বিশাল গুদামঘরের মতো একটি সিরামিক পাইপের কারখানাকেই রূপান্তর করা হচ্ছে একটি উন্নতমানের চিপ উৎপাদন কেন্দ্রে।
Published : 15 Jan 2024, 05:02 PM
গোটা বিশ্বেই বাড়ছে চিপ বা সেমিকন্ডাক্টর খাতে আর্থিক বিনিয়োগের প্রবণতা।
উদাহরণ হিসেবে ধরা যায়, যুক্তরাজ্যের ডারহাম শহরের কাছাকাছি অবস্থিত চিপ উৎপাদক কারখানা ‘প্রাগম্যাটিক সেমিকন্ডাক্টর’-এর ঘটনাটি। এর আগে এটি একটি সিরামিক পাইপের কারখানা ছিল, যা বাইরে থেকে দেখতে একটি বিশাল গুদামঘরের মতো। তবে, এই বিশাল জায়গাটিকেই একটি উন্নতমানের চিপ উৎপাদন কেন্দ্রে রূপান্তর করা হচ্ছে।
কোম্পানিটি এরইমধ্যে নিজস্ব চিপ উৎপাদনের জন্য ‘প্রোডাকশন লাইন’ বা উৎপাদন খাত তৈরি করেছে, যা মাইক্রোচিপ সেক্টরে ‘ফ্যাব্রিকেশন লাইন’ বা ‘ফ্যাব লাইন’ নামে পরিচিত।
এই বিশাল জায়গায় নিজস্ব চিপ উৎপাদন খাতে প্রয়োজনীয় সকল দামী যন্ত্রপাতি এনেছে কোম্পানিটি। পাশাপাশি চিপ উৎপাদনের সময় যে কোনো ধরনের দূষণ এড়াতে এর ভেতরে বাতাসের মানও নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে।
গত বছরের শেষে কোম্পানিটি ঘোষণা দেয়, তাদের কাছে ২৩ কোটি ডলারের আর্থিক তহবিল আছে, যার মাধমে আরও তিন থেকে চারটি চিপ কারখানা তৈরি করা সম্ভব।
পাশাপাশি ব্রিটিশ সরকার সমর্থিত বেসরকারি বিনিয়োগ কোম্পানি ‘ইউকে ইনফ্রাস্ট্রাকচার ব্যাংক’ ও যুক্তরাজ্যের বাণিজ্য ব্যাংকের অঙ্গপ্রতিষ্ঠান ‘ব্রিটিশ পেশেন্ট ক্যাপিটাল’ থেকেও তহবিল নিশ্চিত করেছে কোম্পানিটি।
তবে কেমব্রিজভিত্তিক এই কোম্পানিটির পুরনো সিরামিক পাইপ কারখানায় আটটি চিপ উৎপাদন লাইন নির্মাণের জন্য আরও বেশি অর্থ প্রয়োজন।
বর্তমান বিশ্বে ফোন, কম্পিউটার থেকে শুরু করে গাড়ি এমনকি ওয়াশিং মেশিন, প্রায় প্রতিটি পণ্যই নির্ভর করে চিপ উৎপাদনের ওপর। যার মূল উপাদান ‘সেমিকন্ডাক্টর’।
এটি এমন এক শিল্প, যা বেশ কয়েক বছর ধরেই সমস্যার মুখে পড়েছে। মহামারীর সময় চিপ সরবরাহে ঘাটতি দেখা দিয়েছিল। যেখানে বিশ্বের সবচেয়ে উন্নত চিপের ৯০ শতাংশই উৎপাদিত হয় এশিয়ায়, সেখানকার ভূরাজনৈতিক উত্তেজনাও চিপের সরবরাহ কমানোর পেছনে দায়ী বলে প্রতিবেদনে লিখেছে বিবিসি।
‘প্রাগম্যাটিক’-এর প্রধান নির্বাহী ডেভিড মুর বলেছেন, চিপ শিল্পের ‘বিভিন্ন ধরনের সমস্যা’ সমাধানের জন্য অনেক ধরনের চিপ তৈরির প্রয়োজনীয়তা আছে।
বর্তমানে বিশ্বে বেশিরভাগ চিপ তৈরির ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয় সিলিকন। তবে, মুরের দাবি, তার কোম্পানির পদ্ধতি ভিন্ন।
কোম্পানিটি ডারহামের চিপ উৎপাদন কেন্দ্রে ‘ফ্লেক্সিবল’ বা নমনীয় চিপ তৈরি করছে। আর এটাকে প্রয়োজন মতো বাঁকানোও যায়। ওয়ারেবল বা পরিধানযোগ্য প্রযুক্তি, ‘ক্লোদিং অথেনটিকেশন’ এমনকি বিভিন্ন পার্সেল আইটেমের গতিবিধি পর্যবেক্ষণের বেলাতেও এ ধরনের চিপ ব্যবহার করতে দেখা গেছে।
প্রচলিত কারখানাগুলোয় বিভিন্ন চিপ বসানো হয় সিলিকন ওয়েফারের ওপর। তার বদলে প্রাগম্যাটিক তাদের চিপ বসিয়েছে একটি পাতলা ফিল্মের ওপর। ফলে এই শ্রেণির চিপকে স্ট্যান্ডার্ড সিলিকন চিপের তুলনায় সস্তা ও কম সময়ে বানানো যায় বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে বিবিসি।
“আপনি যদি সত্যিকারের চিপ উৎপাদনের সুবিধা নিতে চান, তবে তা বানাতে গিয়ে বহু বছর পেরিয়ে যাওয়ার পাশাপাশি শত কোটি ডলারের বেশি আর্থিক বিনিয়োগ লাগবে।” — বলেন মুর।
“আমাদের ফ্যাব্রিকেশন প্ল্যান্ট ১০ থেকে একশ গুণ পর্যন্ত সাশ্রয়ী হতে পারে, যা নির্ভর করবে আপনার মাপদণ্ডের ভিত্তিতে।”
“প্রচলিত চিপ তৈরির পেছনে তিন থেকে ছয় মাস সময় লাগলেও আমাদের চিপ বানাতে সময় লাগে ৪৮ ঘণ্টারও কম।”
এটা সর্ব রোগের প্রতিষেধক না হলেও, আগের চেয়ে সাশ্রয়ী খরচ ও কম সময়ে নমনীয় চিপ তৈরি করা যেতে পারে। তবে ফোন, কম্পিউটার ও বিশ্বের অন্যান্য নেতৃস্থানীয় প্রযুক্তির উন্নত চিপের জন্য এখনও সবচেয়ে উন্নত সিলিকন চিপের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে।
২০২১ সালে গোটা বিশ্বে যে চিপ সংকট দেখা গিয়েছিল তা থেকে ধারণা মেলে, কয়েকটি শীর্ষ সরবরাহক কোম্পানির ওপর এ শিল্প কতটা নির্ভরশীল।
এর মধ্যে সবচেয়ে পরিচিত নাম হল তাইওয়ানের সেমিকন্ডাক্টর উৎপাদক কোম্পানি টিএসএমসি, যারা বৈশ্বিক সেমিকন্ডাক্টর খাতের ৯০ শতাংশ দখলে রেখেছে।
আর সে কারণেই শীর্ষ পর্যায়ের সরবরাহক কোম্পানিগুলোর ওপর নির্ভরতা কমাতে স্থানীয়ভাবেই চিপ কারখানা নির্মাণে বিপুল অর্থ বিনিয়োগ করতে দেখা গেছে বিভিন্ন দেশের সরকারকে।
২০২২ সালের অগাস্টে ‘ইউএস চিপস অ্যাক্ট’ নামের আইন চালু করেছে মার্কিন সরকার। এর লক্ষ্য হল, যুক্তরাষ্ট্রের স্থানীয় চিপ উৎপাদন খাতের সক্ষমতা বাড়াতে পাঁচ হাজার দুইশ কোটি ডলার আর্থিক অনুদান দেওয়া।
এ ছাড়া, চিপ উৎপাদন বাড়াতে প্রকল্প হাতে নিয়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়নও। এতে অনুদান ধার্য করা হয়েছে চার হাজার সাতশ কোটি ডলার। এ ছাড়া, একই খাতে ১২৭ কোটি ডলার আর্থিক বিনিয়োগ পাওয়ার প্রতিশ্রুতি পেয়েছে যুক্তরাজ্যও।
বিশ্লেষকরা বলছেন, বড় চিপ নির্মাতারা এ ধরনের সরকারি প্রণোদনায় সাড়াও দিচ্ছেন।
এর সঙ্গে অনেকটা মিল রেখেই জার্মানির চিপ উৎপাদন খাতেও বিনিয়োগের ‘বিশাল ঢেউ’ দেখা গেছে। তাইওয়ানের এক সেমিকন্ডাক্টর নির্মাতা কোম্পানি ও তাদের ইউরোপ অংশের তিনটি সদর দপ্তর মিলে দেশটির ড্রেসডেন শহরে প্রায় এক হাজার একশ কোটি ডলার বিনিয়োগ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বলে উঠে এসেছে প্রতিবেদনে।
“আমরা দেখতে পাচ্ছি গোটা বিশ্বের চিপ উৎপাদনের ৮০ শতাংশই এশিয়ায়। সে অঞ্চল থেকে নির্ভরতা কমাতে আমাদের এখানকার অর্থাৎ ইইউ’র স্থিতিস্থাপকতা আরও জোরদার করতে হবে।” – বলেছেন ইউরোপীয় ইউনিয়নের সেমিকন্ডাক্টর ইন্ডাস্ট্রি অ্যাসোসিয়েশনের মহাপরিচালক হেন্ড্রিক আবমা।
“আমি মনে করি, ইউরোপে প্রযুক্তিগত উন্নয়নের জন্য চিপ শিল্পের গুরুত্ব সম্পর্কে আমাদের উপলব্ধি অতীতে তেমন গুরুত্ব দেওয়া হয়নি।”
আবমা আরও বলেন, চিপ উৎপাদনে জার্মানির পাশাপাশি বেলজিয়াম, লিথুয়ানিয়া এবং চেক প্রজাতন্ত্রেও বড় অঙ্কের বিনিয়োগ দেখা গেছে।
ওয়াশিংটনের জর্জটাউন এলাকায় অবস্থিত ‘সেন্টার ফর সিকিউরিটি অ্যান্ড এমার্জিং টেকনোলজি’র গবেষণা বিশ্লেষক হ্যানা ডহমেনের মতে, ‘ইউএস চিপস অ্যাক্ট’ আইন চালু করার পর প্রায় পাঁচশটি কোম্পানি মার্কিন সরকারের কাছে চিপ উৎপাদন প্রকল্পে অর্থায়নের জন্য আবেদন করেছে।
তিনি আরও যোগ করেন, নিউ ইয়র্ক, অ্যারিজোনা, টেক্সাস, ওহাইও ও আইডাহো’সহ অন্যান্য অঞ্চলেও নতুন চিপ কারখানা তৈরির পরিকল্পনা রয়েছে।
“আমরা ভারতকেও চিপ বানানোর চেষ্টা করতে দেখছি। ভারত এমন এক দেশ, যাদের চিপের নকশা তৈরিতে একটি সমৃদ্ধ ইতিহাস আছে। চীনের সঙ্গে তীব্র প্রতিযোগিতার কারণে মহাকাশ খাতেও আধিপত্য বিস্তার করতে চাইছে দেশটি। ফলে, যুক্তরাষ্ট্র ও এর মিত্র দেশগুলোও সেখানে প্রযুক্তিগত সহযোগিতা দিতে আগ্রহী।” — যোগ করেন ডোহমেন।
বিষয়টি ইতিবাচক শোনালেও, চিপ তৈরির কাজ এতটা সহজ নয়। অ্যারিজোনায় টিএসএমসির উন্নত চিপ তৈরির প্রকল্প এরইমধ্যে সমস্যার মুখে পড়েছে। আর এর কারণ ছিল, দক্ষ কর্মীর অভাব।
"এই পুরো চিপ শিল্প জুড়ে ভেজাল ও অপচয়ের ঝুঁকি আছে।” — বলেন ডোহমেন।
এদিকে কোম্পানিটির প্রধান নির্বাহী মুর সেমিকন্ডাক্টর কীভাবে তৈরি হয় এবং এগুলো আরও কিভাবে বা কীসের জন্য ব্যবহার করা হয় সে সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন।
“আপনি নিশ্চয়ই শত শত কোটি ডলার খরচ করে এমন কিছু বানাতে চাইবেন না, যা সরবরাহের ক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হয়। পাশাপাশি, সরবরাহের বিকল্প ব্যবস্থা রাখাটাও জরুরী।”
“আর সাশ্রয়ী খরচে বড় পরিসরে চিপ সরবরাহের বিষয়টিও বড় চ্যালেঞ্জ।”