সমুদ্রের প্লাস্টিক বর্জ্য সরানোয় যেভাবে পথ দেখাচ্ছে প্রযুক্তি

“আমাদের প্রায় এক হাজার নদী ও পাঁচ মহাসাগরের বর্জ্যের স্তুপ ঠেকাতে হবে। আর সমস্যাটি বুঝতেই আমার প্রথম কয়েক বছর লেগে গেছে।”

প্রযুক্তি ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 27 Feb 2023, 12:34 PM
Updated : 27 Feb 2023, 12:34 PM

সামুদ্রে প্লাস্টিক দূষণ সমাধানের উদ্যোগ এখন ‘দীর্ঘ আর বেদনাদায়ক’ এক যাত্রা হয়ে দাঁড়িয়েছে ডাচ এক উদ্যোক্তার কাছে। তবে, আশা হারিয়ে ফেলেননি তিনি।

প্রায় এক দশক ধরে প্রশান্ত মহাসাগর থেকে প্লাস্টিক বর্জ্য সরানোর বিভিন্ন উপায় নিয়ে কাজ করছেন বোয়ান স্ল্যাট নামের এই উদ্যোক্তা। আর ‘ওশন ক্লিনআপ’ নামে অলাভজনক পরিবেশ সংগঠনও প্রতিষ্ঠা করেছেন এই ২৮ বছর বয়সী তরুণ।

বিবিসিকে তিনি বললেন, যা ধারণা করেছিলেন, এটা তার চেয়েও অনেক কঠিন।

“গ্রহটি আসলে অনেক বড়।” --বলেন তিনি।

“আমাদের প্রায় এক হাজার নদী ও পাঁচ মহাসাগরের বর্জ্যের স্তুপ ঠেকাতে হবে। আর সমস্যাটি বুঝতেই আমার প্রথম কয়েক বছর লেগে গেছে।”

সামুদ্রে জমে থাকা পরিত্যাক্ত প্লাস্টিকের সবচেয়ে বড় জঞ্জালটি পরিচিত ‘দ্য গ্রেট প্যাসিফিক গারবেজ প্যাচ’ নামে। আর এটি রয়েছে উত্তর প্রশান্ত মহাসাগরে।

এই জঞ্জালের মধ্যে রয়েছে বড় মাছ ধরার জাল থেকে শুরু করে মাইক্রোপ্লাস্টিকও। আর এটাকেই মূল টার্গেট বানিয়েছে ‘ওশন ক্লিনআপ’ দল।

প্লাস্টিক ধরা জাল!

বর্জ্য আটকাতে ওশন ক্লিনআপ দল দীর্ঘ, ইউ-আকৃতির এক কাঠামো ব্যবহার করে, যা দেখতে অনেকটা মাছ ধরা জালের মতো। আর দুপাশে দুটি নৌকার মাধ্যমে বিভিন্ন বর্জ্যের স্তুপ টানা হয়। জলজ প্রাণিদের যেন সমস্যা না হয়, তা নিশ্চিত করার জন্য ধীরে ধীরে চলে এটি।

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) চালিত ক্যামেরার মাধ্যমে সামুদ্রিক পৃষ্ঠে ক্রমাগত স্ক্যান করে সেটি আগে থেকে করে রাখা কম্পিউটার মডেলগুলোর সঙ্গে সমন্বয় করে দলটি। এর ফলে, প্রশান্ত মহাসাগরের কোন কোন এলাকা টার্গেট করতে হবে, তা ঠিক করা অনেকটাই সহজ হয়ে যায়।

“আপনি গ্রেট প্যাসিফিক গার্বেজ প্যাচের দিকে তাকালে লক্ষ্য করবেন, এতে এমন কয়েকটি জায়গা আছে, যেখানে প্লাস্টিকের ঘনত্ব অনেক বেশি। আবার কিছু জায়গা একেবারেই খালি।” --বলেন তিনি।

“আমরা যদি এই হটস্পটগুলো ক্রমাগত পরিষ্কার করতে থাকি, তাহলে অনেক বেশি প্রভাব রাখা সম্ভব হবে।”

প্লাস্টিক বন্দী করার এই আটশ মিটার দীর্ঘ ব্যবস্থা প্রস্তুতকারক কোম্পানির তৈরি এই ধরনের দ্বিতীয় উদ্ভাবন। আর এই প্লাস্টিক পর্যায়ক্রমে সমুদ্র থেকে তুলে এনে রিসাইকল করা হয়।

বোয়ান বলেন, এই ব্যবস্থার মাধ্যমে এখন পর্যন্ত প্রায় দুইশ টন সামুদ্রিক প্লাস্টিক পরিষ্কার হয়েছে।

এটি বিশ্বের সবচেয়ে বড় প্লাস্টিক স্তুপে থাকা এক লাখ টন আবর্জনার কেবল পাঁচশ ভাগের এক ভাগ। তারপরও তিনি একে পজিটিভ ভাবেই দেখতে চান - “প্রতিটি বড় ঘটনাই তো শুরু হয় ছোট থেকে, তাই না?”

দলটির আশা, বছরের শেষ নাগাদ চলতি ব্যবস্থা ব্যবহার করে বর্জ্যের স্তুপ থেকে এক শতাংশ তুলে আনা যাবে। তবে, তুলনামূলক দ্রুত বর্জ্য পরিষ্কারের স্বার্থে দলটির কার্যক্রম বাড়ানোর কথা উঠে এসেছে বিবিসি’র প্রতিবেদনে।

‘সিস্টেম ৩’ নামে নতুন ব্যবস্থা তৈরি করছে উদ্যোক্তা দলটি। দুই দশমিক চার কিলোমিটার দীর্ঘ বিশাল এই প্রতিবন্ধক ব্যবস্থা চালু হবে আসন্ন গ্রীষ্মে।

‘ওশন ক্লিনআপ’-এর অনুমান বলছে, এমন দশটি বিশালাকারের সিস্টেম চালু করলে এই দশকের শেষে উত্তর প্রশান্ত মহাসাগরের ৮০ শতাংশ প্লাস্টিক বর্জ্য পরিষ্কার করা সম্ভব হবে।

স্রোতের শুরু যেখানে

২০২১ সালে করা কোম্পানির গবেষণায় দেখা গেছে, বৈশ্বিক সামুদ্রিক প্লাস্টিক দূষণের ৮০ শতাংশেরই উৎস বিশ্বের প্রায় এক হাজার নদী।

“নদীগুলো আসলে এমন ধমনী, যা ভূমি থেকে সমুদ্রে আবর্জনা বহন করে।” --বলেন বোয়ান।

“ফলে, যখন বৃষ্টি হয়, তখন প্লাস্টিক রাস্তা থেকে খাঁড়িতে, এর পর নদীতে ও শেষ পর্যন্ত ভেসে যায় সমুদ্রে।”

তিনি আরও বলেন, নদীর স্রোত বেশি হলে প্লাস্টিক প্রবাহ বন্ধ করা আগের চেয়েও জটিল হয়ে উঠতে পারে।

“নদীতে আপনি প্লাস্টিক আটকানোর কেবল একটি সুযোগ পাবেন। প্রবাহের সময় না ধরলে, নিশ্চিতভাবেই সমুদ্রে গিয়ে পড়ে এগুলো।” --বলেন তিনি।

সমুদ্রে পৌঁছানোর আগে, নদী থেকে বর্জ্য ধরার প্রচেষ্টায় নিজেদের ‘ইনটারসেপ্টর’ নামের ব্যবস্থা ব্যবহার করে কোম্পানিটি।

এই প্রযুক্তি পরিবর্তিত হয় নদীর প্রস্থ, গভীরতা, প্রবাহের গতি ও আবর্জনার ধরনের মতো বিষয়গুলোর ওপর ভিত্তি করে। আর এআই চালিত ক্যামেরা ব্যবহারের মাধ্যমে এগুলো মূল্যায়ন করা হয়।

এমন বেশিরভাগ স্থাপনাই পানি থেকে বর্জ্য নিষ্কাশনের উদ্দেশ্যে ‘পরিবাহক বেল্ট’ ব্যবহার করে।

“আমরা বিশ্বের ১১টি নদীতে প্লাস্টিক আটকাচ্ছি।” --বলেন বোয়ান।

“তবে, শেষ পর্যন্ত বিশ্বের এক হাজার দূষিত নদীতে আমারা এই ব্যবস্থা চালু করব, এটা লক্ষ্য আমাদের।”

‘স্টপিং দ্য ট্যাপ’

২০১৮ সালে যুক্তরাজ্যের অলাভজনক সংস্থা ‘ন্যাশনাল ওশিয়ানোগ্রাফি সেন্টারের’ অধ্যাপক রিচার্ড ল্যামপিট বিবিসিকে বলেন, তার অনুমান বলছে, সমুদ্রের আবর্জনার প্যাচ থেকে বন্দরে জাল ও শাটল প্লাস্টিক টানতে জলযান ব্যবহার করলে তাতে আবার উচ্চমাত্রায় কার্বন নির্গমনের শঙ্কা আছে।

এতো বছর পর তিনি বলছেন, এই বিষয়ে তার সন্দেহ এখনও না কাটলেও নদীর আবর্জনা লক্ষ্য করে চালানো এই কার্যক্রম তার কাছে তুলনামূলক ইতিবাচকই মনে হয়েছে।

“নদীভিত্তিক কার্যক্রমে পরিবেশগত খরচ অনেক, অনেক কম।” --বলেন তিনি।

“কোনো যন্ত্র খুঁজে পেতে আপনাকে আর দেড় হাজার কিলোমিটার পথ পাড়ি দিতে হয় না।”

সামুদ্রিক ‘বাস্তুতন্ত্রে’ মাইক্রোপ্লাস্টিকের ঝুঁকির বিষয়টি চিহ্নিত করে ল্যামপিট বলেন, তিনি মনে করেন, সমুদ্রে প্লাস্টিক পরিষ্কারের বদলে বিভিন্ন উপাদানের প্রবাহ বন্ধ করা ও এগুলো সমুদ্রে না পৌঁছাতে দেওয়াটাই মূল চ্যালেঞ্জ।

“আমি কোনোভাবেই মেলাতে পারি না, আপনি খাদ্য চেইনের ব্যাপক ক্ষতি না করে সমুদ্র ও প্রকৃতি থেকে এগুলো অপসারণ করতে পারবেন। আর এটি করতে গিয়ে প্রচুর শক্তি খরচের বিষয়টি তো আছেই।”

বিবিসির প্রতিবেদন অনুযায়ী, বিশ্বের সামুদ্রিক দূষণ সমাধান নিঃসন্দেহে কঠিন। আর প্রথমত এটি প্লাস্টিকের উৎপাদন ও ব্যবহার বন্ধের ওপর নির্ভর করে। তবুও এর ভবিষ্যৎ নিয়ে উচ্চাশা রয়েছে বোয়ানের।

“আমি আসলেই মনে করি, এই ধরনের প্রযুক্তির সহায়তায় সামুদ্রিক দূষণ পরিষ্কার ও সমুদ্রে পৌঁছানোর আগেই নদীতে প্লাস্টিক আটকানো যাবে।”

“এমন ঘটলে অদূর ভবিষ্যতে আমরা নিজেদের কার্যক্রম গুটিয়ে নিতে পারবো।”