শিরোপার হাহাকার ঘুচিয়ে দেওয়ার বার্তা ব্রাজিল দিল ভয়ঙ্কর সুন্দর ফুটবলের পসরা মেলে।
Published : 06 Dec 2022, 11:00 AM
আগের দুটি জয় যেন গল্প হয়ে ওঠেনি। সেখানে আনন্দ ছিল, কিন্তু ব্রাজিলের চিরচেনা সুন্দর ফুটবলের সুরের মূর্ছনা ছিল না। পয়েন্ট পাওয়ার স্বস্তি ছিল, কিন্তু পুর্ণ তৃপ্তি যেন ছিল না। দক্ষিণ কোরিয়ার বিপক্ষে কাতার বিশ্বকাপের শেষ ষোলোর ম্যাচে সবই পেল ব্রাজিল। দুই দশক ধরে চলা শিরোপার হাহাকার ঘুচিয়ে দেওয়ার বার্তাও নেইমার-রিশার্লিসনরা দিলেন ভয়ঙ্কর সুন্দর ফুটবলের পসরা মেলে।
গ্রুপ পর্বের তিন ম্যাচে ব্রাজিলের জয় দুটি, একটিতে হার। ওই দুই জয়ের ম্যাচের মধ্যে সার্বিয়ার বিপক্ষে রিশার্লিসনের দ্বিতীয় গোলটিই ছিল একমাত্র ঝলক। শরীরটাকে পাখির ডানায় ভাসিয়ে চোখ ধাঁধানো ভলিতে জাল খুঁজে নিয়েছিলেন তিনি। ওই ম্যাচে তার আগের গোলটি করা সুযোগসন্ধানী টোকায়, সুইজারল্যান্ডের বিপক্ষে পরের ম্যাচে কামেসিমোর গোল আড়াআড়ি শটে। এরপর বেঞ্চের শক্তি পরীক্ষা করতে গিয়ে ক্যামেরুনের কাছে তো হেরেই যায় ব্রাজিল।
অসংখ্য সুযোগ হারিয়ে তিন ম্যাচে ব্রাজিল করতে পারে মোটে তিন গোল। তাই ‘জি’ গ্রুপের সেরা হয়ে ব্রাজিল শেষ ষোলোয় উঠলেও তাদের সেরাটা দেখতে না পারার অতৃপ্তিটুকু ঠিকই থাকে সেলেসাও সমর্থকদের। দক্ষিণ কোরিয়া ম্যাচে ঘুচে গেল সেই অতৃপ্তি। স্টেডিয়াম ৯৭৪-এর আঙিনা যেন নেইমার-রিশার্লিসন-পাকেতাদের জন্য হয়ে ওঠল ইচ্ছেমতো কবিতা লেখার খাতা। রাশভারী ‘প্রফেসর’ তিতে তাই সব ব্যবধান ভুলে শিষ্যদের সঙ্গে নেচে উঠলেন সাম্বার তালে!
৪-১ স্কোরলাইন দেখে যে কেউ বলবে, দক্ষিণ কোরিয়াকে গুঁড়িয়ে দিয়েছে ব্রাজিল। কিন্তু এখানে লেখা থাকবে না কী অনন্য সুন্দর ফুটবলই না রেকর্ড পাঁচবারের চ্যাম্পিয়নরা খেলেছে প্রথমার্ধে! হয়তো ম্যাচের গল্পের শেষ লাইনটা সাফল্যের তুলিতে লেখা হয়ে গিয়েছিল বলে নেইমাররা দ্বিতীয়ার্ধে আর মরিয়া হয়ে ওঠেননি। কোচ তিতেও বাকি পথটুকু সাবধানে পেরুতে চান বলে বেছে নেনে কচ্ছপ গতিতে গন্তব্যে পৌঁছানোর ছক।
তিতের শুরুর ছকে অবশ্য ব্রাজিল অনন্য, অবিশ্বাস্য, ধারাল এবং ভয়ঙ্কর সুন্দর। ভিনিসিউস জুনিয়রের গতি, নেইমারের পায়ের কারিকুরি, বিবর্ণতার বৃত্ত ভেঙে রাফিনিয়ার তেড়েফুঁড়ে বেরিয়ে আসা, রিশার্লিসনের জ্বলে ওঠা, লুকাস পাকেতার বিধ্বংসী মানসিকতা-সব মিলিয়ে যেন শতদলে নিজেদের মেলে ধরে ব্রাজিল। তাই সপ্তম মিনিটে ভুলের পথে পা বাড়াতে হয় দক্ষিণ কোরিয়াকে।
ডি-বক্সের বাইরে কোরিয়া বল হারানোর পর নিয়ন্ত্রণে নিয়ে একজনের বাধা এড়িয়ে ডি-বক্সে ঢুকে পড়েন রাফিনিয়া। বাইলাইন থেকে তার বাড়ানো পাস প্রথম ছোঁয়ায় নিয়ন্ত্রণে নিয়ে ডান পায়ের জোরাল শটে দূরের পোস্ট দিয়ে লক্ষ্যভেদ করে কাতার বিশ্বকাপে গোলের খাতা খোলেন ভিনিসিউস। চলতি আসরে এই প্রথম প্রথমার্ধে গোল পায় ব্রাজিলও।
ছয় মিনিট পর স্পট কিক থেকে ব্যবধান দ্বিগুণ করেন নেইমার। পরে আর গোল না পেলেও পায়ের জাদুতে মুগ্ধতা ছড়াতে থাকেন কিংবদন্তি পেলের গোলের রেকর্ড (৭৭টি) থেকে এক গোল দূরত্বে থাকা এই ফরোয়ার্ড। কখনও হওয়াং ইন-বমকে পায়ের কারিকুরিতে বোকা বানান, কখনও চকিত চমকে মরুঝড়ের বেগে কোরিয়ার রক্ষণ চিরে বেরিয়ে যান তিনি। গ্যালারিও কেঁপে ওঠে চোট কাটিয়ে ফেরা নেইমারকে মুগ্ধতা নিয়ে দেখার উচ্ছ্বাসে।
জয়ের পথে ছুটতে থাকা ব্রাজিলের তান কাঁটতে দেননি পোস্টের নিচে মোটামুটি অলস সময় কাটানো আলিসন। কোরিয়ার মিডফিল্ডার হাং হি-চানের বুলেট গতির শট ক্রসবার ঘেঁষে জালে জড়াতে যাচ্ছিল, শেষ মুহূর্তে কর্নারের বিনিময়ে ঠেকান লিভারপুল গোলরক্ষক। দ্বিতীয়ার্ধে অবশ্য একবার পরাস্ত হয়েছিলেন আলিসন, কিন্তু ব্রাজিল কিস্তিমাত করে কোয়ার্টার-ফাইনালে ওঠার পথে।
ভিনিসিউস ও নেইমারের ঝলকের পর চোখজুড়ানো গোলে দৃশ্যপটে রিশার্লিসন। প্রথমে মাথা দিয়ে, পরে পায়ে বল নিয়ে কারিকুরিতে প্রতিপক্ষের একজনকে ফাঁকি দিয়ে সামনে মার্কিনিয়োসকে বাড়িয়ে বক্সে ঢুকে পড়েন। এর মাঝেই মার্কিনিয়োস পাস দেন চিয়াগো সিলভাকে আর অধিনায়ক থ্রু বল বাড়ান বক্সে। প্রথমে ডান পায়ে বল ধরে বাঁ পায়ের আলতো শটে লক্ষ্যভেদ করেন টটেনহ্যাম হটস্পার ফরোয়ার্ড। আক্রমণের শুরু থেকে শেষটাও এতটা সুরেলাভাবে হয় যে তা ছুঁয়ে যায় গুরুগম্ভীর কোচ তিতেকেও। শিশুতোষ আনন্দে তিনিও যোগ দেন শিষ্যদের উদ্দাম নাচে।
৩৬তম মিনিটে দেখা মেলে ব্রাজিলের বিধ্বংসী রূপ। বাঁ দিক দিয়ে ক্ষিপ্র গতিতে বক্সে ঢুকে দারুণ চিপ শটে বল দূরের পোস্টে বাড়ান ভিনিসিউস আর ডান পায়ের নিখুঁত শটে গোলটি করেন পাকেতা। ৪-০ স্কোরলাইন নিয়ে ম্যাচ হেলে পড়ে ব্রাজিলের পায়ে। পরে তাই দক্ষিণ কোরিয়া এক গোল শোধ করলেও চিন্তার ভাঁজ পড়েনি তিতের কপালে।
এমন ম্যাচে মাঠে, গ্যালারিতে না থেকেও সবখানে থাকেন ফুটবলের আরেক শিল্পী পেলে। অসুস্থতা নিয়ে যিনি এখনও সাও পাওলোর হাসপাতালে। দক্ষিণ কোরিয়া ম্যাচের আগে উত্তরসূরিদের শুভকামনা জানিয়ে বার্তা পাঠিয়ে বলেছিলেন, টিভিতে দেখবেন ম্যাচটি। গ্যালারিতে থাকা সেলেসাও সমর্থকদের মতো হয়তো ম্যাচ শেষে বাঁধনহারা উচ্ছ্বাসে মেতেছেন তিনটি বিশ্বকাপ জয়ী এই কিংবদন্তিও। মরুর বুকে এই প্রথম যে উত্তরসূরিদের পায়ে দেখলেন সুরেলা ফুটবল, সাথে দাপুটে জয়ও।