স্বস্তির সপ্তাহের পর পুঁজিবাজারে বড় পতন

“দুই দিন বাড়লেই বিক্রয় চাপ চলে আসে, পতন শুরু হয়ে যায়। এখানে আত্মবিশ্বাস কীভাবে আসবে, “ বলছেন পুঁজিবাজার বিশ্লেষক দেবব্রত কুমার সরকার।

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 12 March 2023, 11:03 AM
Updated : 12 March 2023, 11:03 AM

‘স্বস্তির’ একটি সপ্তাহ পার করে ফের বড় দরপতন হল পুঁজিবাজারে। সিংহভাগ কোম্পানির শেয়ার ‘ফ্লোর প্রাইসে’ আটকে থাকার মধ্যেও ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে (ডিএসই) সূচকের পতন হল ২৫ পয়েন্ট। এর মধ্যে আবার একটি কোম্পানির কারণেই সূচকে যোগ হয়েছে ২৬ শতাংশের বেশি।

ফ্লোর প্রাইসের বেশি আছে, এমন কোম্পানিগুলোর মধ্যে ১৭টি ছাড়া সবগুলোর দাম কমেছে রোববার । লেনদেন নেমে এসেছে পাঁচশ কোটি টাকার নিচে।

নতুন সপ্তাহের প্রথম দিন পুঁজিবাজারের এই চিত্র বিনিয়োগকারীদের আর্থিকভাবে আরও ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। আগের সপ্তাহে শেয়ারদর বাড়ার পাশাপাশি লেনদেনও বেড়েছিল। বিনিয়োগকারীরা দর বাড়ছে দেখে বিনিয়োগ বাড়িয়েছিলেন। কিন্তু একদিনের পতনেই আটকে গেছেন আবার।

গত সপ্তাহের চার কর্মদিবসে সূচক বেড়েছিল ৪৬ পয়েন্ট। লেনদেন ছাড়িয়েছিল সাতশ কোটি টাকার ঘর। বেশ কিছু কোম্পানির দর ফ্লোর প্রাইস ছাড়িয়ে বেড়ে গিয়েছিল। আর সেই বাড়তি দরে যারা শেয়ার কিনেছেন, তাদের বেশিরভাগেই বিক্রি করার আগেই দর পড়ে গেছে।

আগের সপ্তাহে ২২.৩০ শতাংশ দর বৃদ্ধি পাওয়া লিগ্যাসি ফুটওয়্যারের দর একদিনই কমেছে ৮.০১ শতাংশ। গত সপ্তাহে ১৬ দশমিক ৫৪ শতাংশ বৃদ্ধি পাওয়া ইস্টার্ন হাউজিংয়ের শেয়ার দর কমেছে ৬.১৪ শতাংশ।

এদিন ১৭টি কোম্পানির শেয়ারের দর বৃদ্ধির বিপরীতে দর হারিয়েছে ১৩৯টি। আগের দিনের দরে ফ্লোর প্রাইসে হাতবদল হয়েছে ১৫৫টি কোম্পানি। ৭৯টি কোম্পানির একটি শেয়ারও হাতবদল হয়নি।

গত সপ্তাহে এমনও দিন গেছে যেদিন হাতে গোনা কয়েকটি কোম্পানির শেয়ারের দর কমেছে। বিপরীতে বেড়েছে একশর বেশি কোম্পানির। এক দিনে ৩৪০টি কোম্পানির শেয়ার হাতবদল হতেও দেখা গেছে, রোববার তার নেমে এসেছে ৩১১তে।

লেনদেন নেমেছে ৪৩৩ কোটি ৫৮ লাখ ৩৯ হাজার টাকায়, যা গত পাঁচ কর্মদিবসের সর্বনিম্ন। গত সপ্তাহে লেনদেন ৭২৭ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাওয়ার পর বিনিয়োগকারীরা আশাবাদী হয়ে উঠেছিলেন।

দরপতনের হারও এদিন ছিল বেশি। লিগ্যাসি ছিল দরপতনের শীর্ষে। ৭ শতাংশের বেশি কমেছে একটি কোম্পানির, ৬ শতাংশের বেশি কমেছে দুটি কোম্পানির, ৫ শতাংশের বেশি কমেছে একটি কোম্পানির আর ৪ শতাংশের বেশি দর কমেছে ১৭টি কোম্পানির।

আরও ২৯টি কোম্পানি ৩ থেকে ৪ শতাংশের মাঝামাঝি, একই পরিমাণ কোম্পানি ২ থেকে ৩ শতাংশের মাঝামাঝি এবং ৩০টি কোম্পানির দর কমেছে এক থেকে ২ শতাংশের মাঝামাঝি।

দরপতনের শীর্ষ ১০ কোম্পানিতে লিগাসি ছাড়াও ছিল প্রগতি লাইফ, ডমিনোজ স্টিল, ইস্টার্ন হাউজিং, সিএপিএম আইবিবিএল মিউচুয়াল ফান্ড, বিজিআইসি, আনলিমা ইয়ার্ন, জেএমআই হসপিটাল ও ফারইস্ট লাইফ ইন্স্যুরেন্স।

২৪ দশমিক ৮৫ শতাংশ সূচক কমিয়েছে কেবল ১০টি কোম্পানি। এর মধ্যে সোনালী পেপার ৩.৮৯ পয়েন্ট, সিপার্ল হোটেল ৩.৮২ পয়েন্ট, ইউনিট হোটেল ২.৬৯ পয়েন্ট, বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশন ২.৫৬ পয়েন্ট, বসুন্ধরা পেপার ২.৫২ পয়েন্ট, ইস্টার্ন হাউজিং ২.৩১ পয়েন্ট, জেনেক্স ইনফোসিস ২.১২ পয়েন্ট, জেএমআই হসপিটাল ১.৯১ পয়েন্ট, অলিম্পিক ইন্ডাস্ট্রিজ ১.৫২ পয়েন্ট এবং ডেল্টা লাইফ সূচক কমিয়েছে ১.৫২ পয়েন্ট।

পতনের ‘দুই কারণ’

পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ প্রতিষ্ঠান ব্র্যাক ইপিএলের সাবেক গবেষণা প্রধান দেবব্রত কুমার সরকার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ভালো একটি সপ্তাহের পর পুঁজিবাজারের এই পতনের কারণ আত্মবিশ্বাসের অভাব আর প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের নিষ্ক্রিয়তা।”

কেন আত্মবিশ্বাসের অভাব- এই প্রশ্নে তিনি বলেন, “দুই দিন বাড়লেই বিক্রয় চাপ চলে আসে, পতন শুরু হয়ে যায়। এখানে আত্মবিশ্বাস কীভাবে আসবে। গত সপ্তাহে কিছু কোম্পানি ‘ফ্লোর’ ছাড়াল, সেগুলো আবার ফিরে এসেছে সেখানে। এখন বিনিয়োগকারীদের আত্মবিশ্বাস দেবে কে?

“ঘুরে ফিরে কয়েকটা আইটেমেই নির্ভরশীল হয়ে গেছে পুঁজিবাজার। নতুন কোনো স্ক্রিপ্ট আসছে না। পুরো পুঁজিবাজার নির্ভর করছে ব্যক্তি শ্রেণির ছোট বিনিয়োগকারীদের ওপর। প্রাতিষ্ঠানিক কোনো সাপোর্ট নেই।”

প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা নিষ্ক্রিয় কেন জানতে চাইলে দেবব্রত বলেন, “তারা চাইলেও বিনিয়োগ বাড়াতে পারছে না। বন্ডে বিনিয়োগ করেছে অনেকে। সেখানে ফান্ড আটকে গেছে। এই বিনিয়োগটা এক্সপোজার লিমিটের (বিনিয়োগসীমা) বাইরে নিয়ে আসার একটা কথা হচ্ছে। সেটা হয়ে গেলে নতুন বিনিয়োগের সুযোগ হবে।”

ইউনিলিভারের লাফ

গত ১০ নভেম্বর থেকে ফ্লোর প্রাইসে পড়ে থাকা ইউনিলিভার কনজ্যুমারের শেয়ারদর এদিন বেড়েছে ২০ দশমিক ১৭ শতাংশ। লভ্যাংশ সংক্রান্ত ঘোষণার কারণে কোনো মূল্যসীমা না থাকার দিন ২ হাজার ৮৪৯ টাকা থেকে ৫৭৪ টাকা ৭০ পয়সা বেড়ে দর দাঁড়িয়েছে ৩ হাজার ৪২৩ টাকা ৭০ পয়সায়।

গত ডিসেম্বরে সমাপ্ত অর্থবছরের জন্য কোম্পানিটি শেয়ার প্রতি ২৪ টাকা নগদের পাশাপাশি ৬০ শতাংশ বোনাস ল্যভাংশ ঘোষণা করেছে। গ্ল্যাক্সেস্মিথ ক্লাইনের শেয়ার অধিগ্রহণের পর এই প্রথম বোনাস শেয়ার ঘোষণা করল কোম্পানিটি।

এই ঘোষণা বিনিয়োগকারীদেরকে এতটাই আপ্লুত করেছে যে গত দুই বছরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি লেনদেন হয়েছে। হাতবদল হয়েছে ৩১ হাজার ৮৭৯টি শেয়ার। গত ছয় মাসে এক দিনে সর্বোচ্চ ১ হাজার ২২৯টি শেয়ার হাতবদল হয়েছিল।

এই কোম্পানিটি সূচকে যোগ করেছে ২৬ দশমিক ৩৯ পয়েন্ট।

দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ৪.৪৩ শতাংশ দর বেড়েছে মুন্নু অ্যাগ্রোর। আরও ছয়টি কোম্পানির দর ২ শতাংশের বেশি, দুটির দর এক শতাংশের বেশি বেড়েছে।