মিউচুয়াল ফান্ড ও পুঁজিবাজারের ক্ষতির পেছনে বিএসইসির বড় দায় দেখছেন এই পুঁজিবাজার বিশেষজ্ঞ।
Published : 21 Aug 2024, 04:06 PM
দেশের পুঁজিবাজার সম্প্রসারণ ও বিনিয়োগকারীদের আস্থায় আনতে বিশেষ ছাড় বা প্রণোদনা দিয়ে বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানকে তালিকাভুক্তি করতে সরকারকে পরামর্শ দিয়েছেন অর্থনীতিবিদ আবু আহমেদ।
বুধবার রাজধানীর পল্টনে পুঁজিবাজারভিত্তিক সাংবাদিকদের সংগঠন ক্যাপিটাল মার্কেট জার্নালিস্টস ফোরাম, সিএমজেএফ আয়োজিত প্রশিক্ষণ কর্মশালার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, “বিদেশি ও দেশের বড় কোম্পানিকে পুঁজিবাজারে আনতে সরকারের পক্ষ থেকে তাদের পারস্যু করতে হবে। সিস্টেম ইনসেনটিভ দেওয়া লাগবে, নইলে তারা আসবে না।”
বিভিন্ন কোম্পানির ব্যবসার ধরণ পৃথক হওয়ায় প্রত্যেকের চাহিদাও আলাদা। তাই সবার সঙ্গে বসে চাহিদা অনুযায়ী নীতিমালা ও কর ছাড় দিয়ে তালিকাভুক্তিতে উৎসাহী করাকেই সিস্টেম ইনসেনটিভ বলছেন তিনি।
আবু আহমেদ বলেন, “নতুন সরকার এসেছে, আমি অনুরোধ করব বাজেটের সময়ে তাদের জন্য কিছু রাখা। এনবিআরের কাজ হলো সরকারি কাজটি করা, দেশের অর্থনীতির জন্য কাজ করা। নিজেদের পকেট ভারি করার জন্য না।”
দেশের পুঁজিবাজারে রেকিট-বেনকিজার, গ্রামীণ ফোন, ম্যারিকো, বিএটিবিসি, বাটা’র মতো হাতে গোনা কয়েকটি বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান তালিকাভুক্ত।
সবশেষ ২০০৯ সালে গ্রামীণ ফোন তালিকাভুক্ত হওয়ার পর নতুন কোনো বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান দেশের পুঁজিবাজারে আসেনি।
১৯৭৬ সাল থেকে দেশের পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হওয়া বহুজাতিক ব্রিটিশ ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানি গ্লাক্সোস্মিথক্লাইন পিএলসি (জিএসকে) বন্ধ হয় ২০১৮ সালে, তবে তাদের কনজ্যুমার হেলথকেয়ার ব্যবসা প্রতিষ্ঠান চালু ছিল। দুই বছর পরে কনজ্যুমার হেলথকেয়ার ব্যবসা কিনে নেয় আরেক বহুজাতিক কোম্পানি ইউনিলিভার বাংলাদেশ। এভাবেই দেশের পুঁজিবাজারে ইউনিলিভার যুক্ত হয়।
কিন্ত নেসলে, ব্যাংক খাতের স্ট্যান্ডার্ড চার্টাড ও সিটি ব্যাংক এনএ, ব্যাংক আল ফালাহ, কোকা-কোলা, শ্যাম্পু উৎপাদনকারী প্রক্টার অ্যান্ড গ্যাম্বলের মতো নামি কোম্পানি এখনও তালিকাভুক্ত হয়নি। অন্যান্য দেশে ব্যবসা করতে গিয়ে তাদের পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হতে হয়েছে।
পুঁজিবাজার বিশেষজ্ঞ আবু আহমেদ বলেন, “সরকারের দায়িত্বে থাকা ব্যক্তিরা কতজনের সঙ্গেই তো মিটিং করে, কোম্পানিগুলোর সঙ্গে মিটিং করুক একবার। তাদের চায়ের দাওয়াত তো দিল না কেউ।”
ঋণনির্ভর অর্থনীতি কখনই শক্তিশালী হতে পারে না। শ্রীলঙ্ক, কেনিয়া ও সবশেষ পাকিস্তান তার উদাহরণ জানিয়ে তিনি বলেন, “আমাদের অর্থনীতির শক্তি হলো আমরা। ভেতর থেকেই আমাদের শক্ত হতে হবে। বিদেশি কোনো ঋণে নয়, আমাদের অর্থনীতি আমাদেরকে ঠিক করতে হবে।”
সামষ্টিক অর্থনীতিকে বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে হয়। মূল্যস্ফীতি, রিজার্ভ, সুদহার ও বিনিময় হার নির্ধারণ সবকিছুই করতে হয় অন্যান্য দেশের অর্থনীতির দিকে খেয়াল রেখে। এজন্য বিশ্বের সঙ্গে অর্থনীতি চলছে কি না, তা দেখার অনুরোধ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক এ শিক্ষক বলেন, “পুরো বিশ্ব থেকে অর্থনীতিকে বিচ্ছিন্ন করা যাবে না, তাহলে ভুল হবে। অর্থনীতি যতই ছোট হোক তাকে বিশ্বের সঙ্গে সম্পর্ক রেখেই চলতে হবে।”
আবু আহমেদ বলেন, “অর্থনীতিতে অলিগার্ক তৈরি হয়েছে। এদেরকে প্রশ্রয় দিয়ে তৈরি করেছে নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলো। পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) ও বাংলাদেশ ব্যাংক ভূমিকা রেখেছে তাদের পক্ষে।”
“বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ নিশ্চিত করতে পারেনি বিএসইসি। ফান্ড ম্যানেজার টাকা-পয়সা নিয়ে ভেগে যায় কীভাবে? এজন্য নিয়ন্ত্রক সংস্থাই বড় দায়ী। মিউচুয়াল ফান্ড ও পুঁজিবাজারকে ক্ষতি করার পেছনে বড় দায় বিএসইসির।”
ইসলামী ব্যাংক, ন্যাশনাল ব্যাংকে লুট হয়েছে মন্তব্য করে তিনি বলেন, “যারা লুট করেছে তাদের শাস্তি দিতে হবে। না হলে জনগণের মধ্যে আস্থা ফিরবে না। বড় বড় কোম্পানির মালিকরা এ লুটপাট করেছে। বাংলাদেশ ব্যাংক কীভাবে পারল ব্যাংক দখল করার সুযোগ দিতে? ব্যাংকে বড় ঋণ কেলেঙ্কারি কীভাবে হয়? এটা দেখার দায়িত্ব তো তাদের।”
নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর ব্যর্থতার কারণেই দেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধির ৯০ শতাংশই অল্প কয়েকজনের দখলে চলে গেছে মন্তব্য করে আবু আহমেদ বলেন, “এভাবে অর্থনীতি চালালে তো সাধারণ মানুষের দুর্দশা হবেই। সাধারণ মানুষরা ভোগান্তিতে থাকবেই।’’
মিউচুয়াল ফান্ড ও পুঁজিবাজারের ক্ষতির পেছনে বিএসইসির বড় দায় দেখছেন এই পুঁজিবাজার বিশেষজ্ঞ।
“মিউচুয়াল ফান্ড খারাপ হওয়ার কথা আমরা বারবার আলোচনা করি। এক্ষেত্রে সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন দায়ী। প্লেসমেন্ট শেয়ার আরেকটি বড় দুর্নীতির জায়গা। এটা নিয়েও রেগুলেটর কাজ করতে পারেনি। ভালো আইপিও আসছে না, আনার চেষ্টাও করা হয়নি।”
প্রশিক্ষণ কর্মশালায় ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের ব্রোকারেজ প্রতিষ্ঠানগুলোর সংগঠন ডিবিএর সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট মো. সাইফুদ্দিন বলেন, “পুঁজিবাজারের জন্য গুরুত্বপূর্ণ হলো, যা লেখা হচ্ছে তা বস্তুনিষ্ঠ কি না। জনগণ সঠিক তথ্য পেতে সাংবাদিকদের দিকে তাকিয়ে থাকে ।”
সিএমজেএফ সভাপতি গোলাম সামদানী বলেন, “আমরা একটা সুস্থ ও দুর্নীতিমুক্ত পুঁজিবাজার চাই। যে পুঁজিবাজারের মাধ্যমে দেশের অর্থনীতি সমৃদ্ধ হবে। আর সেটা করতে হলে পুঁজিবাজারে যারা দীর্ঘদিন ধরে অনিয়ম দুর্নীতি করছে, তাদের বিচারের আওতায় আনতে হবে।”
সংগঠনটির সাধারণ সম্পাদক আবু আলী বলেন, “অর্থনৈতিক সাংবাদিকতা সহজসাধ্য নয়। এখানে শব্দ চয়ন ও তার বিশ্লেষণ খানিকটা জটিল ও দুর্বোধ্য হয়ে থাকে। পাঠক ও টেলিভিশনের দর্শকের কাছে সহজভাবে উপস্থাপন করতে জানতে হয় অনেক। এজন্য দীর্ঘমেয়াদী প্রশিক্ষণের আয়োজন করা হয়েছে সংগঠনের সদস্যদের জন্য।”
অনুষ্ঠানে অন্যদের মধ্যে বক্তব্য রাখেন সিএমজেএফের সাবেক সভাপতি জিয়াউর রহমান, সিএমজেএফ যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ইব্রাহীম হোসেন রেজওয়ান ও সাবেক অর্থ সম্পাদক নিয়াজ মাহমুদ।