ধর্মতত্ত্ব নিয়ে লেখাপড়ার উদ্দেশ্যে ‘ইউনিভার্সিটি অফ কেমব্রিজ’-এ ভর্তি হন ডারউইন। অথচ পরবর্তী সময়ে, সৃষ্টিবাদ নিয়ে প্রতিষ্ঠিত ধর্মীয় মতবাদকে চ্যালেঞ্জ করেছিলেন তিনি নিজেই।
Published : 11 Feb 2024, 06:18 PM
চার্লস রবার্ট ডারউইনের সঙ্গে সবার আগে যে শব্দগুচ্ছ কানে বাজে, তা হল বিবর্তন তত্ত্ব। তবে, তার বিশ্ব ভ্রমণ নিয়েও নানা সময় নানা গল্প শোনা গেছে। এর বাইরেও বেশ ঘটনাবহুল জীবন কেটেছে ডারউইনের।
আসুন, তার জন্মদিনে মিলিয়ে নেই তার কোন কোন গল্প জানা আছে আগে থেকেই –
১. একই দিনে জন্মেছিলেন এব্রাহাম লিংকন ও চার্লস ডারউইন
এব্রাহাম লিংকন ও ডারউইন দুজনই ১৮০৯ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি জন্মগ্রহণ করেন। তবে তাদের কাজের ক্ষেত্র ছিল বেশ ভিন্ন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ষোড়শ প্রেসিডেন্টের জন্ম কেনটাকি অঙ্গরাজ্যে কাঠের গুড়ি দিয়ে তৈরি একটি ঘরে। আর একইসময় কেনটাকি থেকে কয়েক হাজার কিলোমিটার পূর্বে অবস্থিত ইংল্যান্ডের প্রাচীন শহর শ্রুজব্রি বা শ্রোউজব্রি শহরের এক ধনী পরিবারে জন্ম হয় ডারউইনের।
২. বিবর্তন তত্ত্ব প্রকাশে ২০ বছরের অপেক্ষা
রাজকীয় নৌবাহিনীর জাহাজ ‘এইচএমএস বিগল’-এ ডারউইনের পাঁচ বছরের সমুদ্রযাত্রা শেষ হয়েছিল ১৮৩৬ সালে। এ যাত্রা ডারউইনের অমূল্য গবেষণা অর্থাৎ বিবর্তনে প্রকৃতিক নির্বাচনের তত্ত্বে উদ্দীপক হিসেবে কাজ করে। তবে তার এ যুগান্তকারী ধারণা মানুষ ও ধর্মযাজকদের মধ্যে শঙ্কা বাড়িয়ে দেয়। আর ১৮৫৮ সালের আগ পর্যন্ত বিবর্তন নিয়ে কোনো তত্ত্ব জনসমক্ষে উপস্থাপন করেননি তিনি।
পরবর্তীতে, ব্রিটিশ প্রকৃতিবিদ আলফ্রেড রাসেল ওয়ালেসের সঙ্গে একটি যৌথ ঘোষণার মাধ্যমে নিজের তত্ত্ব নিয়ে সাধারণ মানুষের কাছে যান ডারউইন। এর ঠিক পরের বছরই নিজের মূল কাজ “প্রাকৃতিক নির্বাচনের মাধ্যমে বিভিন্ন প্রজাতির উৎপত্তি বা জীবের সংগ্রামের মাধ্যমে টিকে থাকা” নিয়ে তথ্য প্রকাশ করেন তিনি।
৩. দীর্ঘদিন অসুস্থতায় ভুগেছেন ডারউইন
বিশ্ব ভ্রমণের লম্বা সফর শেষে ফিরে আসার পর ক্লান্ত হয়ে পড়েন ডারউইন। এর পর থেকেই একজিমা, বমি ভাব, মাথাব্যথা ও হৃদজনিত রোগের মতো দীর্ঘমেয়াদি অসুস্থতায় ভুগতে থাকেন তিনি।
এমন শারীরিক সমস্যা নিয়ে সারা জীবনই লড়াই করতে হয়েছে ডারউইনকে।
অনেকের ধারণা, ভ্রমণের সময় ডারউইন ‘চাগাস’ নামের এক পরজীবীবাহিত রোগে আক্রান্ত হন, যার ফলে তার হৃদযন্ত্রে সমস্যা দেখা দেয়। এমনকি শেষ পর্যন্ত এ রোগেই ডারউইনের মৃত্যু হয়েছিল।
৪. তালিকা বানিয়েছিলেন বিয়ের ভাল-মন্দ নিয়ে
এমনকি হৃদয় বা অনুভূতির বিষয়েও ডারউইনের যৌক্তিক মতবাদ রয়েছে। নিজের বিয়ের আগে অর্থাৎ ১৮৩৬ সালে বিয়ের ভাল-মন্দ দিক নিয়ে একটি তালিকা তৈরি করেছিলেন ডারউইন।
তালিকার ভাল দিকগুলোর মধ্যে ছিল– ‘বিয়ে’, ‘সন্তান,’ ‘নিত্যনতুন সঙ্গী (ও বৃদ্ধ বয়সে বন্ধু) ... বা কুকুরের চেয়ে ভাল কিছু’ ও ‘বাড়ির যত্ন নেওয়ার মতো কেউ’। আর মন্দ দিকের মধ্যে ছিল– ‘বিয়ে না করা’, ‘যেখানে সেখানে যাওয়ার স্বাধীনতা’, ‘ক্লাবে পটু পুরুষদের কথোপকথন’ ও ‘সময়ক্ষেপণ’।
ডারউইনের এই তালিকায় অবশ্য পারিবারিক বন্ধনের জন্য কাউকে বিয়ে করার কথা উল্লেখ না থাকলেও ১৮৩৯ সালে নিজের ফার্স্ট কাজিন এমা ওয়েজউডকে বিয়ে করেছিলেন ডারউইন।
৫. মেডিকেল স্কুল থেকে বেরিয়ে আসা
ডারউইনের বাবা একজন সফল ডাক্তার ছিলেন। ছেলেকেও নিজের মতো একজন সফল ডাক্তার বানাতে চেয়েছিলেন তিনি। ১৮২৫ সালের গ্রীষ্ম শেষে নিজ বাবার কাছে একজন শিক্ষানবিশ হিসাবে কাজ শুরু করেন ডারউইন। পরবর্তীতে, যুক্তরাজ্যের অন্যতম শীর্ষ ‘ইউনিভার্সিটি অফ এডিনবার্গ’-এর মেডিকেল স্কুলেও পড়তে গিয়েছিলেন তিনি।
তবে ডারউইন রক্তপাত ঘৃণা করতেন। এমনকি সে সময় মেডিকেল কলেজের বক্তৃতা শুনেও বিরক্ত হয়েছিলেন তিনি। এরই ধারাবাহিকতায়, নিজের বাবার স্বপ্নকে ধূলিসাৎ করে মেডিকাল স্কুল ছেড়ে দেন ডারউইন।
৬. ১৮ বছর ধরে ১০ পাউন্ডের নোটে ছিল ডারউইনের ছবি
২০০০ সালের শুরুতে ব্রিটিশ ১০ পাউন্ড নোটের পেছনে রাজকীয় জাহাজ ‘এইচএমএস বিগল’-এর একটি ছবি’সহ দাড়িওয়ালা ডারউইনের প্রতিকৃতি ছিল। সে নোটের পেছনে একটি ম্যাগনিফাইং লেন্স, ডারউইনের ভ্রমণে দেখা বিভিন্ন উদ্ভিদ ও প্রাণীও দেখা যেত।
তবে, ২০১৮ সালে এ ১০ পাউন্ডের নোট ছাপানো বন্ধ করে দেয় ‘ব্যাংক অফ ইংল্যান্ড’।
৭. ‘সারভাইভাল অফ দ্য ফিটেস্ট’ কথাটি তার নিজের নয়
বিবর্তনবাদের গুরুত্বপূর্ণ তত্ত্বটি ডারউইনের নিজের হলেও ‘সারভাইভাল অফ দ্য ফিটেস্ট’ শব্দটি আসলে প্রথম ব্যবহার করেছিলেন ইংরেজ দার্শনিক হার্বার্ট স্পেন্সার। ১৮৬৪ সালে প্রকাশিত বই ‘প্রিন্সিপালস অফ বায়োলজি’তে ডারউইনের জৈবিক ধারণার সঙ্গে নিজের অর্থনৈতিক ও সমাজতাত্ত্বিক তত্ত্বের যোগসূত্র খুঁজে বের করতে প্রথম এই ‘সারভাইভাল অফ দ্য ফিটেস্ট’ শব্দটি ব্যবহার করেন তিনি।
অন্যদিকে, ১৮৬৯ সালে নিজের বই ‘অরিজিন অফ দ্য স্পিশিজ’-এর পঞ্চম সংস্করণে প্রথমবারর মতো এই শব্দটির ব্যবহার করেন ডারউইন।
৮. সমাহিত হয়েছেন ওয়েস্টমিনস্টার অ্যাবিতে
ডারউইন ১৮৮২ সালের ১৯ এপ্রিল মারা যান। নিজের জীবনের শেষ ৪০ বছর কাটানো গ্রামে তাকে সমাহিত করার প্রস্তুতি শুরু করে ডারউইনের পরিবার।
তবে এর বিপরীতে, ডারউইনকে লন্ডনের ওয়েস্টমিনস্টার অ্যাবিতে সমাধিস্থ করার জন্য জোর প্রচার শুরু করেন তার বন্ধু ও সহকর্মীরা। সংবাদপত্র ও জনসাধারণের চাহিদার প্রেক্ষিতে ওয়েস্টমিনস্টারের তৎকালীন ডিন এই দাবি মেনে নেন। মৃত্যুর এক সপ্তাহ পর ইংল্যান্ডের সবচেয়ে শ্রদ্ধেয় গীর্জায় নিজের সহকর্মী বিজ্ঞানী জন হার্শেল ও আইজ্যাক নিউটনের পাশে সমাহিত করা হয় ডারউইনকে।
৯. ছিলেন ধর্মশাস্ত্রের ছাত্র
“আমি তখন বাইবেলের প্রতিটি শব্দের কঠোরতা ও আক্ষরিক সত্য নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করিনি,” পরবর্তী সময়ে লিখেছিলেন ডারউইন।
তবে বিশ্ব ভ্রমণ ও তিন সন্তানের মৃত্যুর পর ডারউইনের ধর্মীয় বিশ্বাস নড়বড়ে হতে শুরু করে। তিনি নিজেকে কখনোই নাস্তিক হিসেবে দাবি করেননি। এর পরিবর্তে, নিজেকে একজন অজ্ঞেয়বাদী হিসেবে উল্লেখ করেছেন তিনি।
অজ্ঞেয়বাদ হচ্ছে– এমন দার্শনিক চিন্তা বা ধারণা, যেখানে কোন ঈশ্বর বা পরমসত্ত্বা সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্ব বা নিরস্তিত্ব উভয়ই মানুষের অজানা ও এটি তাদের দ্বারা কখনও জানা সম্ভব হবে না।
১০. তার বইয়ের পূর্ণ নাম কী ছিল
সাধারণভাবে ‘দ্য অরিজিন অফ স্পিশিজ’ নামে বইটি পরিচিত হলেও ডারইউনের লেখা বইটির পূর্ণ নাম হচ্ছে - ‘অন দ্য অরিজিন অফ স্পিশিজ বাই মিনস অফ ন্যাচরাল সিলেকশন, অর দ্য প্রিজার্ভেশন অফ ফেভার্ড রেইসেস ইন দ্য স্ট্রাগল ফল লাইফ’।