কোনো স্টেডিয়াম তৈরি হয়েছে নৌকার আদলে, কোনোটা দেখতে টুপির মতো, আবার কোনোটায় ব্যবহার করা হয়েছে শিপিং কন্টেইনার। ফুটিয়ে তোলা হয়েছে কাতারের ইতিহাস ও ঐতিহ্য। এমন নান্দনিক সব স্টেডিয়ামেই বসবে এবারের বিশ্ব ফুটবলের জমজমাট লড়াই।
মধ্যপ্রাচ্যের প্রথম দেশ হিসেবে এবার বিশ্বকাপের আয়োজক হয়েছে কাতার। বিশাল এই আয়োজনের প্রস্তুতিতে দেশটিতে কাজ করা অভিবাসী শ্রমিকদের সঙ্গে অমানবিক আচরণ করা হয়েছে বলে শুরু থেকে অভিযোগ করে আসছে মানবাধিকার সংস্থাগুলো।
এসব নেতিবাচকতার মাঝেই আগামী রোববার শুরু হতে যাচ্ছে কাতার বিশ্বকাপ। প্রায় এক মাস ফুটবলে বুঁদ থাকবে গোটা দুনিয়া। শ্রেষ্ঠত্বের যে লড়াইয়ে মাঠে নামবে ৩২টি দেশ, আটটি স্টেডিয়ামে হবে ৬৪টি ম্যাচ।
চার বছর আগে রাশিয়া বিশ্বকাপে উত্তরের সেন্ট পিটার্সবুর্গ থেকে দক্ষিণে ক্রাসনোদার, দুটি আয়োজক শহরের দূরত্ব ছিল ১ হাজার মাইলের বেশি। ফলে দলগুলো থেকে শুরু করে দর্শক, সংবাদকর্মীদের আকাশপথে ভ্রমণ করতে হয়েছিল।
আর কাতারে দুটি স্টেডিয়ামের মধ্যে সর্বোচ্চ দূরত্ব মাত্র ৩৪ মাইল, সর্বনিম্ন স্রেফ ৪ মাইল। অভ্যন্তরীণ বিমান ভ্রমণের কোনো প্রয়োজন নেই। দর্শকরা চাইলে একদিনে একাধিক ম্যাচও দেখতে পারবেন!
প্রতিটি স্টেডিয়াম, ট্রেনিং কমপ্লেক্স ও ফ্যান জোনে তাপমাত্রা ২৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস রাখতে সৌরবিদ্যুৎ-চালিত কুলিং প্রযুক্তি থাকবে। সব স্টেডিয়ামই পরিবেশ বান্ধব এবং সেগুলোর তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে থাকবে।
আল বাইত স্টেডিয়াম, আল খোর
দর্শক ধারণক্ষমতা: ৬০ হাজার
আল খোর শহর কাতারের উত্তর-পূর্ব উপকূলে অবস্থিত। রাজধানী দোহা থেকে প্রায় ৫০ কিলোমিটার (৩১ মাইল) দূরে। এটিকে কাতারের প্রধান শহরগুলির একটি হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
পুরো স্টেডিয়াম জুড়ে একটি বিশালাকার তাঁবুর আকৃতির কাঠামো রয়েছে। এটি বাইত আল শা’আর-এর নামে নামকরণ করা হয়েছে, যা মূলত কাতার ও উপসাগরীয় অঞ্চলের যাযাবর মানুষদের ঐতিহাসিকভাবে ব্যবহৃত তাঁবু।
স্টেডিয়ামটির নকশা কাতারের অতীত এবং বর্তমান ঐতিহ্যকে তুলে ধরেছে। বিশ্বকাপ শেষে স্টেডিয়ামের ওপরের অংশটি ভেঙে ফেলা হবে এবং আসনগুলি অন্যান্য দেশকে দিয়ে দেওয়া হবে।
বিশ্বকাপের ম্যাচ: গ্রুপ পর্ব থেকে সেমি-ফাইনাল পর্যন্ত মোট ৯টি ম্যাচ হবে এই স্টেডিয়ামে।
আহমেদ বিন আলি স্টেডিয়াম, আল রাইয়ান
দর্শক ধারণক্ষমতা: ৪০ হাজার
দোহা থেকে ২০ কিলোমিটার পশ্চিমের পৌরসভা আল রাইয়ানে পূর্বের আহমেদ বিন আলি স্টেডিয়ামের জায়গায় নির্মিত হয়েছে এই স্টেডিয়াম। জায়গাটির চারপাশের কারণে কখনও কখনও এটিকে ‘মরুভূমির প্রবেশদ্বার’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়।
এই স্টেডিয়ামটি দেশটির সবচেয়ে বড় শপিং সেন্টারের পাশে অবস্থিত। কাছাকাছি আল রিফা আন্ডারগ্রাউন্ড স্টেশনের কারণে এটি রাজধানী দোহার সঙ্গে ভালোভাবে সংযুক্ত।
স্টেডিয়ামটিতে কাতারের সংস্কৃতির প্রতিফলন ঘটেছে, বিশেষ করে এর দর্শনীয় সম্মুখভাগের মাধ্যমে। বিশ্বকাপের পর এই স্টেডিয়ামের প্রায় ২০ হাজার আসন কমানো হবে এবং আসনগুলি বিদেশে ফুটবল উন্নয়ন প্রকল্পগুলিতে দেওয়া হবে।
বিশ্বকাপের ম্যাচ: গ্রুপ পর্ব ও শেষ ষোলো মিলিয়ে এখানে ম্যাচ হবে মোট ৭টি।
আল জানোব স্টেডিয়াম, আল ওয়াকরা
দর্শক ধারণক্ষমতা: ৪০ হাজার
রাজধানী দোহা থেকে ১৮ কিলোমিটার দূরে আল ওয়াকরা শহরের অবস্থান। এটিকে বর্তমানে কাতারের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
একটা সময় এটি মূলত মাছ ধরা এবং মুক্তা সংগ্রহের ছোট এক গ্রাম ছিল। এই কাজে ব্যবহৃত ঐতিহ্যবাহী ধো নৌকার আকৃতি থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে আল জানোব স্টেডিয়ামের নকশা করা হয়।
এই স্টেডিয়ামটি একটি বিস্তৃত ক্রীড়া কমপ্লেক্সের অংশ। যেখানে সাইক্লিং ও হর্স ট্রেইল এর ব্যবস্থা এবং দোকান, রেস্তোরাঁ ও ক্রীড়া ক্লাব রয়েছে।
স্টেডিয়ামে ঢুকতেই দর্শকদের সামনে পড়বে সুন্দর পার্কল্যান্ড ও মার্জিত স্থাপত্য। ম্যাচের আগে-পরেও আল ওয়াকরার চারপাশে দর্শকদের জন্য অনেক কিছু উপভোগের আছে। দর্শকরা জলাধারের পাশে ঘুরে বেড়াতে পারবেন, স্থানীয় জিনিসপত্র কিনতে পারবেন বা জাদুঘরে এই জায়গাটির সমৃদ্ধ ইতিহাস সম্পর্কে জানতে পারবেন।
বিশ্বকাপের পর স্টেডিয়ামের ধারণক্ষমতা কমিয়ে ২০ হাজার আসন করা হবে।
বিশ্বকাপের ম্যাচ: গ্রুপ পর্ব ও শেষ ষোলো মিলিয়ে স্টেডিয়ামটিতে ম্যাচ হবে মোট ৭টি।
খলিফা ইন্টারন্যাশনাল স্টেডিয়াম, আল রাইয়ান
দর্শক ধারণক্ষমতা: ৪৫ হাজার ৫০০
স্টেডিয়ামটি দোহার পশ্চিমে শহরের কেন্দ্র থেকে প্রায় ১০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত।
স্টেডিয়ামটি প্রথমে নির্মিত হয়েছিল ১৯৭৬ সালে। পরে এটির অবকাঠামোগত পরিবর্তন করা হয়। মূলত কাতারে অনুষ্ঠিত ২০০৬ এশিয়ান গেমসের মূল ভেন্যু হিসেবে ব্যবহারের জন্য ২০০৫ সালে এটির সংস্কার ও প্রসার করা হয়।
স্টেডিয়ামটিতে আংশিকভাবে ঢেকে দেওয়া গ্যালারি আছে। স্টেডিয়ামটি মূলত দোহা স্পোর্টস সিটির কেন্দ্র। ‘অ্যাসপায়ার জোন’ নামের এই ক্রীড়া কমপ্লেক্সে স্পোর্টস মেডিসিন হাসপাতালসহ অন্যান্য অনেক খেলার জায়গা রয়েছে।
স্টেডিয়ামটি থেকে হেঁটেই যাওয়া যায় ৩-২-১ কাতার অলিম্পিক ও স্পোর্টস মিউজিয়ামে।
বিশ্বকাপের ম্যাচ: গ্রুপ পর্ব, শেষ ষোলো ও তৃতীয় স্থান নির্ধারণী-সহ এখানে ম্যাচ হবে মোট ৮টি।
এডুকেশন সিটি স্টেডিয়াম, আল রাইয়ান
দর্শক ধারণক্ষমতা: ৪০ হাজার
রাজধানী দোহার মূল কেন্দ্র থেকে মাত্র ৭ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত এই স্টেডিয়াম। যেটির চারপাশে রয়েছে বেশ কয়েকটি বিশ্ব-মানের বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস।
এর কুলিং সিস্টেম থেকে শুরু করে সবুজে ঘেরা স্টেডিয়ামটির চারপাশ। স্থায়িত্ব এবং ভবিষ্যতের কথা মাথায় রেখেই এটি তৈরি করা হয়েছে।
হীরার আকৃতির এই স্টেডিয়ামে সহজেই যাওয়া যাবে সড়কপথে কিংবা মেট্রোতে। বিশ্বকাপের পর এটির আসন সংখ্যা ২৫ হাজারে নামিয়ে আনা হবে এবং অতিরিক্ত আসন উন্নয়নশীল দেশগুলিকে দান করা হবে।
বিশ্বকাপের ম্যাচ: গ্রুপ পর্ব, শেষ ষোলো ও একটি কোয়ার্টার-ফাইনালসহ এই মাঠে ম্যাচ হবে মোট ৮টি।
লুসাইল স্টেডিয়াম, লুসাইল
দর্শক ধারণক্ষমতা: ৮০ হাজার
দোহা থেকে ১৫ কিলোমিটার উত্তরে লুসাইল শহরে অবস্থিত নবনির্মিত এই স্টেডিয়াম। এটি কাতারের সবচেয়ে বড় ও বিশ্বকাপের মূল স্টেডিয়ামগুলির একটি। টুর্নামেন্টের ফাইনাল ম্যাচ হবে এখানেই।
স্টেডিয়ামটি লুসাইলের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠবে। বিশেষ করে এই অঞ্চলের বাসিন্দাদের চাহিদার কথা মাথায় রেখে এটির ডিজাইন করা হয়েছে। কাতারের ইতিহাসে নতুন অধ্যায় রচনা করবে এই লুসাইল স্টেডিয়াম।
বিশ্বকাপ শেষে লুসাইল স্টেডিয়ামটি স্কুল, দোকান, ক্যাফে, খেলাধুলার সুবিধা এবং ক্লিনিকসহ একটি কমিউনিটিতে রূপান্তরিত হবে। তখন স্টেডিয়ামের ৮০ হাজার আসনের বেশিরভাগই সরিয়ে নেওয়া হবে এবং ক্রীড়া প্রকল্পগুলিতে দান করা হবে।
বিশ্বকাপের ম্যাচ: গ্রুপ পর্ব, শেষ ষোলো, একটি করে কোয়ার্টার-ফাইনাল ও সেমি-ফাইনাল এবং ফাইনালসহ মোট ১০টি ম্যাচ হবে এই স্টেডিয়ামে।
স্টেডিয়াম ৯৭৪, দোহা
দর্শক ধারণক্ষমতা: ৪০ হাজার
হামাদ আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে কয়েক মিনিটের দূরত্বে অবস্থিত এই স্টেডিয়াম। এখান থেকে উপসাগরীয় উপকূল এবং পশ্চিম উপসাগরীয় আকাশচুম্বী ভবনগুলির মনোমুগ্ধকর দৃশ্য দেখা যায়।
ক্রীড়া স্টেডিয়াম নির্মাণের জগতে একটি অগ্রণী প্রকল্প এই স্টেডিয়াম। এটি তৈরি করা হয়েছে শিপিং কন্টেইনার দিয়ে। বিশ্বকাপের পর স্টেডিয়ামটি সম্পূর্ণভাবে ভেঙে ফেলা হবে এবং নির্মাণে যে উপকরণগুলি ব্যবহার করা হয়েছে তা পুনরায় ব্যবহার করা হবে।
ফিফা বিশ্বকাপের ইতিহাসে এটিই প্রথম সম্পূর্ণরূপে অপসারণযোগ্য ভেন্যু।
বিশ্বকাপের ম্যাচ: গ্রুপ পর্ব থেকে শেষ ষোলো পর্যন্ত ৭টি ম্যাচ হবে এই মাঠে।
আল থুমামা স্টেডিয়াম, দোহা
দর্শক ধারণক্ষমতা: ৪০ হাজার
দোহার জমকালো স্কাইলাইন থেকে ১২ কিলোমিটার দক্ষিণে অবস্থিত এই স্টেডিয়াম। হামাদ আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে এটির দূরত্বও কয়েক মিনিটের।
আল থুমামা স্টেডিয়ামটি আরব বিশ্বের ঐতিহ্যবাহী ‘গাহফিয়া’-এর আদলে তৈরি করা। ‘গাহফিয়া’ হলো এক ধরনের বোনা টুপি, যা আরব বিশ্বের ঐতিহ্যবাহী পোশাকের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এই এলাকার সংস্কৃতি, ইতিহাস ও প্রতীকের জন্য স্টেডিয়ামটি একটি বার্তা।
বিশ্বকাপ শেষে স্টেডিয়ামটির ধারণক্ষমতা ২০ হাজার আসনে নামিয়ে আনা হবে। অতিরিক্ত আসনগুলি উন্নয়নশীল দেশগুলিকে উপহার দেওয়া হবে।
বিশ্বকাপের ম্যাচ: গ্রুপ পর্ব, একটি করে শেষ ষোলোর ও কোয়ার্টার-ফাইনালসহ এই স্টেডিয়ামে ম্যাচ হবে মোট ৮টি।