“বিক্ষোভকারীদের সংগঠিত হওয়া, যোগাযোগ ও দেশের বাইরে তথ্য পাঠানোর মতো বিষয়গুলো ঠেকানোর জন্য ইন্টারনেট বন্ধ করে দেওয়া একটি মোক্ষম অস্ত্র।”
Published : 24 Sep 2022, 07:37 PM
ইরানের পুলিশ হেফাজতে এক কুর্দিশ নারীর মৃত্যুকে কেন্দ্র করে দেশটিতে এক সপ্তাহের বেশি সময় ধরে চলা বিক্ষোভে অস্থিরতা বেড়েছে অনলাইনেও।
কুর্দিশ ওই নারীর নাম মাহশা আমিনি।
আমিনির মৃত্যুতে পুরো ইরান জুড়ে বিক্ষোভ শুরুর পর থেকেই দেশটির ইন্টারনেটে বিরতিহীন ব্লাকআউট চলার খবর দিয়েছে বিবিসি। দেশটির ‘হিজাব আইন মেনে চলায় ব্যর্থতার’ অভিযোগে গ্রেপ্তার হয়েছিলেন এই ২২ বছর বয়সী নারী।
ইরান জুড়ে ইন্টারনেট বিভ্রাট নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন বিক্ষোভকারীরা ও বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যমে প্রবেশ না করতে পারা নাগরিকরা।
আরও পড়ুন
পুলিশ হেফাজতে তরুণীর মৃত্যু ঘিরে ইরানে ‘বিক্ষোভে গুলি, ৫ নিহত’
ইন্টারনেট মনিটরিং দল নেটব্লকসের তথ্য অনুযায়ী, ইরানে অনুমোদিত দুটি বড় সামাজিক মাধ্যম ইনস্টাগ্রাম ও হোয়াটসঅ্যাপে প্রবেশও সীমিত করে দিয়েছে দেশটি।
মেটা মালিকানাধীন এই অ্যাপ দুটিতে আছে ইরানের কয়েক মিলিয়ন ব্যবহারকারী। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দেশটি ফেইসবুক ও টুইটারের মতো অন্যান্য প্ল্যাটফর্ম ব্লক করার পর ব্যপক হারে বেড়েছে অ্যাপ দুটোর জনপ্রিয়তা। এ ছাড়া, টেলিগ্রাম, ইউটিউব ও টিকটকও বিভিন্ন সময়ে বন্ধ করেছে দেশটি।
হোয়াটসঅ্যাপ বলেছে, ইরানের ব্যবহারকারীদের সংযোগ ফিরিয়ে আনতে কাজ করছে তারা।
নেটব্লকসের তথ্য অনুযায়ী, বৃহস্পতিবার দেশটিতে আংশিকভাবে ইন্টারনেট সংযোগ ফিরলেও শুক্রবার পুনরায় ‘পুরো দেশজুড়ে সংযোগ হারানোর’ ঘটনা ঘটেছে।
“বিভিন্ন অনলাইন অ্যাপ ও সেবা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছে ইরানের লোকজন।” --টুইট করেছেন ইনস্টাগ্রাম প্রধান অ্যাডাম মোসেরি।
তিনি আরও যোগ করেন, “আমরা আশা করছি, অনলাইনে থাকার অধিকার দ্রুতই ফিরে পাবেন তারা।”
অনেকে অভিযোগ করছেন, ব্যবহারকারীর সংযোগ বিচ্ছিন্ন করায় ইরান সরকারের সঙ্গে হাত মিলিয়ে জড়িত মেটা নিজেই। এদের একজন হলেন ব্রিটিশ অভিনেত্রী নাজানিন বনিয়াদি।
“এতগুলো ‘ইরান প্রটেস্ট’ হ্যাশট্যাগের পোস্ট মেটা কেন মুছে দিচ্ছে?” --টুইটারে লেখেন তিনি।
Why is Meta deleting so many #IranProtests posts?
— Nazanin Boniadi (@NazaninBoniadi) September 22, 2022
মেটার ইরান বিক্ষোভ সমর্থিত কনটেন্ট ব্লক করার বিভিন্ন প্রমাণও টুইটারে শেয়ার করেছেন কয়েকজন।
ফার্সিভাষী পর্যালোচকদের একটি নিজস্ব দল আছে মেটার। তাদের বিবেচনায় যেসব কনটেন্ট নিয়ম লঙ্ঘন করে, সেগুলো দেখে সরিয়ে ফেলেন তারা।
Instagram has removed my video about the murder of #MahsaAmini and telling the people of #Iran they are not alone. This video had 75k likes and over 1.8 million views. IG also doesn’t allow me to appeal. This is from a VERIFIED account outside of Iran. @instagram @Meta pic.twitter.com/JuagmaHeQQ
— Emily Schrader - אמילי שריידר (@emilykschrader) September 21, 2022
বিবিসি’র প্রতিবেদন অনুযায়ী, কোনো পোস্ট মেটা কমিউনিটি স্ট্যান্ডার্ড লঙ্ঘন করলে, ব্যবহারকারী বা প্রযুক্তির মাধ্যমে ‘ফ্ল্যাগড’ হলে সেটি নামিয়ে ফেলা হয়।
অনেকে আবার অভিযোগ করছেন, ভিপিএন বা প্রক্সি সার্ভারের মাধ্যমেও নিজেদের হোয়াটসঅ্যাপ অ্যাকাউন্টে প্রবেশ করতে পারছেন না তারা।
সাধারণত সরকার যখন বিভিন্ন ওয়েবসাইটে প্রবেশাধিকার সীমিত করে দেয়, তখন কেবল ভিপিএন ব্যবহার করে বিভিন্ন নিষিদ্ধ ওয়েবসাইটের কনটেন্ট দেখা যায়। তবে, ইরানের এ নিষেধাজ্ঞা কিছুটা ভিন্ন মনে হচ্ছে।
কী ঘটছে আসলে?
বিবিসির প্রতিবেদন অনুযায়ী, ইরানের সবচেয়ে বড় মোবাইল ফোন অপারেটর অফলাইনে চলে যাওয়ায় মূলত এই ব্ল্যাকআউটের ঘটনা ঘটেছে।
‘ইরান মোবাইল কমিউনিকেশন্স কোম্পানি’ নামে পরিচিত এই অপারেটরের গ্রাহক সংখ্যা ছয় কোটিরও বেশি।
গেল সপ্তাহের শুরুতে এই পরিস্থিতির জন্য বিভিন্ন নিরাপত্তা সংশ্লিষ্ট কারণকে দায়ী করেন দেশটির যোগাযোগ মন্ত্রী।
আরও পড়ুন
হিজাব: ইরানি নারী বনাম নীতি পুলিশ
“রাস্তায় অস্থিরতা ছড়িয়ে পড়লে ইরানি কর্তৃপক্ষের হাতে থাকা সবচেয়ে বড় হাতিয়ার হল ইন্টারনেট।” --বিবিসিকে বলেন নেটব্লকস গবেষক ইসিক মাতের।
তিনি আরও বলেন, ইরানে যেহেতু বেসরকারী কোনো ব্রডকাস্ট নেটওয়ার্ক নেই, তাই ইন্টারনেটই ‘একমাত্র জায়গা’, যেখানে বিক্ষোভকারীরা নিজস্ব মত প্রকাশ করতে পারেন।
আমিনির মৃত্যুর কারণে নারী স্বাধীনতা ও অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জসহ বেশ কয়েকটি কারণে বিক্ষোভ হচ্ছে ইরানে।
বিবিসির প্রতিবেদন বলছে, নিজেদের হিজাব ওড়ানোর পাশাপাশি সেটিকে পুড়িয়ে ফেলছেন অনেক নারী বিক্ষোভকারী। এ ছাড়া, আরও কঠোর ক্র্যাকডাউনের আশঙ্কা করছেন তারা।
“আমরা শঙ্কিত যে সরকার ইন্টারনেট সংযোগ বন্ধ রাখলে ইরানের বাস্তবতা সম্পর্কে গোটা বিশ্ব ভুলে যাবে, যা এরইমধ্যে ঘটতে শুরু করেছে।” --বিবিসিকে বলেছেন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক বিক্ষোভকারী।
আরও পড়ুন
ইরানে হিজাব পুড়িয়ে নারীদের বিক্ষোভ
দেশটির বেশিরভাগ আন্দোলন ও প্রচারণার আয়োজন হয় সামাজিক মাধ্যমে। তাদের ইন্টারনেট সংযোগ না থাকলে আন্দোলন সচল রাখা বেশ কঠিন হয়ে যায়।
“যখন বিক্ষোভের মাত্রা সরকারের অস্তিত্বকে হুমকির মুখে ফেলে দেয়, তখন ইরানি কর্তৃপক্ষের তুরুপের তাস হলো দেশজুড়ে ইন্টারনেট সংযোগ বন্ধ করা।”--বলেছেন বিবিসি’র ‘ভুয়া তথ্য’ বিভাগের শায়ান সারদারিজাদেহ।
“বিক্ষোভকারীদের সংগঠিত হওয়া, যোগাযোগ ও দেশের বাইরে তথ্য পাঠানোর মতো বিষয়গুলো ঠেকানোর জন্য ইন্টারনেট বন্ধ করে দেওয়া একটি মোক্ষম অস্ত্র।”
“ইরানের অর্থনীতি, ব্যবসা এবং জনসেবাও ব্যপক ক্ষতিগ্রস্থ হয় এই কারণে।”
“ইরান কর্তৃপক্ষ এর আগেও অনেকবার প্রমাণ দিয়েছে যে, অর্থনৈতিক ক্ষতি আর রাজনৈতিক অস্থিরতা ঠেকানোর মধ্যে একটি বাছাই করতে হলে, তারা সব সময় পরেরটিই বেছে নেবে।”
বিবিসির প্রতিবেদন অনুযায়ী, বিক্ষোভকারীর ওপর কঠোর ক্র্যাকডাউন ও ইন্টারনেট সংযোগ পুরোপুরি বন্ধ করার মাধ্যমে জনমত দমনের কৌশলে অতীতেও সফল হয়েছে ইরান।
তবে, শঙ্কা হচ্ছে, পরিস্থিতি শেষ পর্যন্ত ২০১৯ সালের পেট্রোলের মূল্য বৃদ্ধির বিক্ষোভের মতো কিছু একটা হয়ে যায় কি না। দেশটির ইতিহাসের সবচেয়ে রক্তক্ষয়ী বিক্ষোভ ছিল সেটি।
ওই আন্দোলনের সময় টানা বেশ কয়েকদিনের জন্য বন্ধ হয়ে যেত ইন্টারনেট সংযোগ।
ইরানের প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসি বলেছেন, বিক্ষোভের অনুমতি থাকলেও কোনো ‘দাঙ্গা’ সহ্য করা হবে না।
“ইরানে সব সময়ই বিক্ষোভ হয়ে এসেছে। বিক্ষোভকারীদের কথাও শোনা যাচ্ছে। তবে, বিক্ষোভকে দাঙ্গা থেকে পৃথক করতে হবে।” --বলেন তিনি।