অ্যাপলো মিশনে চন্দ্রপিঠে অবতরণের ৫০ বছর পর আবারও মানুষকে চাঁদে ফেরাতেই নাসার আর্টেমিস প্রকল্প। এই প্রকল্পকে মঙ্গল গ্রহে অভিযানের পূর্ব প্রস্তুতি হিসেবে দেখছে নাসা।
Published : 03 Sep 2022, 07:51 PM
কারিগরি ত্রুটিতে আর্টেমিস ওয়ান উৎক্ষেপণের প্রথম চেষ্টা স্থগিত হলেও, আবারও আঁটঘাট বেঁধে প্রস্তুতি নিয়েছে নাসা। মহাকাশ গবেষণা সংস্থাটি আর্টেমিস প্রকল্পের প্রথম মিশনে ওরিয়ন স্পেসক্রাফটবাহী এসএলএস রকেট দ্বিতীয়বারের মতো উৎক্ষেপণের চেষ্টা করবে শনিবার (বাংলাদেশ সময় রোববার রাত ১২টার পর)।
শুক্রবার সারাদিন নতুন প্রজন্মের এই রকেট উৎক্ষেপণের পূর্ব প্রস্তুতির সকল কাজ সেরেছেন ফ্লোরিডার কেনেডি স্পেস সেন্টারের কর্মীরা। এর পরও ত্রুটি যেন পিছু ছাড়ছে না এই অভিযানের। উৎক্ষেপণের কয়েক ঘণ্টা আগেই তরল হাইড্রোজেন সরবরাহ ব্যবস্থার লিক সারানোর জন্য জ্বালানীর সরবরাহ বন্ধ রেখেছিলেন নাসার কারিগরি বিভাগের কর্মীরা।
এর আগে শনিবার বিকেলে ৩২ তলা ভবন সমান উঁচু ‘স্পেস লঞ্চ সিস্টেম (এসএলএস)’ রকেট এবং ওরিয়ন স্পেস ক্যাপসুলে করে নাসার ‘মুন-টু-মারস’ আর্টেমিস প্রকল্পের প্রথম অভিযান শুরু করার সবুজ সংকেত দিয়েছিলেন পরিচালকরা।
অ্যাপলো মিশনে চন্দ্রপিঠে অবতরণের ৫০ বছর পর আবারও মানুষকে চাঁদে ফেরাতেই নাসার আর্টেমিস প্রকল্প। এই প্রকল্পকে মঙ্গল গ্রহে অভিযানের পূর্ব প্রস্তুতি হিসেবে দেখছে নাসা।
আর্টেমিস ওয়ান সোমবারে মহাকাশে পাঠানোর পরিকল্পনা থাকলেও প্রথম প্রচেষ্টায় জ্বালানীর ট্যাংকের সংযোগ স্থলে ফাঁটল এবং একটি ইঞ্জিনে যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে উৎক্ষেপণের ৪০ মিনিট আগে তা স্থগিত করেছিল নাসা।
বার্তাসংস্থা রয়টার্স জানিয়েছে যন্ত্রবিদরা জ্বালানীর ট্যাংকের সংযোগ স্থলে ফাঁটলটি সারানো বৃহস্পতিবারের পরীক্ষাতেই নিশ্চিত হয়েছেন বলে জানিয়েছেন কেনেডি স্পেস সেন্টারের সহকারী প্রকল্প ব্যবস্থাপক জেরেমি পারসনস।
উৎক্ষেপণের ওই চেষ্টা আটকে যাওয়ার পেছনে অন্য কারণের মধ্যে ছিল একটি ইঞ্জিনের ত্রুটিপূর্ণ সেন্সর ও ইনসুলেশন ফোমে ফাঁটল। নাসার মান অনুযায়ী ওই ত্রুটিগুলোরও সমাধান করা হয়েছে বলে বৃহস্পতিবার রাতেই সংবাদ কর্মীদের জানিয়েছেন আর্টেমিস ওয়ান মিশনের ব্যবস্থাপক মাইক সারাফিন।
উৎক্ষেপণের দ্বিতীয় চেষ্টার দিন তারিখ ঘোষণার সময়ে নাসার শঙ্কা ছিল শনিবারের আবহাওয়া নিয়ে। সর্বশেষ ‘ইউএস স্পেস ফোর্স’-এর বরাত দিয়ে রয়টার্স জানিয়েছে, রকেট উৎক্ষেপণের সময় অনুকূল আবহাওয়া থাকার সম্ভাবনা ৭০ শতাংশ।
ফ্লোরিডার স্থানীয় সময় শনিবার বেলা দুইটা ১৭ মিনিট (বাংলাদেশ সময় রোববার রাত ১২টা ১৭ মিনিট) থেকে পরের দুই ঘণ্টার মধ্যে ওরিয়নবাহী এসএলএস রকেট উৎক্ষেপণের সুযোগ থাকবে নাসার হাতে। কোনো কারণে দ্বিতীয় চেষ্টাও ব্যর্থ হলে সোমবার বা মঙ্গলবার আবারও আর্টেমিস ওয়ান উৎক্ষেপণের চেষ্টা করবে মাহাকাশ গবেষণা সংস্থাটি।
মানব নভোচারীবাহী অ্যাপলো মিশনগুলোর পর দীর্ঘদিন নাসা ব্যস্ত ছিল নিজস্ব স্পেস শাটল প্রকল্প আর ইন্টারন্যাশনাল স্পেস সেন্টার (আইএসএস) নির্মাণের কাজে। নাসার অ্যাপলো পরবর্তী অধ্যায়ে বড় অগ্রগতির আগাম বার্তা দিচ্ছে আর্টেমিস ওয়ান মিশন।
১৯৬৯ সাল থেকে ১৯৭২ সালের মধ্যে ছয়টি অ্যাপলো মিশনে সর্বমোট ১২ জন নভোচারীকে চাঁদে পাঠিয়েছিল নাসা। চাঁদে নভোচারীদের ফেরাতে স্পেসএক্স এবং ইউরোপ, কানাডা এবং জাপানের মহাকাশ সংস্থাগুলোর সঙ্গে জোট বেঁধেছে নাসা।
ভবিষ্যতে রেড প্ল্যানেট খ্যাত মঙ্গলে মানব নভোচারী পাঠানোর স্বপ্ন বাস্তবায়নের প্রথম পদক্ষেপ হতে যাচ্ছে আর্টেমিস। আর এ প্রকল্পের প্রথম গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হতে যাচ্ছে ওরিয়নবাহী এসএলএস রকেটের সফল উৎক্ষেপণ।
এই মিশন সফল হলে ২০২৪ সালের মধ্যে চাঁদে ‘আর্টেমিস ২’ পাঠাতে পারে নাসা। পরবর্তী কয়েক বছরের মধ্যে ‘আর্টেমিস ৩’ অভিযানে চাঁদে প্রথম নারী নভোচারী পাঠানোর পরিকল্পনা রয়েছে সংস্থাটির।
আপোলো’র ‘স্যাটার্ন ৫’ রকেটের পরবর্তী সময়ে সবচেয়ে উচু লঞ্চ সিস্টেম ব্যবহৃত হচ্ছে বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী ও জটিল রকেট হিসেবে পরিচিত এসএলএস-এর উৎক্ষেপণে।
উৎক্ষেপণে রকেটের চারটি মূল ‘আর-২৫’ ইঞ্জিন ও রকেট বুস্টার দুটি তৈরি করতে পারে ৮৮ লাখ পাউন্ডের ধাক্কা, যা ‘স্যাটার্ন ৫’ রকেটের চেয়েও ১৫ শতাংশ বেশি। রকেটটির উৎক্ষেপণ হবে এই থ্রাস্টারের সহায়তায়।
উৎক্ষেপণের প্রায় ৯০ মিনিট পর রকেটের ওপরের অংশ ওরিয়ন ক্যাপসুলকে ঠেলে নিয়ে যাবে পৃথিবীর কক্ষপথের বাইরে। ৩৭ দিনের এই যাত্রায় প্রথমে চন্দ্রপৃষ্ঠের ৬০ মাইলের মধ্যে পৌঁছাবে এই ক্যাপসুল। এর পর চাঁদ ছাড়িয়ে আরও ৪০ হাজার মাইল পথ পেরোনোর পর পৃথিবীর দিকে ফিরে আসবে এটি।
রয়টার্সের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ক্যাপসুলটি প্রশান্ত মহাসাগরে অবতরণ করার সম্ভাবনা রয়েছে ১১ অক্টোবর।
এই অভিযানে মানুষ না গেলেও দুইজন নারী ও একজন পুরুষের ‘ডামি’ বহন করবে ওরিয়ন। চন্দ্রযাত্রায় মহাকাশের বিকিরণ আর অন্যান্য পরিস্থিতি মানব নভোচারীদের ওপর কেমন প্রভাব ফেলতে পারে, সে তথ্য সংগ্রহের জন্য ডামিগুলোর সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হয়েছে বিশেষ সেন্সর।
এ ছাড়াও, ওরিয়ন ক্যাপসুলে ‘হিট শিল্ডের’ স্থায়িত্ব যাচাই করা এই অভিযানের মূল লক্ষ্যগুলোর একটি বলে জানিয়েছে রয়টার্স। পৃথিবীতে ফেরার সময় প্রতি ঘন্টায় সাড়ে ২৪ হাজার মাইল বেগে বা শব্দের গতির চেয়ে ৩২ গুণ দ্রুতগতিতে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলকে আঘাত করবে এটি।
পৃথিবীতে ফেরার সময়ে বায়ুমণ্ডলের সঙ্গে ঘর্ষণের ফলে ক্যাপসুলের বাইরের তাপমাত্রা দুই হাজার ৭৬০ ডিগ্রি সেলসিয়াসে পৌঁছাতে পারে বলে ধারণা করছে নাসা। এই তাপ সহ্য করার উপযোগী করেই ওরিয়নের ‘হিট শিল্ড’ নির্মাণের চেষ্টা করেছে সংস্থাটি।
এসএলএস-ওরিয়ন নভোযানের নকশা, নির্মাণ ও পরীক্ষার পেছনে এখন পর্যন্ত নাসা অন্তত তিন হাজার সাতশ কোটি ডলার খরচ করেছে বলে জানিয়েছে নাসা।
২০২৫ সাল নাগাদ আর্টেমিস প্রকল্পের খরচ নয় হাজার তিনশ কোটি ডলারে গিয়ে দাঁড়াবে বলে ধারণা করছে নাসা।