“প্রচলিত ধারণা হল, এটা মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য খারাপ। তবে আমাদের সমন্বিত ডেটা বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, বিষয়টা আসলে এমন নয়।”
Published : 10 Aug 2023, 01:32 PM
সামাজিক মাধ্যম ফেইসবুকের বৈশ্বিক প্রসারের সঙ্গে মানসিক ক্ষতি ছড়ানোর সম্পৃক্ততার কোনো প্রমাণ খুঁজে পাওয়া যায়নি বলে উঠে এসেছে এক গবেষণায়।
‘অক্সফোর্ড ইন্টারনেট ইনস্টিটিউট (ওআইআই)’ পরিচালিত গবেষণাটির মূল বিষয় ছিল, কীভাবে সামাজিক মাধ্যমটির ব্যবহার বেড়ে যাওয়ার কারণে ৭২টি দেশের ব্যবহারকারীদের মানসিক অবস্থা বদলেছে।
গবেষকরা বলছেন, ‘সামাজিক মাধ্যম মানসিক স্বাস্থ্যের দৃষ্টিকোণ থেকে বিপজ্জনক’ -- এমন প্রচলিত ধারণার বিপরীত চিত্রই ফুটে উঠেছে এই গবেষণার মাধ্যমে।
সামাজিক মাধ্যম ব্যবহারকারীদের সম্ভাব্য অনলাইন ঝুঁকি ঠেকাতে নতুন আইন প্রণয়নের বিষয়টি বিবেচনায় রেখেছে যুক্তরাজ্য’সহ বেশ কয়েকটি দেশ।
কয়েকজন ফাঁসকারীর সাক্ষ্য ও সেগুলোর ভিত্তিতে প্রকাশিত বিভিন্ন সংবাদ প্রতিবেদন থেকে ইঙ্গিত মিলেছে, ফেইসবুকের মালিক কোম্পানি মেটার নিজস্ব গবেষণাতেই ব্যবহারকারীর ওপর এর নেতিবাচক প্রভাবের কথা উঠে এসেছে। এর পর থেকেই বেশ কয়েকবার তদন্তের মুখে পড়েছে কোম্পানিটি।
শুধু ফেইসবুকের ওপর চালানো এই গবেষণায় ইনস্টাগ্রাম’সহ মেটার অন্যান্য সামাজিক মাধ্যমকে টানা হয়নি।
ওআইআই’র অধ্যাপক অ্যান্ড্রু প্রজিবিলস্কি বিবিসিকে বলেন, “বিভিন্ন দেশে সামাজিক মাধ্যমের ব্যবহার বেড়ে যাওয়ায় সেইসব দেশের জনগণের মানসিক পরিস্থিতি কেমন দেখাচ্ছে?” গবেষণায় ওই প্রশ্নের জবাবও খোঁজা হয়েছে।
“প্রচলিত ধারণা হল, এটা মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য খারাপ। তবে আমাদের সমন্বিত ডেটা বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, আসলে বিষয়টা এমন নয়।”
এর আগেও এই বিষয়ে কাজ করেছেন অধ্যাপক প্রজিবিলস্কি। তাতে দেখা যায়, এই প্রযুক্তি ব্যবহারের সঙ্গে তরুণদের মানসিক স্বাস্থ্য সংক্রান্ত সমস্যাগুলোর সম্পর্ক খুবই অল্প।
তবে গবেষণাটিতে কেবল জাতীয় পর্যায়ে ফেইসবুক ব্যবহারের সামগ্রিক প্রভাব তুলে ধরা হয়। তবে, কোনো নির্দিষ্ট শ্রেণির মানুষের ওপর ফেইসবুক ব্যবহারের প্রভাব কেমন হতে পারে, তা প্রকাশ পায়নি এতে।
উদাহরণ হিসেবে, ব্যবহারকারীদের ছোট কোনো অংশে এর নেতিবাচক প্রভাব সম্ভবত ‘ঢেকে গেছে’ অন্যদের ওপর এর ইতিবাচক প্রভাবের কারণে। বিষয়টি স্বীকার করেছেন প্রজিবিলস্কি নিজেও।
এ ছাড়া, কিছু সুনির্দিষ্ট কনটেন্টে কী ধরনের ঝুঁকি থাকতে পারে, তা বিশ্লেষণ করা হয়নি গবেষণায়। উদাহরণ হিসেবে ধরা যায়, ‘নিজের ক্ষতি করে’ এমন কনটেন্টের প্রচারণা।
প্রজিবিলস্কি’র মতে, এই গবেষণায় তার জন্য মূল শিক্ষণীয় বিষয় ছিল, সামাজিক মাধ্যমের প্রভাব সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দিতে প্রযুক্তি কোম্পানিগুলোর কাছ থেকে তুলনামূলক উন্নত ডেটা পাওয়া উচিৎ ছিল গবেষকদের।
“আপনারা জানেন, আমরা এমন পরিস্থিতিতে আছি, যেখানে সামাজিক মাধ্যম নিয়ে অনেক লোকজন মায়াকান্না করছেন। তবে, আমাদের কাছে আসলে ওই ডেটা নেই। এমন মায়াকান্না শনাক্ত করার যন্ত্র তৈরির প্রয়োজনীয় উপাদানও নেই আমাদের কাছে।” --বলেন তিনি।
বিবিসি বলছে, যুক্তরাজ্যের ‘অনলাইন সুরক্ষা বিল (ওএসবি)’ অনুমোদিত আইন হয়ে ওঠার চূড়ান্ত পর্যায়ে আছে। আর এর নকশা হয়েছে মানুষকে অনলাইনের সম্ভাব্য ঝুঁকিগুলো থেকে সুরক্ষার উদ্দেশ্যে।
তবে ওএসবি’র এই সীমিত গবেষণার প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে সতর্ক করেছেন ‘লন্ডন স্কুল অফ ইকোনমিক্স’-এর অধ্যাপক সোনিয়া লিভিংস্টোন।
“স্ক্রিন টাইম সংশ্লিষ্ট উদ্বেগ নিয়ে তেমন শক্ত প্রমাণ নেই, সেটা নিয়ে লেখকের বিস্তৃত সমালোচনা থাকা দরকার ছিল। তবে, এই গবেষণা এতটাই সাধারণ যে এটি নিয়ন্ত্রক ও গঠনমূলক বিতর্কে খুব কমই কাজে লাগবে।” --বিবিসিকে বলেন তিনি।
বিবিসি বলছে, ওএসবি শিশুদের সুরক্ষার বিষয়ে গুরুত্ব দিলেও গবেষণায় কিশোর ব্যবহারকারীদের আলাদা দল হিসেবে বিবেচিত করা হয়নি। আর ‘বেশিরভাগ শিশু ফেইসবুক ব্যবহার করছে না’ এমন ধারণার ভিত্তিতে গবেষণাটি পরিচালিত হয়েছে।
“এটা আমাকে এক সম্মেলনের কথা মনে করিয়ে দেয়। সেখানে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল ‘গত অর্ধ শতাব্দিতে টেলিভিশনে কী পরিবর্তন এসেছে? সেখানে কীভাবে এর জবাব এক কথায় দেওয়া সম্ভব?” --বলেন সোনিয়া।
তবে বিস্তারিত তথ্যে চাওয়ায় গবেষকদের সমর্থন জানিয়েছেন তিনি।
অধ্যাপক প্রজিবিলস্কি ও সহ-লেখক মাট্টি ভুওরের ‘পিয়ার-রিভিউড’ গবেষণাটি তৈরি হয়েছে ফেইসবুকের দেওয়া বিশাল ডেটার ভিত্তিতে। তবে, এই দুই গবেষকের কোম্পানির সঙ্গে সম্পৃক্ততা নেই ও গবেষণাটি মেটার অর্থায়নে পরিচালিত হয়নি বলে প্রতিবেদনে লিখেছে বিবিসি।
গবেষকদের কাছে ফেইসবুকের দেওয়া ডেটায় দেখা গেছে, কীভাবে ২০০৮ সাল থেকে ২০১৯ সালের মাঝামাঝিতে প্রতিটি দেশে ব্যবহারকারীর সংখ্যা বেড়েছে। একে দুটি বয়সভিত্তিক পর্যায়ে ভাগ করা হয়। একটি ১৩-৩৪ বছর। আর অন্যটি ৩৫ থেকে ওপরে।
ওআইআই’র গবেষণা দল ওই ডেটাকে ইউনেস্কো’র ‘গ্যালপ পোল’ জরিপে উঠে আসা প্রায় ১০ লাখ মানুষের মানসিক স্বাস্থ্য সংশ্লিষ্ট তথ্যের সঙ্গে তুলনা করেছেন।
সবমিলিয়ে গবেষকরা বলছেন, সামাজিক মাধ্যমের ব্যবহার বেড়ে যাওয়া মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে, এমন কোনো প্রমাণ তারা খুঁজে পাননি।
ইংল্যান্ডের ‘বাথ স্পা ইউনিভার্সিটির’ মনোবিজ্ঞান ও যোগাযোগ বিভাগের অধ্যাপক পিটার এচেলস বলেন, ‘আলোচনার কেন্দ্রে থাকা’ গবেষণাটি বেশ চমকপ্রদ।
তিনি আরও যোগ করেন, লেখকরা বিষয়টি পরিষ্কার করেছেন যে গবেষণায় এর কারণ বা প্রভাব সম্পর্কে কিছুই উল্লেখ নেই। তবে, এর মাধ্যমে গবেষকদের জন্য বিভিন্ন প্রযুক্তি কোম্পানির ‘তথ্যের দরজা খুলে দেওয়ার গুরুত্ব’ ফুটে উঠেছে বলে উল্লেখ করেন তিনি।