কারো হাতে আর্জেন্টিনার পতাকা, কারো ব্রাজিলের। অনেকের হাতে বাংলাদেশের পতাকা। নিজেদের পতাকা হাতে দেখা গেল কিছু কাতারিকেও। তবে সব মিলিয়ে কাতারের রাজধানী দোহার সাত কিলোমিটার দূরের ফ্ল্যাগ প্লাজা সন্ধ্যায় যেন হয়ে উঠল এক টুকরো বাংলাদেশ! ধুসর মরুভূমিতে লাল-সবুজের পতাকা বুকে জড়িয়ে, দু-হাত উঁচিয়ে উড়িয়ে অনেকের কণ্ঠে উচ্ছ্বাস ঝরল-এই বিশ্বকাপ শুধু কাতারের নয়, আমাদেরও। মানে বাংলাদেশেরও!
বৈশ্বিক ফুটবলে পেছনের বেঞ্চের ছাত্র বাংলাদেশ। কিন্তু এই দরিদ্র জনপদের অনেকে জীবন-জীবিকার তাকিয়ে দেশ ছেড়ে পাড়ি জমিয়েছেন কাতারে। কাজ মূলত শ্রমিকের। কেউ কেউ অবশ্য পেশার পরিচয়ে বললেন ইঞ্জিনিয়ার। তবে পরিচয় যাই হোক, তারা সবাই বাংলাদেশি এবং কোনো না কোনভাবে বিশ্বকাপের স্টেডিয়াম, আবাসনখাত থেকে শুরু করে নানা কাজের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। সন্ধ্যেয় তাদের অনেকেই পরিবার-পরিজন নিয়ে হাজির ফ্ল্যাগ প্লাজার চত্বরে।
২০ নভেম্বর থেকে শুরু হতে যাওয়া কাতার বিশ্বকাপ উপলক্ষে এই চত্বরে সেজেছে ২১১টি পতাকায়। মূলত বৈশ্বিক ফুটবলের নিয়ন্তা সংস্থা ফিফার সদস্য দেশগুলোর পতাকা ঠাঁই পেয়েছে এখানে। কিন্তু এবারের আসরে অংশ নেওয়া ৩২টি দেশের সমর্থকদের যে খুঁজেই পাওয়া গেল না! আফ্রিকান দেশগুলোর কিছু ফুটবলপ্রেমীর দেখা মিলেছে বটে, কিন্তু তাদের অধিকাংশ কাতারে আছে চাকরির সুবাদে। অবশ্য বিমানবন্দরে আর্জেন্টাইন সমর্থকদের দেখা মিলেছে গুটিকয়েক। ব্রাজিল দল এখনও মধ্যপ্রাচ্যের দেশটিতে নোঙর না ফেলায় হয়ত তাদের সমর্থকদের দেখা মেলেনি। দোহার পথে-ঘাটে ফুটবলপাগলদের হা-রে-রে করে ছুটে বেড়াতে দেখতে না পারার বড় আরেকটি কারণ হতে পারে মরুদেশটির তাপমাত্রা।
প্রচণ্ড তাপের কারণে দোহার জীবনযাত্রা মূলত দুই ভাগের। সকাল থেকে দুপুর ৩টা পর্যন্ত রাজপথ, অলিগলি অন্যরকম, মানুষের দেখা নেই। কোলাহলহীন। গাড়ি-ঘোড়ার চলাচলও কম। ৩৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্র আর আর্দ্রতা কম হওয়ায় মরুর উত্তাপ গায়ে লাগে বড্ড বেশি। কাতারের বিশ্বকাপ আয়োজন নিয়ে ইউরোপের এবং শীতপ্রধান দেশগুলোর এত উদ্বেগের কারণের আচঁ পাওয়া হয়ে গেল সকালের দিকে বাইরে বের হতেই। তবে মরুভূমির দেশটির প্রথম বিশ্বকাপ আয়োজন নিয়ে প্রস্তুতির কমতি নেই একবিন্দু।
হাম্মাদ বিমানবন্দরের ভেতরে বিশ্বকাপের ঢাউস মাসকট ‘লাইব’ রাখা। আরবি এই শব্দের অর্থ ‘বিশেষ দক্ষতাসম্পন্ন খেলোয়াড়।’ বল পায়ে শিশুর অবয়বের সঙ্গে যেন অচেনা কোনো প্রাণীর কল্পিত মুখের ছবি সেখানে স্পষ্ট, গায়ে মধ্যপ্রাচ্যের ঐতিহ্যবাহী পোষাক জোব্বা-পাগড়ি মাথায়। দেয়ালে, পিলারে সাঁটানো ফুটবলের ছবি, সেখানে কেবল ছেলে-মেয়ে উভয়ের ছবি আছে। মধ্যপ্রাচ্যের রক্ষণশীল দেশ হলেও নারীদের প্রতি কাতারের দৃষ্টিভঙ্গির কিছুটা অন্যরকম ছাপও কি ফুটে উঠল সেখানে! ফিফা ওয়ার্ল্ড কাপ কাতার-লেখা ছোট-বড় সাইনবোর্ড, বিল্ডবোর্ডের ইয়াত্তা নেই।
দুপুরের পর তাপমাত্রা কমতে থাকে, একটু একটু করে ঘর ছেড়ে বাহির মুখে হয় মানুষ। শুক্রবার দলে দলে বেরিয়ে আসার কারণ একে তো ছুটির দিন, তার উপর বিশ্বকাপের আমেজ। বৈশ্বিক ফুটবলের সর্বোচ্চ আসরের সঙ্গে একাত্ম হওয়ার সুযোগ কে হেলায় হারাতে চায়? তাই সন্ধ্যার দিকে তাই ফ্ল্যাগ প্লাজার চত্বরে এমন লোকসমাগম।
রাস্তার পাশের শপিং মলের দেয়ালে শোভা পাচ্ছে বর্তমান চ্যাম্পিয়ন ফ্রান্সের গোলরক্ষক উগো লরিসের ছবি। অন্য পাশের দেয়ালে আর্জেন্টাইন মহাতারকা লিওনেল মেসির দুই হাত উচিঁয়ে গোল উদযাপনের চেনা দৃশ্য ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। ফ্ল্যাগ প্লাজায় যাওয়ার পথে দেখা মিলেছে নেইমারের ছবি, ষষ্ঠ শিরোপা জয়ের আকাঙ্খা নিয়ে এই ফরোয়ার্ডের কাঁধে সওয়ার ব্রাজিল। চত্বরের কলরব, শ্লোগান মূলত মেসি-নেইমারকে নিয়ে, দেশের হিসেবে সেটি চারটি-আর্জেন্টিনা, ব্রাজিল, কাতার এবং বাংলাদেশ।
নিজ দেশের স্লোগান দিতে খুব কম কাতারিকে দেখা গেল চত্বরে, বরং তাদের হয়ে গলা ফাটাতে দেখা গেল বাংলাদেশিদের। ‘ব্রাজিল-ব্রাজিল’ কিংবা ‘আর্জেন্টিনা-আর্জেন্টিনা’ শ্লোগানে পুরো এলাকাটি মুখরিত করে রাখল যথারীতি বাংলাদেশিরা। কেবল প্রিয় দল, কিংবা প্রিয় দেশের কথা বলতে নয়, বছরের পর বছর হাড়ভাঙা খাটুনির তৃপ্তি বিশ্বকাপের সঙ্গে একাত্ম হওয়ার যেন খুঁজে নিতে চাইলেন এখানে অনেকে। জসিম নামের একজন নিজেকে প্রকৌশলী পরিচয় দিয়ে বেশ গর্ব নিয়ে বললেন, “আমি আল জনোব স্টেডিয়ামের পার্কিংয়ের কাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলাম।”
মানবাধিকারের লংঘন ও অভিবাসী শ্রমিকদের প্রতি কাতারের সরকারের কঠোর মনোভাব প্রশ্নের শেষ নেই। কিন্তু মেহেদী নামের এক বাংলাদেশি এ অভিযোগকে পাত্তা দিতে চাইলেন না খুব একটা! তবে তিনিও স্বীকার করে নিলেন কিছু শ্রমিককে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে দোহা থেকে, “এখানেই দেখা যাচ্ছে, এই চত্বরে যারা এসেছে, তাদের অধিকাংশ বাংলাদেশি। দোহার মূল শহর থেকে কিছু মানুষকে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে, কিন্তু সেটা সবাইকে নয়, অল্প কিছু সংখ্যক।”
চাঁদপুরের সাইফুল ইসলাম ও কুমিল্লার আব্দুল ওয়াদুদ-দুজনে দীর্ঘদিন ধরে আছেন কাতারে। আর্জেন্টিনার জার্সি গায়ে চাপিয়ে এসেছেন দুজনে। কর্মক্লান্ত সপ্তাহ শেষে ছুটির দিনে বাংলাদেশিদের এই চত্বরে আগমণের কারণ হিসেবে অন্যরকম যুক্তি দিলেন দুজনে, “এই বিশ্বকাপ শুধু কাতারের নয়, আমাদেরও। এই বিশ্বকাপের অনেক কাজই হয়েছে আমাদের হাত দিয়ে, বাংলাদেশের মানুষের হাত দিয়ে।”