম হৃদপিণ্ড প্রতিস্থাপন করে হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে এসেছিলেন। এরপর ১০০ দিনেরও বেশি সময় তিনি পাড়ি দিয়েছেন সেই কৃত্রিম হৃদপিণ্ড নিয়ে, যতদিন না একজন দাতার হৃদযন্ত্র প্রতিস্থাপনের জন্য মিলছিল ততদিন।
কৃত্রিম হৃদপিণ্ড নিয়ে এত দীর্ঘদিন কারও বেঁচে থাকার এমন সাফল্য বিশ্বে এটাই প্রথম। অস্ট্রেলিয়ার গবেষক ও চিকিৎসকরা একে ‘বড় ধরনের ক্লিনিক্যাল সাফল্য’ হিসেবেই দেখছেন। কৃত্রিম হৃদপিণ্ড নিয়ে বেঁচে থাকা সেই ব্যক্তি মার্চের শুরুতে একজন দাতার হৃদপিণ্ড পান এবং তখন সেটি প্রতিস্থাপন করা হয়।
কুইন্সল্যান্ডের ড. ড্যানিয়েল টিমস এর উদ্ভাবিত এই ‘বাইভেকর’ কৃত্রিম হৃদপিণ্ড বিশ্বে প্রথম সম্পূর্ণ প্রতিস্থাপনযোগ্য রোটারি ব্লাড পাম্প, যা মানব হৃদপিণ্ডের সম্পূর্ণ বিকল্প হিসেবে কাজ করতে সক্ষম। এটি চৌম্বকীয় লেভিটেশন প্রযুক্তি ব্যবহার করে সুস্থ হৃদপিণ্ডের মতো স্বাভাবিক রক্তপ্রবাহ নিশ্চিত করে।
‘দ্য গার্ডিয়ান’ পত্রিকা জানায়, এই কৃত্রিম হৃদপিণ্ড এখনও প্রাথমিক ক্লিনিক্যাল পরীক্ষার পর্যায়ে রয়েছে এবং মূলত সেই রোগীদের জন্য তৈরি করা হয়েছে, যারা চূড়ান্ত পর্যায়ের বাইভেন্ট্রিকুলার হার্ট ফেলিওর রোগে আক্রান্ত।
সাধারণত হৃদরোগ, হার্ট অ্যাটাক, করোনারি হৃদরোগ এবং ডায়াবেটিসের কারণে এই অবস্থা সৃষ্টি হয়, যখন হৃদপিণ্ড শরীরে রক্ত সঞ্চালন করতে ব্যর্থ হয়। প্রতি বছর বিশ্বব্যাপী ২ কোটি ৩০ লাখেরও বেশি মানুষ হৃদরোগে ভোগেন, কিন্তু মাত্র ৬,০০০ জন পেয়ে থাকেন দাতার হৃদপিণ্ড।
অস্ট্রেলিয়ার সরকার ‘বাইভেকর’ ডিভাইসের উন্নয়ন ও বাণিজ্যিকীকরণের জন্য ৫ কোটি ডলার অর্থায়ন করেছে, যা "কৃত্রিম হার্ট ফ্রন্টিয়ার্স প্রোগ্রাম"-এর অংশ। এটি এমনভাবে নকশা করা হয়েছে যাতে দাতার হৃদপিণ্ড প্রতিস্থাপনের ব্যবস্থা না হওয়া পর্যন্ত রোগীদেরকে জীবিত রাখা যায়।
তবে‘বাইভেকর’ এর দীর্ঘমেয়াদী লক্ষ্য হচ্ছে, এটি এমনভাবে কার্যকর করে তোলা, যাতে রোগীরা এই কৃত্রিম হৃদপিণ্ড নিয়েই বেঁচে থাকতে পারেন, কোনও দাতা হৃদপিণ্ডের প্রয়োজন ছাড়াই।
নিউ সাউথ ওয়েলসের ৪০ বছর বয়সী ওই ব্যক্তি, হার্ট ফেলিওরের রোগী ছিলেন। তিনি স্বেচ্ছায় অস্ট্রেলিয়ার প্রথম এবং বিশ্বে ষষ্ঠ ব্যক্তি হিসেবে এই কৃত্রিম হৃদপিণ্ড গ্রহণ করেন। ২০২৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রে পাঁচটি হৃদযন্ত্রের সফল প্রতিস্থাপন করা হয়েছিল, যেখানে রোগীরা সর্বোচ্চ ২৭ দিন পর দাতা হৃদপিণ্ড গ্রহণ করেছিলেন।
২২ নভেম্বরে সিডনির সেন্ট ভিনসেন্ট হাসপাতালে ছয় ঘণ্টাব্যাপী অপারেশনের মাধ্যমে কার্ডিওথোরাসিক ও ট্রান্সপ্লান্ট সার্জন ড. পল জান্জ ওই অস্ট্রেলিয় রোগীর দেহে বাইভেকর ডিভাইস প্রতিস্থাপন সম্পন্ন করেন। ফেব্রুয়ারিতে হাসপাতাল থেকে ছাড়া পান রোগী। পরে মার্চে তিনি দাতা হৃদপিণ্ড প্রতিস্থাপন করেন।
কার্ডিওথোরাসিক ও ট্রান্সপ্ল্যান্ট সার্জন ড. পল জানজ বলেছেন, “অস্ট্রেলিয়ার চিকিৎসার ইতিহাসে এই যুগান্তকারী সাফল্যের অংশ হতে পারা আমাদের জন্য সত্যিই গর্বের।” তিনি আরও বলেন, “বহু বছর ধরে আমরা এই মুহূর্তটির জন্য কাজ করেছি এবং অস্ট্রেলিয়ায় প্রথমবারের মতো এই অস্ত্রোপচার সফলভাবে সম্পন্ন করতে পেরে আমরা অত্যন্ত গর্বিত।”
সেন্ট ভিনসেন্ট হাসপাতালের কার্ডিওলজিস্ট প্রফেসর ক্রিস হেওয়ার্ড বলেন, “বাইভেকর কৃত্রিম হৃদপিণ্ড হৃদরোগ চিকিৎসায় একটি নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে। আগামী দশ বছরে এটি দাতা হৃদপিণ্ডের জন্য অপেক্ষায় থাকা রোগীদের জন্য একটি কার্যকর বিকল্প হয়ে উঠবে।”
কুইন্সল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর ডেভিড কোলকুন বলেন, “এটি কৃত্রিম হৃদপিণ্ড প্রযুক্তিতে এক বিশাল অগ্রগতি। তবে তিনি সতর্ক করে বলেন, বর্তমানে এই কৃত্রিম হৃদপিণ্ড মাত্র ১০০ দিনের বেশি কার্যকর ছিল, যেখানে কোনও দাতার হৃদপিণ্ড ১০ বছর বা ৩,০০০ দিনেরও বেশি সময় কার্যকর থাকতে পারে।”
তিনি আরও উল্লেখ করেন, আধুনিক চিকিৎসা এবং উন্নত ওষুধের কারণে হৃদরোগে মৃত্যুহার কমেছে। ১৯৬৭-৬৮ সালে অস্ট্রেলিয়ার মোট ১ কোটি ১০ লাখ মানুষের মধ্যে ৪৭,০০০ মানুষ হৃদরোগে মারা গিয়েছিলেন। সেখানে ২০২২ সালে ২ কোটি ৬০ লাখ মানুষের মধ্যে এই সংখ্যা ছিল ৪৫,০০০।
আর সর্বসাম্প্রতিক ওই কৃত্রিম হৃদপিণ্ড প্রতিস্থাপন “মোনাশ বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তর্ভুক্ত কৃত্রিম হৃদপিণ্ড ফ্রন্টিয়ার্স প্রোগ্রাম”-এর অধীনে পরিচালিত প্রথম ক্লিনিক্যাল পরীক্ষার অংশ, যেখানে হৃদরোগ চিকিৎসার জন্য তিনটি প্রধান ডিভাইস উন্নয়ন করা হচ্ছে।