ভালো কোম্পানি ‘ঘুমিয়ে’, পুঁজিবাজারে ‘দুর্বলের’ লাফ

লভ্যাংশের মৌসুম চলে এলেও ব্যাংকের শেয়ারে আগ্রহ দেখা যাচ্ছে না। অন্যান্য বছর এই সময়ে বীমা কোম্পানির শেয়ার কেনাবেচায় গতি দেখা গেলেও এবার পরিস্থিতি ভিন্ন।

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 29 March 2023, 08:44 AM
Updated : 29 March 2023, 08:44 AM

কোম্পানি লোকসানে, কোনো কোনোটি লভ্যাংশ দিচ্ছে না কয়েক বছর ধরে, কোনো কোনোটি উৎপাদনেই নেই, কোনো কোনোটির লভ্যাংশ এলেও পরিমাণে তা নগণ্য, অথচ মন্দার পুঁজিবাজারে এসব কোম্পানিরই কদর দেখা যাচ্ছে।

রোজায় প্রথম দুই কর্মদিবসে ফ্লোর প্রাইসের বেশি থাকা কোম্পানির শেয়ারদর ও সূচকের পতন হলেও তৃতীয় কর্মদিবসে তা বাড়ল। বুধবার শেয়ারদর বেড়েছে অনেকটাই, তবে স্বল্প মূলধনী এসব কোম্পানির দাম বাড়লে বা কমলে সূচকে তেমন প্রভাব পড়ে না। ফলে দিন শেষে সূচক বাড়েনি খুব একটা।

বুধবার ৮০টি কোম্পানির দর বৃদ্ধির বিপরীতে কমেছে ২৭টির। তবে বড় মূলধনী আর শক্তিশালী মৌলভিত্তির কোম্পানিগুলো নিয়ে বিনিয়োগকারীদের আগ্রহ দেখা যায়নি। ৮০টির বেশি কোম্পানির শেয়ার লেনদেন হয়নি, আরও দেড় শতাধিক কোম্পানির লেনদেন হয়েছে নামমাত্র। ফলে একশর কিছু বেশি কোম্পানির ওপর ভর করে আছে পুঁজিবাজার।

ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে ৩৯২টি কোম্পানি তালিকাভুক্ত থাকলেও এদিন লেনদেন হয়েছে ৩০৫টির। এর মধ্যে এক কোটি টাকার বেশি লেনদেন হয়েছে কেবল ৫৭টি কোম্পানির। ৮৫টি কোম্পানির একটি শেয়ারও লেনদেন হয়নি।

দুই দিনে ২১ পয়েন্ট কমার পর সূচক বেড়েছে ৩ পয়েন্ট। তবে ক্রয়চাপে লেনদেন বেড়েছে অনেকটাই। মঙ্গলবার গত এক মাসের মধ্যে সবচেয়ে কম টাকার শেয়ার কেনাবেচা হলেও তা বেড়েছে একশ কোটি টাকার বেশি।

এদিন লেনদেন ছিল ৩৮০ কোটি টাকার বেশি, যা আগের দিন ছিল ২৭০ কোটি টাকার ঘরে।

তবে এর মধ্যে ফ্লোর প্রাইসে পড়ে থাকা বড় মূলধনী কোম্পানির কোনো নড়চড় দেখা যায়নি। নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসির বাধায় শেয়ারদর কমতে পারছে না, কিন্তু শেয়ার বিক্রিও করতে পারছে না বিনিয়োগকারীরা।

এমনকি লভ্যাংশের মৌসুম চলে এলেও ব্যাংকের শেয়ার আগ্রহ নেই। অন্যান্য বছর এই সময়ে বীমা কোম্পানির শেয়ার কেনাবেচায় গতি দেখা গেলেও এবার দেখা যাচ্ছে না তা। অথচ ৩৫টি ব্যাংকের মধ্যে হাতে গোনা এক-দুইটি ছাড়া বেশিরভাগের লভ্যাংশ বেশ ভালো আসে প্রতি বছর।

চলতি বছর শেয়ারদর ২০ টাকায় পড়ে আছে এমন একটি ব্যাংক শেয়ার প্রতি দেড় টাকা লভ্যাংশ ঘোষণা করেছে। আরও কয়েকটি ব্যাংক লভ্যাংশ ঘোষণার জন্য বোর্ড সভার তারিখ জানিয়েছে।

একটি বীমা কোম্পানি শেয়ার প্রতি আড়াই টাকা, একটি আড়াই টাকার সঙ্গে ৫ শতাংশ বোনাস শেয়ার ঘোষণা করেছে। কিন্তু শেয়ারদর পড়ে আছে ফ্লোর প্রাইসে।

ব্যাংক ও বীমা খাত নয় কেবল, প্রতি বছর দারুণ লভ্যাংশ দিয়ে আসা বহুজাতিক ভালো কোম্পানির শেয়ারও লেনদেন হচ্ছে না বললেই চলে। ওষুধ ও রসায়ন এবং বস্ত্র খাতের শক্তিশালী কোম্পানিগুলোর ক্ষেত্রেও একই চিত্র।

পুঁজিবাজারের বিনিয়োগ প্রতিষ্ঠান ব্র্যাক ইপিএলের সাবেক গবেষণা প্রধান দেবব্রত কুমার সরকার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “অল্প ভলিউম কম থাকে, তখন তখন স্বল্প মূলধনী শেয়ারে আগ্রহ তৈরি হয়। … এটা একেবারে নেতিবাচক বলব না। কিছু হলেও তো ফ্লোর ছুটল।

“এটা ব্যক্তি বিনিয়োগকারী করছে। এগুলোর অনেকগুলো ফ্লোরে ছিল। বড় শেয়ারে ফান্ড ইনজেক্ট করার মতো ক্ষমতা এদের নেই। তাই স্বল্প মূলধনী কোম্পানিতে কিনেছে।… প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা সক্রিয় হলে ভালো শেয়ারে মুভমেন্ট দেখা যাবে।”

তিনি বলেন, “জাঙ্ক শেয়ার সবেই খারাপ না। অনেক সময় ফান্ডমেন্টাল পাল্টায়, অনেক সময় মালিকানা বদলায়। এতে কোম্পানির ভালো হয়। কিন্তু আজ যেটা হয়েছে, সেটা হলো ঢালাও বৃদ্ধি। ঢালাও তো ফান্ডামেন্টাল বাড়ে না। ওভার ভ্যালুয়েশেন হলে কারও অংশগ্রহণ করা ঠিক হবে না।”

দর বৃদ্ধির শীর্ষে প্রায় সবই দুর্বল কোম্পানি

যেসব কোম্পানির দর বেড়েছে, তার মধ্যে এক দিনে দর বৃদ্ধির সর্বোচ্চ সীমা ছুঁয়েছে ছয়টি। এর মধ্যে ১০ শতাংশ দর বৃদ্ধি পাওয়া ইনটেক অনলাইন গত অর্থবছরে ১০ টাকার শেয়ারে আড়াই টাকার বেশি লোকসান দেওয়ার পর লভ্যাংশ দেয়নি। আগের বছরও লভ্যাংশ দিতে পারেনি তারা। সবশেষ ২০২০ সালে শেয়ার প্রতি ১০ পয়সা লভ্যাংশ দিতে পেরেছিল তারা।

একই হারে দর বৃদ্ধি পাওয়া সমতা লেদার গত এক যুগে লভ্যাংশ দিতে পেরেছে দুইবার। এর মধ্যে ২০১৯ সালে শেয়ার প্রতি ২০ পয়সা এবং ২০২১ সালে ৫ পয়সা করে লভ্যাংশ দিয়েছে তারা। চলতি অর্থবছরের অর্ধবার্ষিকে কোম্পানিটির শেয়ার প্রতি আয় হয়েছে কেবল ৪ পয়সা। তবে এক দিনেই শেয়ারদর ৬ টাকা ৩০ পয়সা বেড়ে হয়েছে ৬৯ টাকা ৩০ পয়সা।

৯.৯৬ শতাংশ দর বেড়ে তৃতীয় স্থানে থাকা হাক্কানি পাল্প গত পাঁচ বছরে মুনাফা করতে পেরেছে একবারই। গত দুই অর্থবছরে শেয়ার প্রতি ১০ পয়সা করে লভ্যাংশ দিয়েছে তারা। গত ৭ বছরে সর্বোচ্চ লভ্যাংশ এসেছে ২০১৫ ও ২০১৬ সালে ৫০ পয়সা করে।

৯.৯৫ শতাংশ দর বেড়ে চতুর্থ স্থানে থাকা ইনফরমেশন সার্ভিসেসের ব্যবসাও ভালো নয়। গত পাঁচ বছরে একবারই শেয়ার প্রতি সর্বোচ্চ ৩০ পয়সা লভ্যাংশ দিতে পেরেছে তারা। দুই বছর লভ্যাংশ দিতে পারেনি লোকসানের কারণে।

গত তিন বছরের মধ্যে কেবল ২০২১ সালে শেয়ার প্রতি একবার ১০ পয়সা হারে লভ্যাংশ দিতে পারা লিগ্যাসি ফুটওয়্যারের উত্থান চলছেই। ৯.৮৮ শতাংশ দর বেড়েছে কোম্পানিটির। গত ২০ মার্চ শেয়ারদর ছিল ৪৩ টাকা, কদিনেই উঠে গেছে ৭৪ টাকা ৫০ পয়সায়।

৯.৮৭ শতাংশ দর বৃদ্ধি পাওয়া সিনোবাংলা ইন্ডাস্ট্রিজ মুনাফায় থাকা কোম্পানি, গত অর্থবছরে শেয়ারপ্রতি এক টাকা লভ্যাংশও দিয়েছে; তবে ৯.৮৩ শতাংশ দর বৃদ্ধি পাওয়া মিরাকল ইন্ডাস্ট্রিজ ২০২১ সালের প্রতিবেদনই প্রকাশ করেনি। ওই অর্থবছরের তৃতীয় প্রান্তিক পর্যন্ত শেয়ারপ্রতি ১ টাকা ২০ পয়সার বেশি লোকসানের তথ্য জানানোর পর আর কিছুই প্রকাশ করেনি তারা।

চলতি অর্থবছরের অর্ধবার্ষিকে শেয়ার প্রতি ২ টাকা ২০ পয়সার বেশি লোকসান দেওয়া জিকিউ বলপেনের দর ৯.৫৫ শতাংশ, ১০ শতাংশ লভ্যাংশ দেওয়া শমরিতা হাসপাতালের শেয়ার দর ৮.৪৫ শতাংশ, অর্ধবার্ষিকে শেয়ার প্রতি ৩ টাকা ৪৮ পয়সা লোকসান দেওয়া এপেক্স ট্যানারির দর ৮.২২ শতাংশ, গত অর্থবছরে শেয়ার প্রতি ৫ টাকা ১১ পয়সা ও চলতি অর্থবছরের অর্ধবার্ষিকে শেয়ারপ্রতি ১ টাকা ১০ পয়সা লোকসান দেওয়া স্টাইলক্রাফটের দর ৭.১৭ শতাংশ বেড়েছে।

আরও চারটি কোম্পানির দর ৬ শতাংশের বেশি, দুটির দর ৫ শতাংশের বেশি, ছয়টির দর ৪ শতাংশের বেশি, ৯টির দর তিন শতাংশের বেশি, ১০টির দর দুই শতাংশের বেশি বেড়েছে। এসব কোম্পানির মধ্যে কমপক্ষে ১০ শতাংশ লভ্যাংশ দিয়েছে, এমন সংখ্যা কমই।