ধর্মীয় কট্টরপন্থিরা অনেক সময় এসব বারকোডকে বর্ণনা করেছেন বাইবেলে বর্ণিত ‘মার্ক অফ দ্য বিস্ট’ বা ‘পশুর চিহ্ন’ হিসেবে।
Published : 22 Oct 2024, 04:25 PM
লেজার দিয়েই না কি দাম টুকে রাখবে কম্পিউটার, যোগ হতে থাকবে ক্যাশ মেমোতে। এমন ভবিষ্যতের সম্ভাবনায় লোকজনের চোখ কপালে উঠে গিয়েছিল ১৯৬৯ সালে।
পাঁচ দশক পর এই লেজার ছাড়া এখন কোনও সুপারমার্কেটের কর্মীকে চিন্তাও করা যায় না। লেজার, সঙ্গে স্ক্যানার আর ছোট পিস্তল চেহারার লেজার বন্দুকও।
“এই লেজারের মাধ্যমেই পয়েন্ট, শুট ও সেল হবে ক্রেতাদের কেনা বিভিন্ন পণ্য।” - বারকোড যুগের শুরুতে জোর দিয়ে বলেছিলেন পল ম্যাকেনরো।
লেজারের মাধ্যমে বিভিন্ন পণ্যে থাকা অদ্ভুত ডিজাইনের ছোট ও কালো-সাদা রঙের চিহ্ন স্ক্যান করবেন আমেরিকান বহুজাতিক প্রযুক্তি কোম্পানি ‘আইবিএম’-এর গ্রুপ ডিরেক্টর ম্যাকেনরো ও তার সহকর্মীরা। এতে সুপারমার্কেটের কাজে গতি আসবে বলেও উৎসাহ দেন তিনি। আর এটিই পরবর্তী সময়ে বারকোড হিসাবে পরিচিতি পায়।
লেজার প্রযুক্তির প্রথম বাণিজ্যিক প্রয়োগ, বারকোড স্ক্যানার ও স্টক কিপিং ইউনিট চিহ্নিতকরণের জন্য ম্যাগনেটিক কোড তৈরি করেন প্রকৌশলী ম্যাকেনরো।
বানর বৃত্তান্ত
ইতিহাসের ওই মুহুর্তে বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহার হয়নি এসব বারকোড। লেজারের ব্যবহার নিয়ে আইবিএম-এর আইনজীবীদের মধ্যে ভয় ছিল। কেউ যদি ইচ্ছা করেই এই কারো চোখে তাক করে! শেষ পর্যন্ত বানরের চোখে লেজার রশ্মি পরীক্ষা করেন গবেষকরা। আর সেই বানর তারা এনেছিলেন আফ্রিকা থেকে। ইতিহাসের পাতায় তাই রেসাস প্রজাতির বানরের নাম লেখা হয়ে গেল প্রথম বারকোড লেজারের সঙ্গে।
এখন অবসর জীবন কাটানো ম্যাকেনরো মাঝেমধ্যেই মনে করেন সেই সময়ের কথা।
“আমার যতদূর মনে পড়ে ছয়টি বানর ছিল। এদের নিয়ে আমরা পরীক্ষা করি। দেখা গেল, লেজার প্রাণীদের চোখের কোনো ক্ষতি হয় না। এরপর নরম হলেন আইনজীবীরা।”
“তাদের আসলে ভয় ছিল লেজারে কারো ক্ষতি হয়ে গেলে মামলায় পড়ে যাবে আইবিএম।”
এভাবেই যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে বিভিন্ন সুপারমার্কেটে ও শেষ পর্যন্ত গোটা বিশ্বে সাধারণ বিষয় হয়ে ওঠে বারকোডের স্ক্যানিং। এসব বানরের পাশাপাশি আইবিএম-এ ম্যাকেনরোর দলের প্রতিটি মানুষও ‘ইউনিভার্সাল প্রোডাক্ট কোড বা ইউপিসি’-এর জন্য কৃতিত্বের দাবিদার। কারণ তাদের এ সংস্করণটিই আনুষ্ঠানিকভাবে বারকোডের স্ট্যান্ডার্ড হয়ে ওঠে।
কীভাবে এল বারকোড
ম্যাকেনরোর এ দলের মধ্যে ছিলেন প্রকৌশলী জো উডল্যান্ড। আজ থেকে কয়েক দশক আগে সমুদ্র সৈকতের বালিতে আঁকিবুকি করার সময় তার মাথায় প্রথম এই বারকোডের ধারণাটি আসে বলে প্রতিবেদনে লিখেছে বিবিসি। ১৯৪৯ সালের অক্টোবরে উডল্যান্ড ও আরেক প্রকৌশলী বারকোডের মৌলিক ধারণাটি দেন ও তা তৈরির জন্য আবেদন করেন।
সেই সময় জর্জ লরার ও আইবিএম দলের অন্যান্য সদস্যরা বারকোডের এ প্রস্তাবটি সাদরে গ্রহণ করেন। প্রথমদিকে কালো, উল্লম্ব রেখার একটি আয়তক্ষেত্র হিসাবে বারকোডের ডিজাইন করেন আইবিএম প্রকৌশলীরা, যা যেকোনও সুপারমার্কেটের পণ্যকে আলাদাভাবে শনাক্ত করতে সক্ষম।
এদিকে, আনুষ্ঠানিকভাবে মুদি শিল্পে ইউপিসি বা বারকোডের ব্যবহার শুরু হয় ১৯৭৩ সালে। যুক্তরাষ্ট্রের ওহাইও অঙ্গরাজ্যের ট্রয় শহরের ‘মার্শ সুপারমার্কেট’ নামের এক মুদির দোকানে ১০ গ্রামের চিউয়িংগামের প্যাকেটে প্রথমবারের মতো স্ক্যান করা হয় বারকোড। সেখান থেকে বিশ্ব জয় করে এই বারকোড।
ব্যবহার বৃদ্ধি পেলেও বিতর্কের উর্ধ্বে ছিল না বারকোড। ম্যাকেনরো বলেন, “আমাদের প্রথম দোকানটি আমরা খুলতে পারিনি। কারণ, আমাদের দোকানের বাইরে কিছু লোক প্রতিবাদ করছিল। তাদের ধারণা, বারকোডের কারণে পণ্যের দামে স্বচ্ছতার অভাব হতে পারে। এমনকি এই স্ক্যানিং প্রযুক্তি সুপারমার্কেটের চাকরিকেও হুমকির মুখে ফেলছে বলে এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেন কিছু শ্রমিক।”
এমনকি কুসংস্কার
এসব আশঙ্কা অচিরে দূর হয়ে গেলেও সবসময়ই কিছু মানুষ বিরক্তবোধ করেছে বারকোড নিয়ে। কারণ, ধর্মান্ধ গুটিকয়েক মানুষের কাছে এসব বারকোড ছিল অশুভ শক্তি।
২০২৩ সালে বারকোডের ইতিহাস নিয়ে একটি বই প্রকাশ করেন যুক্তরাষ্ট্রের সাউথ ক্যারোলিনার ‘ক্লেমসন ইউনিভার্সিটি’র যোগাযোগ বিভাগের অধ্যাপক জর্ডান ফ্রিথ। তিনি বলেন, ধর্মীয় কট্টরপন্থিরা অনেক সময় এসব বারকোডকে বর্ণনা করেছেন বাইবেলে বর্ণিত ‘মার্ক অফ দ্য বিস্ট’ বা ‘পশুর চিহ্ন’ হিসেবে।
এদিকে, ধর্মপ্রচারক লেখক মেরি স্টুয়ার্ট রেলফে ১৯৮২ সালে দাবি করেন, প্রতিটি বারকোডের উভয় প্রান্তে ও মাঝখানে লাইনের মধ্যে ‘লুকিয়ে’ আছে ৬৬৬ নম্বরটি।
আসলে এসব ‘গার্ড লাইন’কে প্রতিটি ইউপিসি ক্রমের শুরু ও শেষ বাছাই করতে লেজার স্ক্যানারকে সহায়তা করতে রেফারেন্স পয়েন্ট হিসাবে কাজ করে। সেই সময় এতে অশুভ কিছু নেই ও ছয় নম্বরটি এনকোড করতে ব্যবহৃত প্যাটার্নের সঙ্গে মিলে যাওয়ার বিষয়টি একটি কাকতালীয় ঘটনা বলে উল্লেখ করে আইবিএম কর্মীরা।
চ্যালেঞ্জ আছে আজও
কখনও কখনও বারকোডকে খারাপ উদ্দেশ্যে ব্যবহার করেন অনেকে। সাইবার হামলা বা হ্যাকিংয়ের ক্ষেত্রেও ব্যবহার হয় বারকোডের। যুক্তরাজ্যের ‘ন্যাশনাল সাইবার সিকিউরিটি সেন্টার’ দেশের নাগরিকদের কিউআর কোড ব্যবহারে সতর্ক থাকতে বলেছে।
গত সেপ্টেম্বরে লেবাননভিত্তিক সশস্ত্র গোষ্ঠী হিজবুল্লাহ অভিযোগ করেছে, বিপজ্জনক বারকোড রয়েছে এমন লিফলেট ছড়াচ্ছে ইসরায়েল, কিছু খবরের প্রতিবেদন এটিকে কিউআর কোড হিসেবে উল্লেখ করেছে, যা স্ক্যান করার মাধ্যমে যে কারো ব্যক্তিগত তথ্য হাতিয়ে নেওয়া সম্ভব।
পৃথিবীর সীমানা ছাড়িয়ে মহাকাশেও ব্যবহার হচ্ছে বারকোড। আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনের নভোচারীরা টুল ও বিভিন্ন যান্ত্রিক অংশ শনাক্তে বারকোড স্ক্যানার ব্যবহার করেন। এমনকি নভোচারীদের খাদ্য গ্রহণ বা পান করার পাশাপাশি তাদের রক্ত, লালা ও প্রস্রাবের নমুনা শনাক্ত করতেও ব্যবহার হয় বারকোডের।
পৃথিবীতেও এসব বারকোড জীবন বাঁচিয়েছে অনেকের। রক্তের নমুনা, ওষুধ ও প্রতিস্থাপনের মতো চিকিৎসায় বিভিন্ন ডিভাইস ট্র্যাক করতে বারকোডিং সিস্টেম ব্যবহার করে বিভিন্ন হাসপাতাল। যুক্তরাজ্যের ‘ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিস বা এনএইচএস’-এর বারকোড নিয়ে একটি ‘স্ক্যানফোরসেফটি’ প্রোগ্রাম রয়েছে, যা কোনও কিছু ট্র্যাক করতে বারকোডের ব্যবহারকে প্রচার করে চলেছে।
বর্তমান বিশ্বে সবখানেই ব্যবহার হচ্ছে বারকোড। গেইমারদের ভাল অভিজ্ঞতা দিতে গেইম ডিজাইনের জন্যও ব্যবহার হয়েছে বারকোডের। ২০০০ দশকের গোড়ার দিকে হ্যান্ডহেল্ড ভিডিও গেইম তৈরিতে ব্যবহার হয়েছে বারকোড।
আইবিএম-এ ম্যাকেনরো ও তার দলের কাজ ছাড়া এর কিছুই সম্ভব হতো না। বর্তমানে ‘সানরাইজ ২০২৭’ নামে নতুন ডিজাইনের বারকোডের প্রস্তাব করা হয়েছে, যেটি আরও তথ্যসহ বারকোড এনকোড করার অনুমতি দেবে। এতে পণ্যের মেয়াদোত্তীর্ণ তারিখ থেকে শুরু করে ব্যবহারের নির্দেশিকাও যোগ হবে।
বারকোডের এই অদ্ভুত ও বিস্ময়কর যাত্রা আমাদের মনে করিয়ে দেয়, প্রযুক্তির এই ছোট্ট অগ্রগতি কীভাবে বৃহত্তর স্বার্থে কাজে লাগানো যেতে পারে।