উজ্জ্বল ভবিষ্যতের আশায় আলোকিত মরক্কো

কাতার বিশ্বকাপে দুর্দান্ত পারফরম্যান্স আফ্রিকার দেশটিকে পরের আসরে আরও বড় অর্জনের বিশ্বাস যোগাচ্ছে।

স্পোর্টস ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 16 Dec 2022, 12:21 PM
Updated : 16 Dec 2022, 12:21 PM

একের পর এক চমক দেখিয়ে, বিস্ময় জাগিয়ে মরক্কোর সেমি-ফাইনালে খেলা তাদের জন্য তো বটেই, পুরো আফ্রিকান ফুটবলের জন্যও বিশেষ কিছু। এর আগে যে এই মহাদেশের কোনো দেশই শেষ চারে খেলতে পারেনি। কাতার বিশ্বকাপে হাকিমি-জিয়াশদের দুর্দান্ত পারফরম্যান্সে দেশটি আগামীতে নিশ্চয় আরও বড় স্বপ্ন দেখবে।

দলের আলো-ঝলমলে পারফরম্যান্সে কোচ ওয়ালিদ রেগরাগি তো গ্রুপ পর্বের বৈতরণী পার হওয়ার পরপরই ছুড়ে দিয়েছিলেন আত্মবিশ্বাসী বার্তা। বলেছিলেন, “আমাদের কেন বিশ্বকাপ জয়ের স্বপ্ন দেখা উচিত নয়? স্বপ্নটাকে ভবিষ্যত প্রজন্মের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়া যাক এবং চলুন সবাই এতে বিশ্বাস রাখি।”

মরক্কোর খেলোয়াড় ও কোচের নিজেদের সামর্থ্যে অগাধ বিশ্বাস এবং তাদের সামগ্রিক ফুটবলের উন্নতিই ইঙ্গিত দিচ্ছে, সামনে হয়তো আরও দুর্দান্ত কিছুই অপেক্ষা করছে দেশটির জন্য।

বেলজিয়ামকে ছিটকে ও আগের আসরের রানার্সআপ ক্রোয়েশিয়াকে পেছনে ফেলে গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন হয়ে সবাইকে চমকে দিয়েছিল মরক্কো। শেষ ষোলোর টিকেট পাওয়ার পর

রেগরাগির ওই মন্তব্য অনেকের কাছেই হয়তো বাড়াবাড়ি ঠেকেছিল। 

কারণ, আরব কোনো দেশ তো এর আগে কোয়ার্টার-ফাইনালেই খেলতে পারেনি। টাইব্রেকারে সাবেক বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন স্পেনকে হারিয়ে তাই করে দেখায় মরক্কো।

এরপর ইউরো ২০১৬ চ্যাম্পিয়ন পর্তুগালকে ১-০ গোলে হারিয়ে নতুন ইতিহাস গড়ে মরক্কো। প্রথম আফ্রিকান দেশ হিসেবে জায়গা করে নেয় সেমি-ফাইনালে। রেগরাগির যে কথা শুরুতে কেউ সেভাবে আমলেই নেয়নি, তা বাস্তবে ধরা দেওয়া থেকে দলটি চলে আসে মাত্র দুই ম্যাচ দূরত্বে। 

সেমি-ফাইনালে বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন ফ্রান্সের বিপক্ষে ২-০ গোলের হারে অবশ্য শেষ হয়েছে তাদের রূপকথা। এখন দলটির সামনে সুযোগ আছে তৃতীয় হওয়ার। ক্রোয়েশিয়ার বিপক্ষে শনিবার তৃতীয় স্থান নির্ধারণী ম্যাচে খেলবে তারা।

এই ম্যাচের ফলাফল যাই হোক না কেন, এটি নিশ্চিত যে উন্নতির ধারা ধরে রাখতে পারলে ২০২৬ বিশ্বকাপে আরও শক্তিশালী ও শিরোপার দাবিদার হয়ে ওঠার দারুণ সম্ভাবনা আছে মরক্কোর।

আসরজুড়ে মরক্কোর ফুটবলারদের ফুটবল দক্ষতার পাশাপাশি প্রশংসিত হয়েছে তাদের মানসিক দৃঢ়তা। দলটির গড় বয়স মাত্র ২৬ বছর ২ মাস। অধিকাংশ গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড়দের বয়স ২৭-এর নিচে এবং আরও তরুণরা আছেন স্কোয়াডে। আরেকটি বিশ্বকাপ আসতে আসতে তারা আরও কার্যকর ও পরিণত হয়ে উঠবেন।

২০২৬ সালের যুক্তরাষ্ট্র-মেক্সিকো-কানাডা বিশ্বকাপের সময় মরক্কোর এই দলের প্রতিষ্ঠিত খেলোয়াড়দের মধ্যে কেবল ইয়াসিন বোনোর বয়সই ৩৪ ছাড়িয়ে যাবে। নায়েফ আগের্দ, সেলিম আমাল্লাহ, সোফিয়ান আমরাবাত, ইউসেফ এন-নেসিরি ও নুসে মাসাওয়িদের বয়স হবে ৩০ এর কাছাকাছি। দক্ষতা ও অভিজ্ঞতার মিশেলে ফুটবলারদের ক্যারিয়ারের সেরা সময় ধরা হয় এই সময়কে।

মরক্কোর আরেকটি শক্তির জায়গা হতে পারে তাদের খেলোয়াড়দের ইউরোপের শীর্ষ পাঁচটি লিগের বিভিন্ন ক্লাবগুলোতে খেলার অভিজ্ঞতা। ডিফেন্ডার আশরাফ হাকিমি খেলেন লিগ ওয়ান চ্যাম্পিয়ন পিএসজিতে, ফরোয়ার্ড হাকিম জিয়াশ আছেন চেলসিতে। এছাড়া আছেন বুন্ডেসলিগা জায়ান্ট বায়ার্ন মিউনিখের ডিফেন্ডার মাসাওয়ি এবং স্প্যানিশ ক্লাব সেভিয়াতে খেলা ফরোয়ার্ড এন-নেসিরি ও গোলরক্ষক বোনো। বিশ্বকাপে উজ্জ্বল পারফরম্যান্সের পর আমরাবাত, আজ্জেদিন উনাহি, আগের্দরা ডাক পেতে পারেন ইউরোপিয়ান শীর্ষ ক্লাবগুলোতে।

ইউরোপের ক্লাবে নিয়মিত খেলার সুবাদে মরক্কোর খেলোয়াড়রা কৌশলগত, শারীরিক ও মানসিকভাবে আরও শক্তিশালী হয়েছে। বিশ্বকাপে বড় দল বা শীর্ষ তারকাদের বিপক্ষে খেলার সময় যা সমানে সমান লড়ার আত্নবিশ্বাস জুগিয়েছে তাদের।

মরক্কোর এই হার না মানা মানসিকতাই তাদের অন্য দুই আরব দেশ সৌদি আরব ও কাতারের থেকে আলাদা করতে ভূমিকা রেখেছে। প্রতিপক্ষের নাম দেখে ঘাবড়ে না গিয়ে তাদের হারানোর বিশ্বাস নিয়ে খেলতে নামছে রেগরাগির দল।

কাতার বিশ্বকাপ শুরুর আগে থেকেই সবাই কথা বলছে দোহার ‘অ্যাসপায়ার অ্যাকাডেমি ফর স্পোর্টস এক্সেলেন্স’ এবং কাতারের ক্রীড়াক্ষেত্রে উন্নয়নের এর ভূমিকা নিয়ে। তবে অনেকে হয়তো জানে না, মরক্কোর ফুটবলের অবিশ্বাস্য উন্নতির পেছনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে দেশটির ‘ষষ্ঠ মোহাম্মদ ফুটবল একাডেমি’। ২০০৯ সালে প্রতিষ্ঠিত এই একাডেমি পুরো মরক্কো থেকে প্রতিভাবান খেলোয়াড়দের বের করে তাদের গড়ে তুলতে কাজ করে।

সব ধরনের আধুনিক প্রশিক্ষণের সুবিধাসম্পন্ন এই একাডেমি থেকে মরক্কোর কয়েকটি প্রজন্ম বেড়ে উঠেছে এবং তারা প্রতিভাবান তরুণ খেলোয়াড়দের ইউরোপিয়ান ক্লাবে খেলার সুযোগ করে দিচ্ছে। এখান থেকেই বের হয়েছেন মরক্কোর বিশ্বকাপ স্কোয়াডে থাকা উনাহি, আগের্দ ও এন-নেসিরি মতো খেলোয়াড়রা।

‘অ্যাটলাস লায়ন্স’ নামে পরিচিত মরক্কো কাতারে জানান দিয়েছে নিজেদের সামর্থ্যের। দলটি যদি পরিকল্পনা অনুযায়ী এগিয়ে যেতে পারে, তাহলে চার বছর পর বিশ্ব সেরার মঞ্চে এবারের চেয়েও দুর্দান্ত কিছু অর্জন করা অসম্ভব হবে না মরক্কোর জন্য।