আগে শীর্ষ প্রযুক্তি কোম্পানিগুলো ব্যবহারকারীর “লাইক”, আগ্রহ, মেজাজ, অভ্যাস সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করতে পারতো না, সে সীমাবদ্ধতাই আবার জুড়ে দেবে এ আইন।
Published : 01 Jul 2024, 07:05 PM
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম আসক্তি এখন বিশ্বব্যাপী সমস্যা। পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তের, নানান স্তরের মানুষের হাতের মুঠোয় রয়েছে সোশাল মিডিয়া ব্যবহারের সুযোগ। আর অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যাচ্ছে রাশ টানতে পারছেন না কখন একে দূরে সরাতে হবে।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম আসক্তির সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে রয়েছে শিশু-কিশোররা। এরই ধারাবাহিকতায় সম্প্রতি শিশুদের জন্য “আসক্তিমূলক’ সোশাল মিডিয়া ফিড নিয়ে আইন পাস করেছে মার্কিন অঙ্গরাজ্য নিউ ইয়র্ক।
তবে, এ আইন নিয়ে রয়েছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া। আইনটির প্রকৃত অর্থ নিয়ে কিছু গবেষক প্রশ্নও তুলেছেন বলে প্রতিবেদনে লিখেছে বিবিসি।
নিউইয়র্কের গভর্নর ক্যাথি হোচুল এ মাসের শুরুর দিকে সোশাল মিডিয়া সম্পর্কে তার মতামত সম্পর্কে স্পষ্ট ছিলেন। অনলাইনের ঝুঁকি থেকে ১৮ বছরের কম বয়সীদের রক্ষা করার জন্য তৈরি অঙ্গরাজ্যের দুটি নতুন আইনে স্বাক্ষরের ঘোষণা দেওয়ার জন্য একটি সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য রাখেন তিনি।
“হাসিখুশি শিশুদের হতাশাগ্রস্থ করে ফেলার জন্য অ্যাপগুলো দায়ী।” – বলেন তিনি।
আর, হোচুলের মতে, তার স্বাক্ষর করা আইন এ বিষয়ে সাহায্য করবে।
২০২৫ সালের শুরু থেকে কার্যকর হবে নতুন এ আইন, যা টিকটক ও ইনস্টাগ্রামসহ অন্যান্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমকে শুরুর দিনে ফেরত পাঠাবে বলে লিখেছে বিবিসি। আগে শীর্ষ প্রযুক্তি কোম্পানিগুলো ব্যবহারকারীর “লাইক”, আগ্রহ, মেজাজ, অভ্যাস সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করতে পারতো না, সে সীমাবদ্ধতাই আবার জুড়ে দেবে এ আইন।
স্টপ অ্যাডিকটিভ ফিড এক্সপ্লয়টেশন (সেইফ) ফর কিডস অ্যাক্ট-এর জন্য সোশাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্ম ও অ্যাপ স্টোরগুলিকে ১৮ বছরের কম বয়সী শিশুদের সামনে “আসক্তিমূলক ফিড”ওয়ালা অ্যাপের প্রচার ও ব্যবহারের অনুমতি দেওয়ার আগে অভিভাবকদের সম্মতি নেওয়ার প্রয়োজন হবে। একে অ্যালগরিদমের ওপর ভিত্তি করে সুপারিশ নিয়ন্ত্রণ করার যুগান্তকারী প্রচেষ্টা বলে উল্লেখ করেছে বিবিসি।
প্রকাশ হওয়া দ্বিতীয় আইন, ‘নিউ ইয়র্ক চাইল্ড ডেটা প্রটেকশ্ন অ্যাক্ট’, অ্যাপ নির্মাতাদের ব্যবহারকারীদের বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ করাকে সীমাবদ্ধ করবে।
কম বয়সী ব্যবহারকারীদের মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর সোশাল মিডিয়ার প্রভাব নিয়ে দিন দিন উদ্বেগ বাড়ছে। আইনগুলো তারই ফল।
তবে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা, অনেকের ধারণার চেয়েই অস্পষ্ট। অনেক গবেষণা বলছে, সোশাল মিডিয়া কম বয়সী ব্যবহারকারীদের মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য উপকারীও হতে পারে।
মিশ্র গবেষণা
অনেক গবেষণাতেই দুর্বল মানসিক স্বাস্থ্যের সঙ্গে সোশাল মিডিয়ার সম্পর্ক উঠে এসেছে। এসব গবেষণায় “সমস্যা তৈরি করা সামাজিক মিডিয়া ব্যবহার”-এর ওপর নজর দেওয়া হয়েছে, যেখানে মানুষের এসব প্ল্যাটফর্ম ব্যবহারের ওপর নিয়ন্ত্রণের অভাব রয়েছে। এটি বিভিন্ন ধরনের উদ্বেগ, হতাশা এবং মানসিক চাপ বৃদ্ধির সঙ্গেও যুক্ত।
তবে, কিছু কিছু গবেষণায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের সঙ্গে মানসিক স্বাস্থ্য ঝুঁকির তেমন মিল খুঁজে পাওয়া যায়নি।
এ ছাড়া, কিছু গবেষণায় এ-ও উঠে এসেছে যে নিয়ম মেনে সোশাল মিডিয়া ব্যবহার করলে এটি কিছু পরিস্থিতিতে ইতিবাচক প্রভাবও ফেলতে পারে।
মিশ্র প্রতিক্রিয়া
সোশাল মিডিয়া ও এসব আইন নিয়ে বিভিন্ন বিশেষজ্ঞ মিশ্র প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করেছেন। অনলাইন নিরাপত্তা নিয়ে কাজ করা কেউ কেউ নিউ ইয়র্কের নতুন আইনকে স্বাগত জানিয়েছেন।
“যদিও নিউ ইয়র্কের আইনটি যুক্তরাজ্যের অনলাইন নিরাপত্তা আইনের তুলনায় অনেক বেশি বিস্তৃত ও নির্দিষ্ট বিভিন্ন ক্ষতি নিয়ে কমই কথা বলেছে।” – মন্তব্য করেছেন লন্ডনের মলি রোজ ফাউন্ডেশনের উপদেষ্টা অ্যান্ডি বারোজ।
“তবে, এটি স্পষ্ট যে নিয়ন্ত্রণই শীর্ষ প্রযুক্তি কোম্পানিগুলোকে নিজেদের অ্যালগরিদম সামলাতে বাধ্য করবে ও শিশুদের কাছে ক্ষতিকারক কনটেন্ট সুপারিশ বন্ধ করবে।”
“বর্তমানে থাকা অসংখ্য খারাপ আইনের তুলনায়, এ আইনটি কিছুটা ভালো।” – বলেছেন যুক্তরাষ্ট্রে আলাবামা ইউনিভার্সিটি’র ডিজিটাল মিডিয়া বিষয়ের সহকারী অধ্যাপক জেস ম্যাডক্স।
তিনি অপ্রাপ্তবয়স্কদের সরাসরি সোশাল মিডিয়া ব্যবহারে বাধা না দেওয়ার জন্য আইনটির প্রশংসা করেন। তিনি মনে করেন, কিছু বাড়তি উদ্বেগ ডিজিটাল সাক্ষরতার সমস্যা সৃষ্টি করবে ও ভবিষ্যতের জন্য শিশুদের প্রস্তুতি কমে যাবে।
সোশাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মগুলো থেকেও মিশ্র প্রতিক্রিয়া এসেছে বলে উল্লেখ করেছে বিবিসি। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে নেটচয়েস। নেটচয়েস হচ্ছে, গুগল, এক্স, মেটা ও স্ন্যাপসহ অনেক বড় প্রযুক্তি কোম্পানির সংগঠন। তারা এ আইনটিকে ‘অসাংবিধানিক’ বলেছে।
“এ বিলের সব বিষয়ের সঙ্গে একমত না হলেও, অ্যাপ স্টোরগুলোর দায় ঘোষণা করে আইন পাস করা প্রথম রাজ্য হিসেবে নিউইয়র্ককে স্বাগত জানাই আমরা।” – বলেন মেটার একজন মুখপাত্র।
এ প্রসঙ্গে এক্স, টিকটক, অ্যাপল ও ইউটিউবের মালিক কোম্পানি গুগল, বিবিসি’র মন্তব্যের অনুরোধে তাৎক্ষণিক কোনো সাড়া দেয়নি।
আইন প্রয়োগের সমস্যা
অন্যান্য আইনের তুলনায় এটিকে ভালো বললেও, ম্যাডক্স আরও বলেন, “আমার প্রশংসা এখানেই শেষ, কারণ আইনটিকে আমার অপ্রয়োগযোগ্য বলে মনে হচ্ছে।”
তিনি উল্লেখ করেন, একটি অঙ্গরাজ্যে ‘আসক্তিমূলক ফিড’ থেকে পরিত্রাণ পাওয়া কঠিন। এ ক্ষেত্রে, অনলাইনে বয়স যাচাইকরণ আইনের কথা বলেন তিনি, যা যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিটি অঙ্গরাজ্যে পর্নোগ্রাফি ওয়েবসাইটের অ্যাকসেস কার্যকরভাবে নিষিদ্ধ করে।
একটি উদ্বেগের বিষয় হল, আইন কার্যকর হওয়ার পরে সোশাল মিডিয়া ফিডগুলো আসলেই কম আসক্তিমূলক হয়েছে কিনা সেটি যাচাই করা কঠিন হবে। এটিই আইনটির প্রয়োগ কঠিন করে তুলতে পারে।
এ ছাড়া, ম্যাডক্স আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন, এ ধরনের আইন দ্রুত কার্যকর করা হলে শিশুদের সুরক্ষা প্রচেষ্টায় ভালো চেয়ে খারাপ হতে পারে। ফলে, একটি আইন তৈরির আগে সেটি যথাযথভাবে যাচাই করার উপায় বের করা বেশি জরুরী।
“স্বল্প মেয়াদের জন্য আমরা হয়তো কিছু কাজ করছি, কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে সম্ভবত কিছুই ঘটবে না।” – বলেন তিনি।
তাহলে আইনের সমালোচকরা কী এর চেয়ে ভালো বিকল্প দেখতে পাচ্ছেন?
“এটা স্পষ্ট যে, দীর্ঘমেয়াদে সবাই কাজ করলে সকলের জন্যই অনেক ভাল হবে, এবং আমি মনে করি, এতে প্রযুক্তি কোম্পানিগুলোকেও থাকতে হবে। বিভিন্ন জায়গায় আলাদা পদক্ষেপের পরিবর্তে একটি একক, উন্নত ফেডারেল পদ্ধতির থাকতে হবে।” – বলেছেন বারোজ৷
একটি সমন্বিত, একক পদ্ধতি যা প্রমাণের ভিত্তিতে তৈরি হবে ও একটি বৈশ্বিক মান হিসাবে কাজ করবে, সেটিই কাম্য হবে, বলছেন বিশেষজ্ঞরা।
প্রযক্তি খাতও এর সঙ্গে একমত বলে লিখেছে বিবিসি।
এরইমধ্যে, বিভিন্ন দেশ শিশুদের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহারের বিষয়ে সতর্ক হচ্ছে, এবং শিশুদের রক্ষা করার জন্য বিভিন্ন পন্থা গ্রহণ করছে। আর শীর্ষ প্রযুক্তি কোম্পানিগুলোও এসব পদক্ষেপের বিরোধিতা করছে। ফলে, সোশাল মিডিয়ার ভবিষ্যত নিয়ে যুদ্ধ কেবল শুরু হচ্ছে, তা স্পষ্ট।