এই প্রথমবারের মতো ভারত বিশ্ব ব্যাংকের মধ্যস্থতায় ১৯৬০ সালে হওয়া সিন্ধু পানি চুক্তি স্থগিত করেছে।
Published : 27 Apr 2025, 11:55 AM
সিন্ধু নদ থেকে অল্প দূরে নিজের সবজি খেতে কীটনাশক স্প্রে করতে থাকা পাকিস্তানি কৃষক হোমলা ঠাকুর নিজের ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বিগ্ন। সূর্য মধ্যগগনে, নদীতে পানি খুব অল্প আর কাশ্মীরে প্রাণঘাতী জঙ্গি হামলার পর ভারত উজান থেকে নেমে আসা পানি বন্ধ করে দেওয়ার প্রত্যয় জানিয়েছে।
“তারা যদি পানি বন্ধ করে দেয়, এগুলো সব থর মরুভূমিতে পরিণত হবে, পুরো দেশ,” স্প্রে গানের ট্যাংকে পানি ভরার জন্য নদীর দিকে যেতে যেতে বলেন ঠাকুর (৪০) ।
“না খেয়ে মারা যাবো আমরা,” বলেন তিনি।
তার প্রায় পাঁচ একরের কৃষিখামার পাকিস্তানের সিন্ধু প্রদেশের লতিফাবাদ এলাকায়, কাছেই সিন্ধু নদ আরব সাগরের দিকে চলে গেছে। এই নদীর উৎপত্তি তিব্বতে আর তা ভারত হয়ে পাকিস্তানে প্রবেশ করে আরব সাগরে গিয়ে পড়েছে।
ঠাকুরের এই শঙ্কা আরও ১৫ জনেরও বেশি পাকিস্তানি কৃষক ও বেশ কয়েকজন বিশেষজ্ঞের কণ্ঠেও প্রতিধ্বনিত হয়েছে, বিশেষভাবে কয়েক বছর ধরে যখন বৃষ্টি কমে গেছে।
এই প্রথমবারের মতো বুধবার ভারত বিশ্ব ব্যাংকের মধ্যস্থতায় ১৯৬০ সালে হওয়া সিন্ধু পানি চুক্তি স্থগিত করেছে। পাকিস্তানের ৮০ শতাংশ কৃষিজমিতে পানি সরবরাহ নিশ্চিত করেছে এই চুক্তি। ভারত বলেছে, “পাকিস্তান বিশ্বাসযোগ্য ও অপরিবর্তনীয়ভাবে আন্তঃসীমান্ত সন্ত্রাসবাদের প্রতি তাদের সমর্থন বাদ না দেওয়া পর্যন্ত এ চুক্তি স্থগিত থাকবে।”
ভারতের অভিযোগ, যে তিন জঙ্গি কাশ্মীরে হামলা চালিয়ে ২৬ জন পর্যটককে হত্যা করেছে তাদের মধ্যে দুইজন পাকিস্তান থেকে এসেছে। পাকিস্তান এই হামলায় নিজেদের কোনো ভূমিকা থাকার কথা অস্বীকার করে বলেছে, “পাকিস্তানের পানির প্রবাহ বন্ধ করার বা সরিয়ে নেওয়ার যে কোনো প্রচেষ্টাকে যুদ্ধের উস্কানি হিসেবে বিবেচনা করা হবে।”
ওই চুক্তি সিন্ধু নদ ও এর শাখা নদীগুলোর পানির প্রবাহকে পারমাণবিক শক্তিধর দুই দেশের মধ্যে ভাগ করে দিয়েছে।
উভয়পক্ষের সরকারি কর্মকর্তা ও বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, ভারত অবিলম্বে পানির প্রবাহ বন্ধ করতে পারবে না, কারণ চুক্তিতে যে তিনটি নদী পাকিস্তানকে বরাদ্দ করা হয়েছে ভারত সেগুলোতে বিশাল কোনো জলাধার বা বাঁধ ছাড়া শুধু জলবিদ্যুৎ প্রকল্প নির্মাণ করতে পারবে। কিন্তু কয়েক মাসের মধ্যেই এসব ক্ষেত্রে পরিবর্তন শুরু হতে পারে।
সামাজিক মাধ্যম এক্স এ ভারতের পানি সম্পদমন্ত্রী চন্দ্রকান্ত রঘুনাথ পাতিল লিখেছেন, “সিন্ধু নদের এক ফোঁটা পানিও যেন পাকিস্তানে না যায় তা নিশ্চিত করবো আমরা।”
স্পর্শকাতর বিষয়ে নিয়ে আলোচনার কারণে শনাক্ত হতে অনিচ্ছুক দুই ভারতীয় কর্মকর্তা জানান, ভারত কয়েক মাসের মধ্যেই নিজেদের কৃষিজমির জন্য খালের মাধ্যমে পানি সরিয়ে নেওয়া শুরু করতে পারে আর জলবিদ্যুৎ বাঁধ তৈরির যে পরিকল্পনাগুলো হচ্ছে সেগুলো শেষ হতে চার থেকে সাত বছর লাগতে পারে।
তাৎক্ষণিকভাবে ভারত তাদের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত বিভিন্ন নদীর বিভিন্ন স্থানের পানি প্রবাহের তথ্য ভাগাভাগি করা বন্ধ করে দিয়েছে, বন্যার সতর্কতা দেওয়া স্থগিত করেছে এবং স্থায়ী সিন্ধু কমিশনের বার্ষিক বৈঠক বন্ধ করে দিয়েছে বলে সম্প্রতি ভারতের কেন্দ্রীয় পানি কমিশনের প্রধান হিসেবে অবসর নেওয়া কুশবিন্দর ভোহরা রয়টার্সকে জানিয়েছেন।
ভোহরা ভারতের পক্ষে সিন্ধু কমিশনার হিসেবে দায়িত্বপালন করেছেন আর এখন মাঝে মাঝে সরকারের পরামর্শক হিসেবে কাজ করেন।
তিনি বলেন, “পানি কখন আসছে, কতোটা আসছে এসব নিয়ে তাদের কাছে খুব বেশি তথ্য থাকবে না। আর এসব তথ্য ছাড়া তারা পরিকল্পনা করতে পারবে না।”
আর এটি শুধু কৃষিতে প্রভাব ফেলবে না, পানির স্বল্পতা জলবিদ্যুৎ প্রকল্পেও আঘাত হানবে আর তা অর্থনীতিকে পঙ্গু করে দিতে পারে বলে মন্তব্য করেছেন অর্থনীতিবিদরা।
যুক্তরাজ্যের পরামর্শক প্রতিষ্ঠান অক্সফোর্ড পলিসি ম্যানেজমেন্ট এর টিম লিডার অর্থনীতিবিদ ভাকার আহমেদ বলেছেন, চুক্তি থেকে ভারতের সরে যাওয়ার হুমকিকে পাকিস্তান অবমূল্যায়ন করেছিল।
তিনি বলেন, “পানির প্রবাহগুলোকে তাৎক্ষণিকভাবে ধরে রাখার মতো অবকাঠামো ভারতের নেই, বিশেষ করে বন্যার সময়। তাই এই সময়টি পাকিস্তানের জন্য তাদের পানি খাতের অদক্ষতা মোকাবেলার জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ সুযোগ তৈরি করে। অনেক অদক্ষতা, ফাঁকফোকর আছে।”
চলমান বিরোধ
সম্প্রতি ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সরকার সিন্ধু পানি চুক্তি নিয়ে ফের আলোচনা করতে চাইছিলেন। আর এই দুই দেশ কিশেনগঙ্গা ও রাটেল জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের পানি সংরক্ষণ এলাকার আকার নিয়ে হেগের স্থায়ী সালিশ আদালতে তাদের কিছু বিরোধ নিষ্পত্তির চেষ্টা করছিল।
“এখন আমরা ইচ্ছামতো আমাদের প্রকল্পগুলো এগিয়ে নিতে পারবো,” বলেন ভোহরা।
বৃহস্পতিবার এক চিঠিতে ভারত পাকিস্তানকে জানিয়েছে, চুক্তি যখন স্বাক্ষর হয়েছিল তারপর থেকে পরিস্থিতির অনেক বদলে গেছে, লোকসংখ্যাও অনেক বেড়েছে এবং কার্বন নিঃসরণ করে না জলবিদ্যুতের মতো এমন শক্তি উৎসের চাহিদাও বেড়েছে।
বিশ্ব ব্যাংকের এক মুখপাত্র বলেছেন, “ব্যাংক সীমিত নির্দিষ্ট কিছু কাজের জন্য করা চুক্তিটির স্বাক্ষরকারী ছিল আর এটি সদস্য দেশগুলোর চুক্তি সম্পর্কিত সার্বভৌম সিদ্ধান্তের ওপর মতামত দেয় না।”
সিন্ধুতে নাদিম শাহর দেড়শ একরের একটি কৃষিখামার আছে। সেখানে তিনি তুলা, আখ, গম ও শাকসবজির চাষ করেন। তিনি শুধু সেচের পানি না, পানযোগ্য পানি নিয়েও উদ্বিগ্ন হয়ে আছেন।
“খোদার উপর আমাদের বিশ্বাস আছে, কিন্তু ভারতের পদক্ষেপ নিয়ে উদ্বেগ দেখা দিয়েছে।”
এই তিন নদীর পানি ২৪ কোটি জনসংখ্যার পাকিস্তানের জন্য এক কোটি ৬০ লাখ হেক্টরেরও বেশি কৃষিজমির জন্য সেচের যোগান দেয় যা দেশটির মোট জমির ৮০ শতাংশ।
পাকিস্তানের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী বিলওয়াল ভু্ট্টো জারদারি বলেন, “আমরা ইতোমধ্যেই প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে সংঘাতের মধ্যে আটকে আছি আর সিন্ধু পানি চুক্তি থেকে বের হয়ে যাওয়ার মাধ্যমে, আমার বিশ্বাস, ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে সংঘাতের এক নতুন প্রেক্ষাপটে আবদ্ধ করতে যাচ্ছি, যা ঘটতে দেওয়া যায় না।”