যেভাবে অস্থির হয়ে উঠল আদানির সাম্রাজ্য

আদানি গ্রুপের শেয়ারের দাম যেভাবে পড়া শুরু করেছে, তা কোনোভাবেই থামানো যাচ্ছে না; অব্যাহত এ দরপতনের কারণে গ্রুপটি মাত্র কয়েকদিনে ১০ হাজার ৮০০ কোটি ডলার হারিয়েছে।

নিউজ ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 3 Feb 2023, 05:53 PM
Updated : 3 Feb 2023, 05:53 PM

পুঁজিবাজারে চলমান অস্থিরতার মধ্যে শেয়ার বিক্রির সিদ্ধান্ত থেকে অপ্রত্যাশিতভাবে সরে আসার পর বিনিয়োগকারীদের আশ্বস্ত করার চেষ্টা করে যাচ্ছেন ভারতীয় ধনকুবের গৌতম আদানি, তবে তাতে লাভ হচ্ছে না বিশেষ।

আদানি গ্রুপ জানিয়েছে, পুঁজিবাজারে শেয়ার ছাড়ার পর বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকে তুলে নেওয়া ২৫০ কোটি ডলার তারা ফেরত দেবে।

শেয়ার ছাড়ার পর শেষমেশ বিক্রির সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসার মত বিষয়টি চলমান পরিস্থিতিতে আদানি গ্রুপের জন্য ‘বড় ধাক্কা’র মত হলেও তাদের কার্যক্রম আর ভবিষ্যৎ পরিকল্পনায় এটি কোনো প্রভাব ফেলবে না বলে দাবি করেছেন গৌতম আদানি।

আদানি গ্রুপের ‘শেয়ার দরে কারচুপি’ নিয়ে হিন্ডেনবার্গ রিসার্চ ফার্ম একটি প্রতিবেদন প্রকাশের পর গ্রুপটির শেয়ার দর যেভাবে পড়া শুরু করেছে, তা কোনোভাবেই থামানো যাচ্ছে না। অব্যাহত এ দরপতনের কারণে গ্রুপটি মাত্র কয়েকদিনে ১০ হাজার ৮০০ কোটি ডলারের হারিয়েছে।

পরিস্থিতি দেখে আদানি গ্রুপ তাদের নতুন ২৫০ কোটি ডলারের শেয়ার ছাড়ার এফপিও (ফলো অন পাবলিক অর্ডার) স্থগিত ঘোষণা করে। ইতোমধ্যে এফপিও-তে যারা বিনিয়োগ করেছেন, তাদের অর্থ ফেরত দেওয়ার কথা বলছে আদানি গ্রুপ।

যুক্তরাষ্ট্রের হিন্ডেনবার্গ রিসার্চ ফার্ম আদানি গ্রুপের বিরুদ্ধে ‘শেয়ার দরে কারচুপি’র অভিযোগ তুলে চাঞ্চল্যকর প্রতিবেদন প্রকাশ করে গত ২৪ জানুয়ারি।

ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, দশককাল ধরে শেয়ার কারসাজি এবং আর্থিক লেনদেনে প্রতারণা চালিয়ে আসছে আদানি গ্রুপ। কৃত্রিমভাবে শেয়ারের দর বহু গুণ বাড়িয়ে এ গ্রুপ বিশাল সম্পদ গড়েছে। গত কয়েক বছরে আদানি গ্রুপের কোম্পানির শেয়ার ৫০০ শতাংশেরও বেশি বেড়েছে।

হিন্ডেনবার্গের অভিযোগগুলো গৌতম আদানি অস্বীকার করলেও গ্রুপের বড় ধরনের শেয়ার বিক্রির পরিকল্পনার (এফপিও) মধ্যে সেই প্রতিবেদন সবকিছু ওলোটপালোট করে দেয়।

গত কয়েকদিনে আদানি সাম্রাজ্য কীভাবে ১০ হাজার কোটি ডলারের বেশি হারাল, ব্যক্তিগত ৪ হাজার ৪৮ বিলিয়ন ডলারের সম্পদ কমে গৌতম আদানি কীভাবে ফোর্বসের তালিকায় বিশ্বের তৃতীয় শীর্ষ ধনী থেকে ১৬তম অবস্থানে নেমে গেলেন- সেই বিশ্লেষণ তুলে ধরা হয়েছে বিবিসির প্রতিবেদনে।

কীভাবে ঘটল?

দুই সপ্তাহ আগেও ভারতীয় টাইকুন গৌতম আদানি ছিলেন বিশ্বের তৃতীয় শীর্ষ ধনী। তার হাতেগড়া আদানি এন্টারপ্রাইজ গত ২৫ জানুয়ারি ভারতের সব থেকে বড় সেকেন্ডারি শেয়ার বিক্রি করতে যাচ্ছিল। কিন্তু তার আগের দিন যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক বিনিয়োগ ফার্ম হিন্ডেনবার্গ রিসার্চ একটি প্রতিবেদনে প্রকাশ করে, যেখানে দশককাল ধরে পুঁজিবাজারে শেয়ার নিয়ন্ত্রণ ও আর্থিক প্রতারণার অভিযোগ করা হয় আদানি গ্রুপের বিরুদ্ধে।

পুঁজিবাজারে আদানি গ্রুপের ‘শর্ট সেলিং’ এর অভিযোগ করা হয় হিন্ডেনবার্গের প্রতিবেদনে।

‘শর্ট সেলিং’ হল একটি কৌশল, যেখানে একজন বিনিয়োগকারী কোনো কোম্পানির দর কমতে পারে এমন ধারণা থেকে শেয়ার বিক্রি করে দেয়, যাতে পরে কম দামে কিনে নেওয়া যায়।

আদানি গ্রুপ ওই প্রতিবেদনকে ‘ভিত্তিহীন, জঘন্য আর বিদ্বেষমূলক অপতথ্যের সমাহার’ হিসেবে বর্ণনা করেছে; যদিও বিনিয়োগকারীদের ভয় কাটানোর জন্য তা যথেষ্ট ছিল না।

আদানি গ্রুপের অধীনে সাতটি কোম্পানি রয়েছে, যেগুলো পণ্য ব্যবসা, বিমানবন্দর, বিদ্যুৎ, বন্দর ও নবায়নযোগ্য জ্বালানিসহ বিভিন্ন খাতে ব্যবসা করছে।

অনেক ভারতীয় ব্যাংক এবং রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন বীমা সংস্থা এ গ্রুপের সঙ্গে যুক্ত কোম্পানিগুলোতে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করেছে বা ঋণ দিয়েছে।

এখানেই শেষ?

বিবিসি জানিয়েছে, হিন্ডেনবার্গের প্রতিবেদন আর আদানি সাম্রাজ্যের অস্থিরতাতেই ঘটনা শেষ হচ্ছে না। পুঁজিবাজারের পতন অব্যাহত থাকার মধ্যে আদানি গ্রুপ চারশোর বেশি পৃষ্ঠায় হিন্ডেনবার্গের অভিযোগ খণ্ডন করেছে এবং ওই প্রতিবেদনকে ‘ভারতের ওপর পরিকল্পিত আক্রমণ’ হিসেবে বর্ণনা করেছে।

স্থানীয় সকল আইন মেনে ব্যবসা কার্যক্রম পরিচালনার দাবি করে আদানি গ্রুপ পাল্টা অভিযোগে বলেছে, অসংখ্য বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকে অবৈধভাবে বিপুল আর্থিক সুবিধা পেতে হিন্ডেনবার্গ ওই প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে।

তবে হিন্ডেনবার্গ তাদের প্রতিবেদনের পক্ষে অনড় থেকে বলছে, তাদের ৮৮টি প্রশ্নের মধ্যে ৬২টি প্রশ্নের উত্তরই সুনির্দিষ্টভাবে দিতে পারেনি আদানি গ্রুপ।

বাজারে কী প্রভাব?

২৫ জানুয়ারি আদানি এন্টারপ্রাইজের শেয়ার বিক্রি যখন শুরু হয়, এর প্রতিক্রিয়া ছিল খানিকটা চুপচাপ। খুচরা বিনিয়োগকারীরা দূরে থাকায় বাজার খোলার দ্বিতীয় দিনের মধ্যে মাত্র ৩ শতাংশ শেয়ার বিক্রি হয়।

কিন্তু ৩০ জানুয়ারি বিদেশি বিনিয়োগকারী আর করপোরেট ফান্ডগুলো মাঠে নামে। সংযুক্ত আরব আমিরাতের রাজ পরিবারের সদস্যদের আবুধাবি ইন্টারন্যাশনাল হোল্ডিং কোম্পানি ৪০ কোটি ডলার বিনিয়োগ করে এই শেয়ারে।

পুঁজিবাজারে শেষ মূহূর্তের কেনাবেচায় ভারতীয় টাইকুন সজ্জন জিনদাল ও সুনিল মিত্তালও শেয়ার কেনেন।

বিশ্লেষক অম্বরীশ বালিগা রয়টার্সকে বলেন, শেয়ার বিক্রির পরও আদানি গ্রুপ শেয়ারহোল্ডিংয়ের বিস্তৃত লক্ষ্য পূরণ করতে পারেনি। এ গ্রুপের বিভিন্ন কোম্পানির শেয়ারের দরপতন অব্যাহত রয়েছে।

এরপর কী?

রয়টার্স ও ব্লুমবার্গ জানিয়েছে, ভারতের যেসব বিনিয়োগকারী আদানিগ্রুপে বিনিয়োগ করেছেন, তাদের বিস্তারিত জানতে চেয়েছে দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

ভারতীয় পুঁজিবাজারকে দেওয়া বিবৃতিতে আদানি জানিয়েছেন, শক্তিশালী নগদ অর্থ প্রবাহ এবং নিরাপদ সম্পদের কারণে তাদের ব্যালেন্স শিট খুব সমৃদ্ধ এবং ঋণ পরিশোধে তাদের অনবদ্য রেকর্ড রয়েছে।

কিন্তু ওয়ান্ডার বিশ্লেষক এডওয়ার্ড মোয়া রয়টার্সকে বলেছেন, শেয়ার বিক্রির পর তা প্রত্যাহারের সিদ্ধান্তে জটিলতা আরও বেড়েছে। কারণ বড় কিছু কোম্পানি শেয়ার কেনার পর এই ধারণা পাওয়া যাচ্ছিল যে, আদানির ওপর উচ্চমূল্যের বিনিয়োগকারীদের আস্থা এখনও অটুট রয়েছে। আদানি শেয়ার প্রত্যাহারের ঘোষণা দেওয়ায়, সেই ধারণা টেকেনি।

মার্জিন লোনের জামানত হিসেবে আদানিগ্রুপের শেয়ার নেওয়া বন্ধ করে দিয়েছে আমেরিকার বিনিয়োগ ব্যাংক সিটিগ্রুপ। ক্রেডিট সুইসও আদানি গ্রুপের বন্ড আর বন্ধক বা জামানত হিসেবে নিচ্ছে না।

রেটিং এজেন্সি মুডিসের ইউনিট আইসিআরএ বলছে, তারা আদানি গ্রুপের শেয়ারের সাম্প্রতিক পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছে।

ইনফ্রাভিশন ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা ও ম্যানেজিং ট্রাস্টি বিনায়েক চ্যাটার্জি অবশ্য খানিকটা আশাবাদী। তিনি মনে করেন, আদানি গ্রুপের এই হাল ‘স্বল্পমেয়াদী দূরাবস্থা’।

“অবকাঠামো বিশেষজ্ঞ হিসেবে আমি এই গ্রুপকে ২৫ বছর ধরে পর্যবেক্ষণ করছি। বন্দর, বিমানবন্দর ও সিমেন্ট থেকে নবায়নযোগ্য সেক্টর পর্যন্ত বিভিন্ন প্রকল্প দেখেছি, যেগুলো মজবুত, স্থিতিশীল এবং ভালো অর্থপ্রবাহ তৈরি করছে। শেয়ারবাজারে উত্থান-পতন থেকে এগুলো সম্পূর্ণ নিরাপদ।”

তবে স্বাধীন গবেষণা বিশ্লেষক হেমিন্দ্র হাজারি বলেন, তিনি অবাকই হয়েছেন, কারণ ভারতের পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা কিংবা সরকারের তরফ থেকে এখন পর্যন্ত কোনো বক্তব্য জানা যায়নি।

“বিনিয়োগকারীদের স্নায়ু শান্ত করার জন্য এখন তাদের (সরকার ও সেবি) কথা বলা উচিত,” বলেন তিনি।

এদিকে আদানি গ্রুপের বিরুদ্ধে পুঁজিবাজারে ‘ধোঁকাবাজির’ অভিযোগ ওঠার পর বিষয়টি নিয়ে রাজনৈতিক বিতর্কও শুরু হয়েছে। আদানিকে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর ঘনিষ্ঠ মিত্র মনে করা হয়। যে কারণে দেশটির বিরোধীদলগুলোর অভিযোগ, রাজনৈতিক মিত্রতার কারণে আদানি বিশেষ সুবিধা পান।

আর হিন্ডেনবার্গের প্রতিবেদনের পরই আদানির বিরুদ্ধে ঘটনার সুষ্ঠু তদন্তের দাবি জানিয়েছে ভারতের প্রধান বিরোধী রাজনৈতিক দল জাতীয় কংগ্রেস।

আদানি গ্রুপের শেয়ারের দর পতনে ভারতীয় বিনিয়োগকারীদের ঝুঁকির বিষয়গুলো নিয়ে পার্লামেন্টে আলোচনার জন্য বৃহস্পতিবার দাবি তুলেছে বিরোধীদলগুলো। হিন্ডেনবার্গের অভিযোগ তদন্তের দাবি জানাচ্ছেন তারা।

আরও পড়ুন-

Also Read: দরপতন থামছেই না, ৮ দিনে ১০ হাজার কোটি ডলার হারাল আদানি গ্রুপ

Also Read: এশিয়ার শীর্ষ ধনীর মুকুট হারালেন গৌতম আদানি

Also Read: আদানি সাম্রাজ্য টালমাটাল