সবচেয়ে বেশি দর বেড়েছে এমন ১০টি কোম্পানির মধ্যে ৭টি লোকসানি। বাকি তিনটির মধ্যে একটি কোম্পানি গত ছয় বছরের মধ্যে দুইবার মুনাফার মুখ দেখলেও এর পরিমাণ নগণ্য।
Published : 06 Nov 2023, 03:36 PM
টানা মন্দার মধ্যে থাকা পুঁজিবাজারে রাজনৈতিক অস্থিরতার সময় বিনিয়োগ বাড়তে দেখা যাচ্ছে। ৪৮ ঘণ্টা অবরোধের টানা দুই দিন লেনদেন বাড়ল। সব মিলিয়ে বাড়ল টানা তিন কর্মদিবস।
রাজনীতিতে অস্থিরতার আভাস দেখা দিলেই যেখানে পুঁজিবাজারে লেনদেন কমে যায়, সেখানে এই প্রবণতাকে ইতিবাচকভাবেই দেখছেন বাজার সংশ্লিষ্টরা।
৭২ ঘণ্টার অবরোধ শেষে দুই দিনের সাপ্তাহিক ছুটির পর রোববার ফের অবরোধের প্রথম দিন ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ ডিএসইর সূচক বাড়ে ৭ পয়েন্ট, লেনদেন বাড়ে ৬ শতাংশের বেশি।
দ্বিতীয় দিন সোমবার আগের দিনের চেয়ে লেনদেন বাড়ে ২৬ শতাংশেরও বেশি, সূচক বাড়ে ২ পয়েন্ট।
সব মিলিয়ে এদিন হাতবদল হয় ৫৯৫ কোটি ৭৬ লাখ ৮৯ হাজার টাকা, যা আগের দিন ছিল ৪৭০ কোটি টাকার কিছু বেশি।
এই লেনদেন গত ৩০ কর্মদিবসের মধ্যে সর্বোচ্চ। গত ২১ সেপ্টেম্বর এর চেয়ে বেশি ৭৩৫ কোটি ৩৫ লাখ টাকার লেনদেন দেখা গিয়েছিল।
এদিন ৬৬টি কোম্পানির শেয়ারের দর বেড়েছে, বিপরীতে কমেছে ৮৭টির। ১৬২টি কোম্পানি আগের দিনের দরে হাতবদল হয়েছে। সব মিলিয়ে হাতবদল হয়েছে ৩১৫টি কোম্পানির শেয়ার।
তবে এসব কোম্পানির মধ্যে বলার মতো লেনদেন হয়েছে ৫০টিরও কম কোম্পানির।
কেবল ২৮টি কোম্পানির ১০ লাখের বেশি শেয়ার লেনদেন হয়েছে। এক লাখের বেশি শেয়ার লেনদেন হয়েছে এমন কোম্পানির সংখ্যা ছিল ১১৭টি। তবে আরও লাখ লাখ শেয়ার বিক্রির জন্য বসানো ছিল।
মোট ৭৪টি কোম্পানির একটি শেয়ারও লেনদেন হয়নি।
৩৮৯টি কোম্পানির মধ্যে ২৫০টিরও বেশি ফ্লোর প্রাইসে পড়ে আছে এবং এগুলোর ক্রেতা খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।
দুর্বল কোম্পানিতেই আগ্রহ বেশি
পুঁজিবাজার বিশ্লেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন সিস্টেমস বিভাগের শিক্ষক আল আমিন পুঁজিবাজারের আচরণ নিয়ে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এটা ঠিক যে এই অস্থিরতার মধ্যেও লেনদেন বেড়েছে, এটাকে ইতিবাচক দিক হিসেবেই দেখা যায়। কিন্তু আবার যদি দেখেন লেনদেন কোথায় হচ্ছে, তাহলে সেটি হতাশাজনক।
“লেনদেনের শীর্ষে থাকা কোম্পানিগুলোকে যদি বিবেচনা করেন, তাহলে দেখবেন কোনোটি উৎপাদনে নেই, কোনোটি বছরের পর বছর ধরে লোকসান দিয়ে আসছে। টপ টোয়েন্টিতে থাকা শেয়ারগুলোর প্রায় প্রতিটির পেছনেই কোনো না কোনো নাম আসছে। এটা তো কোনো স্থিতিশীল পুঁজিবাজারের লক্ষণ হতে পারে না।”
সোমবার সবচেয়ে বেশি দর বেড়েছে এমন ১০টি কোম্পানির মধ্যে ৭টি লোকসানি। বাকি তিনটির মধ্যে একটি কোম্পানি গত ছয় বছরের মধ্যে দুইবার মুনাফার মুখ দেখলেও এর পরিমাণ নগণ্য। গত ৫ বছরে সর্বোচ্চ লভ্যাংশ এসেছে শেয়ার প্রতি ২০ পয়সা।
লেনদেনের দিক দিয়ে টপ টোয়েন্টিতে থাকা কোম্পানিগুলোর মধ্যে কেবল দুটির মৌলভিত্তি ভালো। বাকি সবগুলো দুর্বল কোম্পানি।
শেয়ার প্রতি ২৫ পয়সা লভ্যাংশ দেওয়া দেশবন্ধু পলিমারের শেয়ার হাতবদল হয়েছে ৩৫ কোটি টাকার, লোকসান দেওয়া ফুওয়াং ফুডসের শেয়ার হাতবদল হয়েছে ৩১ কোটি টাকা, পাঁচ বছর পর উৎপাদনে ফেরা এমারেল্ড অয়েলে লেনদেন হয়েছে ২৫ কোটি টাকার বেশি।
মোট লেনদেনের ৪৪ শতাংশের বেশি হয়েছে কেবল এই ২০টি কোম্পানিতে।
খাতওয়ারি বিবেচনা করলে লেনদেনের প্রায় ১৯ শতাংশ খাদ্য খাতে, ১৭ শতাংশ সাধারণ বীমায় এবং ১৩ শতাংশের বেশি হয়েছে প্রকৌশল খাতে।
অর্থাৎ প্রায় ৫০ শতাংশ লেনদেনই হয়েছে এই তিন খাতে।
গত কয়েক মাস ধরেই পুঁজিবাজরের সূচক একটি বৃত্তে ঘুরপাক খাচ্ছে। এটি ৬ হাজার ৩০০ পয়েন্টে উঠে গিয়ে আবার নেমে আসছে। কিন্তু পরে আবার বাড়ছে।
এই সময়টায় বেশিরভাগ সময় সাধারণ বীমা খাতের ওপর ভর করে পুঁজিবাজারের লেনদেন এগিয়েছে। তবে গত ২৮ অক্টোবরের আগে আগে রাজনৈতিক অস্থিরতার আশঙ্কা দেখা দিলে বাজার পুরোপুরি স্বল্প মূলধনী ও কিছু লোকসানী কোম্পানির ওপর ভর করেছে।
পুঁজিবাজার বিশ্লেষক আল আমিন বলেন, “আসলে এখন পুঁজিবাজারে গেম্বলারের ফান্ড হাতবদল হচ্ছে। টপ টেনে যেসব শেয়ার উঠে আসছে, সেগুলো স্বাভাবিক বাজারে হওয়ার কথা ছিল না। এগুলোর কোনো স্টেরি নেই, কোনো ফান্ডামেন্টাল রিজন নেই, সব ইনফর্মড ট্রেডার, ইনসাইড তথ্য যাদের হাতে থাকে, তারাই লেনদেন করেছে।
“উৎপাদন বন্ধ, লোকসানি কিন্তু বড় চক্র শেয়ার নিয়ে নিয়েছে, তারাই তারা দাম বাড়াচ্ছে। লোভে পড়ে সাধারণ বিনিয়োগকারী সুইচ করতে গিয়ে বারবার লোকসানে পড়েছে। ধৈর্যের ঘাটতি তাদের।“
পুঁজিবাজারে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারী তৈরি করা যায়নি বলে এমনটি হচ্ছে মত দিয়ে তিনি বলেন, “প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা সক্রিয় হলে বাজারের উন্নতি হত।
“এখন যে ভলিউম হচ্ছে, সেটি স্মার্ট মনির প্রভাব্, যাদের হাতে টাকা আছে তারা কিছু প্রফিট পাচ্ছে, তারপরেও এটা রাজনৈতিক পরিস্থিতির বিবেচনায় ইতিবাচকই বলব।”
দাম বৃদ্ধির শীর্ষ ১০
১০ শতাংশ ছুঁয়ে দাম বেড়েছে পাঁচটি লোকসানি কোম্পানির। এগুলো হলো খান ব্রাদার্স পিপি ওভেন, ফার কেমিক্যালস, অলিম্পিক অ্যাকসেসোরিজ, ইউনিয়ন ক্যাপিটাল, আর এন স্পিনিং ও খুলনা পেপার মিলসের।
এর মধ্যে ফার কেমিক্যালস ও আন এন স্পিনিং মিলস অন্য দুটি কোম্পানির সঙ্গে একীভূত হয়েছে। এরপর দুটি কোম্পানির শেয়ারের ফ্লোর প্রাইস সমন্বয় না হওয়ার পর দাম ক্রমাগত কমছিল। সকালেও প্রায় ১০ শতাংশের মতো দাম কমে যায়। দিন শেষে ১০ শতাংশের মতো বেড়ে যাওয়ায় সকালে কিনেই বিকেলে ২০ শতাংশের মতো মুনাফা করতে পেরেছেন বিনিয়োগকারীরা।
এপেক্স ফুড ও মনোস্পুল পেপারের দরও দর বৃদ্ধির সর্বোচ্চ সীমা ছুঁয়ে লেনদেন হয়েছে। এগুলোর শেয়ারদর ২০০ টাকার বেশি থাকায় ৮.৭৫ শতাংশের বেশি বাড়ার সুযোগ ছিল না।
লোকসান কমে আসার তথ্য জানানো ওয়েস্টার্ন মেরিন শিপইয়ার্ডের দর ৮ শতাংশের বেশি এবং দুই বছর পর মুনাফায় ফেরা হাক্কানি পাল্পের দর বেড়েছে সাড়ে ৭ শতাংশের বেশি।
দরপতের শীর্ষে যারা
সবচেয়ে বেশি ৯.৫৭ শতাংশ দর কমেছে ক্যাপিটেক গ্রামীণ মিউচুয়াল ফান্ডের, যেটি তালিকাভুক্তির পর টানা বেড়ে ১০ টাকার ইউনিট দর উঠে যায় ২৮ টাকা ১০ পয়সায়। সেখান থেকে পড়তে পড়তে এখন নেমেছে ১৭ টাকায়।
এর বাইরে লিবরা ইনফিউশনের দর ৬ শতাংশের বেশি, ১০০ শতাংশ বোনাস শেয়ার ঘোষণা করা সোনালী আঁশের দর ৫.৭২ শতাংশ কমেছে।
ইউনাইটেড ইন্স্যুরেন্স, শমরিতা হসপিটাল, এডিএন টেলিকমের শেয়ারদর ৫ শতাংশের বেশি, আজিজ পাইপস, স্ট্যান্ডার্ড ইন্স্যুরেন্স ও রিলায়েন্স ইন্স্যুরেন্সের দর ৪ শতাংশের বেশি এবং ইয়ানিক পলিমারের দর কমেছে প্রায় চার শতাংশ।