Published : 20 Feb 2024, 03:24 PM
অ্যালান টিউরিং ১৯৫৪ সালের ৭ জুন যখন মারা যান, তখনও নিজে দেশে আইনের চোখে তিনি অপরাধী। সে সময়ে তার অপরাধ ছিল সমকামিতা। অথচ এই অপরাধী লোকটির সহায়তা না পেলে তার দেশের রাজপ্রাসাদ বাকিংহাম প্যালেস আজকের চেহারায় নাও থাকতে পারত।
আধুনিক কম্পিউটিংয়ের ধারণা দেওয়া প্রথম ব্যক্তি অ্যালান টিউরিংকে বিবেচনা করা হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে সবচেয়ে প্রভাবশালী কোড ব্রেকার হিসেবে।
অবিশ্বাস্য হলেও সত্য এই ক্ষণজন্মা এই লোকটিই ৭৭ বছর আগে বলে গিয়েছিলেন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও মেশিন লার্নিং প্রযুক্তির সম্ভাবনা নিয়ে।
বৈজ্ঞানিক খাতে তার অবদান কতটা
টিউরিংয়ের অবদান সম্ভবত সিনেমার নাটকীয়তাকেও ছাড়িয়ে যায়। মানুষ ও মানুষের বিভিন্ন সমস্যা সমাধান করা মেশিনে যোগসূত্র খুঁজে পাওয়ার ঐতিহাসিক নীতিমালা প্রকাশ করেছিলেন তিনি।
১৯৫১ সালে বিশ্বের প্রথম বাণিজ্যিক কম্পিউটার ‘ফেরান্টি মার্ক ১’ তৈরির কাজ শুরু করেন টিউরিং ও তার সহকর্মীরা, যা এর পাঁচ বছর আগে ‘ইউনিভার্সিটি অফ ম্যানচেস্টার’-এর বানানো এক প্রোটোটাইপের ভিত্তিতে তৈরি হয়েছিল।
এমনকি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগেও বেশ কিছু যুগান্তকারী উদ্ভাবনে হাত ছিল টিউরিংয়ের।
১৯৪৬ সালে বিশ্বের প্রথম কার্যক্ষম কম্পিউটার ‘ইলেকট্রনিক নিউমেরিকাল ইন্টিগ্রেটর অ্যান্ড কম্পিউটার’ বা ‘এনিয়াল’ তৈরি করার স্বীকৃতি পেয়েছিলেন গবেষক জন প্রেস্পার একার্ট ও জন ডব্লিউ. মকলি, যেটি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ‘ইউনিভার্সিটি ওফ পেনসিলভানিয়া’তে বানিয়েছিলেন তারা।
তবে, এনিয়াক তৈরির আগেই টিউরিং এমন এক মেশিনের ধারণা দিয়েছিলেন, যার মাধ্যমে সকল সম্ভাব্য কাজই করা যাবে। ধারণাটি ‘টিউরিং মেশিন’ নামে পরিচিত, যা প্রকাশ পেয়েছে টিউরিংয়ের জীবনীকার অ্যান্ড্রু হজেসের লেখা ১৯৮৩ সালের বই ‘অ্যালান টিউরিং: দ্য এনিগমা’র সংক্ষিপ্ত সংস্করণে।
টিউরিংয়ের ধারণা সম্পর্কে হজেস বলেছেন, এ মেশিনে প্রয়োজনীয় প্রোগ্রাম থাকলে যে কোনো কাজই করা সম্ভব।
পরবর্তীতে যুক্তরাষ্ট্র পরিচালিত পারমাণবিক বোমা তৈরির প্রকল্প ‘ম্যানহ্যাটান প্রজেক্ট’ থেকে যে প্রযুক্তি আবির্ভূত হয়েছিল, সেখানেও টিউরিংয়ের ধারণার ওপর নির্ভর করতে হয়েছে বিজ্ঞানীদের।
“ধারণাটি একজন ব্রিটিশ নাগরিকের হলেও একে শৈল্পিক আকার দিয়েছে আমেরিকানরা,” ২০১২ সালে ব্রিটিশ সাময়িকী ‘লন্ডন রিভিউ অফ বুকস’-এ লেখেন এমআইটি’র অধ্যাপক ডেভিড কাইজার।
যুদ্ধ পরবর্তী যুগে ‘ইউনিভার্সিটি অফ ম্যানচেস্টার’-এ প্রথম কর্মক্ষম ব্রিটিশ কম্পিউটার নির্মাণের ক্ষেত্রেও টিউরিংয়ের অবদান যুগান্তকারী, যেখানে স্নায়ুযুদ্ধ চলাকালীন বিশ্বের পারমাণবিক মোড়ল হওয়ার প্রতিযোগিতায় মূল উদ্দীপক হিসেবে কাজ করেছে কম্পিউটিংয়ের সক্ষমতা।
এমনকি মানুষের চিন্তা ও কম্পিউটিংয়ের বিভিন্ন উদ্ভাবনের মধ্যে যোগসূত্র তৈরির বিষয়টিতেও আগ্রহী ছিলেন টিউরিং। হজেসের লেখায় উঠে এসেছে, ১৯৪৪ সালেই সহকর্মীদের সঙ্গে ‘মস্তিষ্ক তৈরির’ বিষয়ে আলোচনা করতেন টিউরিং।
তারও আগে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ
ধারণা করা হয়, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে যুক্তরাজ্য ও মিত্রদেশগুলোর জয়ে সবচেয়ে কার্যকর ভূমিকা রেখেছিল তার ক্রিপ্টোলজি সংশ্লিষ্ট বুদ্ধিমত্তা।
তবে, টিউরিংয়ের মৃত্যুর এত বছর পরও যুদ্ধের সময় তার অনেক গোপন কৃতিত্বই উপেক্ষিত থেকে গেছে। কারণ তিনি এমন এক দেশে জন্মেছেন, যেখানে স্নায়ু যুদ্ধে নিরাপত্তা ঝুঁকির বিষয়টি বিবেচনায় রেখে তার অনেক অবদান কেবল গোপনই রাখা হয়নি, বরং নিজের প্রাপ্য খ্যাতি থেকেও বঞ্চিত রেখেছে এ ব্রিটিশ গণিতবিদ ও কম্পিউটার বিজ্ঞানীকে।
টিউরিংয়ের নাম সবচেয়ে বেশি শোনা যায় যুদ্ধ চলাকালীন লন্ডনের উত্তর দিকে অবস্থিত ব্লেচলি পার্ক থেকে নাৎসী বাহিনীর বিভিন্ন ‘টপ-সিক্রেট’ অভিযানের কোড ব্রেকার হিসেবে।
নাৎসি জার্মানির ‘এনিগমা’ মেশিনের তৈরি বিভিন্ন কোড বিশ্লেষণ করতেন তিনি, যা এক সময় দুর্ভেদ্য ছিল সবার কাছে। এমনকি স্বয়ং জার্মানদের কাছেও এ কোডগুলোকে দুর্ভেদ্য হিসেবে বিবেচিত হতো।
সে সময় আটলান্টিকের পানিতে বিভিন্ন জার্মান সাবমেরিনের আনাগোনা ছিল, যার লক্ষ্য ছিল যুদ্ধে শত্রুপক্ষের গুরুত্বপূর্ণ যানবাহন বহন করা কার্গো জাহাজ ধ্বংস করা। ব্রিটেনের সামরিক শক্তি বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে এ জাহাজগুলো।
পরবর্তীতে ১৯৪৪ সালের ‘ডি-ডে ল্যান্ডিং’, যা গোটা বিশ্বের সামরিক যুদ্ধের ইতিহাসে সর্ববৃহৎ আক্রমণ হিসেবে পরিচিত, সেখানেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল এ যানবাহনগুলো, যা এর পরের বছর নাৎসি জার্মানির পতনের কারণ হিসেবে কাজ করেছিল।
এ ক্ষেত্রে সাবমেরিনের গতিবিধির ওপর ভিত্তি করে কনভয়গুলোর অবস্থান বদলেছে যুক্তরাজ্য ও এর মিত্র বাহিনী। আর এর জন্য নির্ভর করতে হয়েছে ব্লেচলি পার্কের ক্রিপ্টোলজিস্টদের ওপর, যারা জার্মান সৈন্যদের প্রতিহত করার লক্ষ্যে তাদের বিভিন্ন রেডিও বার্তা ডিকোডিংয়ের কাজ করতেন।
সমকামিতা, মৃত্যু ও রাষ্ট্রীয় ‘ক্ষমা’
রানী ভিক্টোরিয়ার আমলের আইনে তার বিরুদ্ধে সমকামিতার অভিযোগ তুলে সায়ানাইড বিষ পানে আত্মহত্যা করতে বাধ্য করা হয় তাকে। তবে, পরবর্তীতে বিশ শতকের সবচেয়ে উদ্ভাবনী ও ক্ষমতাবান চিন্তকের খেতাব পেয়েছেন টিউরিং।
উল্লেখ্য, ১৯৬৭ সালের আগ পর্যন্ত সমকামিতাকে অপরাধের আওতার বাইরে আনতে কোনো পদক্ষেপ নেয়নি ব্রিটেন।
টিউরিংয়ের প্রতি অমানবিক আচরণের জন্য ২০০৯ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে ক্ষমা চেয়েছে যুক্তরাজ্য সরকার।
“আমরা দুঃখিত — আপনার আরও বেশি কিছু প্রাপ্য ছিল,” বলেন ব্রিটেনের তৎকালীন প্রধান মন্ত্রী গর্ডন ব্রাউন।
“অ্যালান’সহ হাজার হাজার সমকামী পুরুষের শাস্তি হয়েছিল সে সময়, যখন সমকামীবিরোধী আইনের অধীনে বাজে আচরণের শিকার হয়েছিলেন তারা।”
২০১৩ সালে টিউরিংকে রাষ্ট্রীয় ক্ষমা প্রদান করেন রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথ, যার ৫৯ বছর আগে ইংল্যান্ডের উত্তর পশ্চিমাংশে ম্যানচেস্টারের কাছাকাছি অবস্থিত শহর উইলমস্লোতে টিউরিংয়ের বাড়ি থেকে তার মৃতদেহ খুঁজে পেয়েছিলনে তারই এক গৃহকর্মী।
পরবর্তীতে টিউরিংয়ের ময়নাতদন্তকারী নিশ্চিত করেন, সায়ানাইড বিষ পান করে তিনি আত্মহত্যা করেছেন, এবং সে সময় ‘মানসিকভাবে অসুস্থ’ ছিলেন তিনি।
মৃত্যুর সময় তার পাশে একটি অর্ধেক খাওয়া আপেল পাওয়া গিয়েছিল, যা নিয়ে আত্মজীবনীকাররা সন্দেহ প্রকাশ করেছেন, ওই আপেলে সায়ানাইড বিষের ডোজ মিশিয়ে তাকে হত্যা করা হয়েছে।
এমনকি টিউরিংয়ের আত্মহত্যার আনুষ্ঠানিক রায়কে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে তার মা এথেল টিউরিং যুক্তি দেখিয়েছিলেন, তিনি ভুলে বিষ পান করে ফেলেছেন।
বর্তমানে নিজ দেশ’সহ এর চেয়েও বিস্তৃত বিজ্ঞানীদের সমাজে গণিত ও ক্রিপ্টোগ্রাফির মতো খাতে টিউরিংয়ের মেধা ও অবদান স্বীকৃতি পেয়েছে। অথচ এক সময় তিনি যে প্রতিকূল সমাজে জন্মেছিলেন, সেখানেই উপেক্ষা করা হতো তাকে।
“তিনি জাতীয় সম্পদ ছিলেন। আর আমরা তাকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিয়েছি,” বলেন কম্পিউটার বিজ্ঞানী গ্রাহাম-কামিং, যিনি টিউরিংয়ের রাষ্ট্রীয় ক্ষমা নিয়ে প্রচারণাও চালিয়েছেন।
সিনেমায় টিউরিং
টিউরিংয়ের গল্প থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে ২০১৪ সালে ‘দ্য ইমিটেশন গেইম’ সিনেমা বানিয়েছেন নরওয়েজিয়ান চলচ্চিত্রকার মর্টেন টাইলডাম, যেখানে অভিনয় করেছেন ‘শার্লক’ খ্যাত ব্রিটিশ অভিনেতা বেনেডিক্ট কামবারব্যাচ ও ‘পাইরেটস অফ দ্য ক্যারাবিয়ান’ খ্যাত অভিনেত্রী কিয়ারা নাইটলি।
১৯৪৭ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি কী বলেছিলেন তিনি?
এ দিনে ‘লন্ডন ম্যাথেমেটিকাল সোসাইটি’র এক আয়োজনে টিউরিং নিজের ভাষণে ঘোষণা দেন, ‘আমাদের এমন এক মেশিন দরকার, যা বিভিন্ন ধরনের অভিজ্ঞতা থেকে শিখতে পারে’।
মেশিন লার্নিং ও ডিপ লার্নিং প্রযুক্তির ক্ষেত্রে এ দিনের মাহাত্ম্য অনেক বেশি, যেখানে টিউরিং ব্যাখ্যা করেছিলেন কীভাবে বিভিন্ন বুদ্ধিমত্তাভিত্তিক মেশিন কাজ করতে পারে।
এ ছাড়া, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা যে মানুষের চাকরির ওপর বড় প্রভাব ফেলতে পারে, সে ভবিষ্যদ্বাণীও এ দিন দিয়েছিলেন টিউরিং।
“অটোমেশন কী চাকরি খাত ধ্বংস করবে না মানুষের কাজে অগমেন্টেশনের মতো নতুন বিষয় নিয়ে কাজ করে তাদের সাহায্য করবে?” সে সময় বলেছিলেন তিনি।
এমনকি ডিজিটাল কম্পিউটার যে সে সময়কার প্রচলিত কম্পিউটারের জায়গা নিয়ে বিভিন্ন গাণিতিক হিসাব নিকাশের কাজ করবে, সে সময় এমন অনুমানও প্রকাশ করেছিলেন তিনি।
“তবে এইসব কম্পিউটারের মাধ্যমে বেশিরভাগ কাজেই এমন সমস্যা থাকতে পারে, যেগুলো প্রচলিত কম্পিউটারের মাধ্যমে করা সম্ভব না। আর এর কারণ হতে পারে কাজের মাত্রা।”
টিউরিং টেস্ট
১৯৫০ সালে শিক্ষাবিষয়ক জার্নাল ‘মাইন্ড’-এ প্রকাশ পাওয়া এক নিবন্ধে উঠে এসেছিল, টিউরিং এমন এক নতুন মাপদণ্ড তৈরি করেছেন, যা পরবর্তীতে গোটা বিশ্বে ‘টিউরিং টেস্ট’ নামে পরিচিতি পেয়েছে।
এ পদ্ধতিতে কোনো কম্পিউটার মানুষ হিসেবে পরীক্ষায় পাশ করতে পারে কি না, তা যাচাই করা হয়। পরীক্ষার অংশ হিসেবে, একজন মানব পরীক্ষক কম্পিউটারকে বিভিন্ন প্রশ্ন করে যাচাইয়ের চেষ্টা করেন, এর জবাবগুলো মানুষের তরফ থেকে এসেছে, না কি কোনো কম্পিউটার থেকে।