দারুণ এক গোলে ব্রাজিলকে এগিয়ে নিলেও শেষ পর্যন্ত চোখের জলেই বিদায় নিতে হলো নেইমারকে।
Published : 10 Dec 2022, 12:17 AM
স্রেফ মিনিট বিশেকের ব্যবধান, শুরুতে উল্লাস এবং এরপর হারের বিষাদে নীল হয়ে যাওয়া! দুর্দান্ত এক গোল করেও নায়ক হয়ে ওঠা হলো না নেইমারের। এডুকেশন সিটি স্টেডিয়ামের মাঠ থেকে পা দুটো যেন নড়তে চায় না। অবশ, নিথর ! আরও একবার অশ্রুসিক্ত চোখে, স্বপ্ন চূর্ণ হওয়ার এক বুক কষ্ট নিয়ে মাঠ ছাড়লেন তিনি। ব্রাজিলের হয়ে পেলের সর্বোচ্চ গোলের রেকর্ড ছোঁয়ার বিকেলটি তাই নেইমারের জন্য আবীর রাঙা হলো না; বরং নিকষ কালো আঁধারে ডুবতে হলো তাকে।
আল রাইয়ানের এডুকেশন সিটি স্টেডিয়ামে শুক্রবার কাতার বিশ্বকাপের প্রথম কোয়ার্টার-ফাইনালে মুখোমুখি হয় ব্রাজিল ও ক্রোয়েশিয়া। গতবারের রানার্সআপদের বিপক্ষে রেকর্ড পাঁচবারের চ্যাম্পিয়ন ব্রাজিলের পাল্লা ছিল ভারি। কিন্তু শুরু থেকে সেলেসাওদের চোখে চোখ রেখে অবিশ্বাস্য আত্মবিশ্বাস নিয়ে লড়ে যাওয়া ক্রোয়াটরাই হাসল বিজয়ের হাসি।
গ্রুপ পর্বে গোলের দেখা না পাওয়া নেইমার শেষ ষোলোয় দক্ষিণ কোরিয়ার বিপক্ষে ৪-১ ব্যবধানে জেতা ম্যাচে একবার পেয়েছিলেন জালের দেখা। ক্রোয়াট ম্যাচের অতিরিক্ত সময়ের প্রথম অর্ধের যোগ করা সময়ে ঘোচালেন দলের গোলের হাহাকার। কিন্তু টাইব্রেকারে ব্রাজিল ৪-২ গোলে হেরে যাওয়ায় তিনিও শেষ পর্যন্ত অসীম শূন্যতায় ভেসে যাওয়া, কাতার বিশ্বকাপ থেকে ঝরে যাওয়া তারাদের দলে।
অথচ কী দারুণ গোলেই না রেকর্ডের একটি পাতায় গ্রেট পেলেকে ছুঁয়ে ফেলেন নেইমার। লুকাস পাকেতার সঙ্গে ওয়ান টু ওয়ান খেলে বক্সে ঢুকে পড়েন। বোর্না সোসার ধাক্কায় একটু ভারসাম্য হারালেও থমকে যাননি। পাহাড় সমান দৃঢ়তায় পোস্ট আগলে রাখা গোলরক্ষককে দমিনিক লিভাকভিচকে কাটান ঠাণ্ডা মাথায় এবং এরপর একটু দূরূহ কোণ থেকে নিখুঁত শটে জাল খুঁজে নিয়ে উড়াল দেন আকাশে। মুষ্টিবদ্ধ হাতে, চোখ-মুখের অভিব্যক্তিতে, উদযাপনের ভঙ্গিতে যেন বোঝাতে চান, এ কারণেই তিনি নেইমার, পেলের উত্তরসুরি, ব্রাজিলের ত্রাতা। এ গোলে ব্রাজিলের হয়ে সর্বোচ্চ গোলদাতার তালিকায় পেলেকে (৭৭টি) স্পর্শ করেন নেইমার।
ক্রোয়েশিয়া ম্যাচের শুরুতে অবশ্য আক্রমণে ভয়ঙ্কর ছিলেন না নেইমার। একাদশ মিনিটে প্রথম আক্রমণ শাণাতে গিয়ে অফসাইডের ফাঁদে পা দেন তিনি। ২২তম মিনিটে ফ্রি কিকে তার শট সোজা জমে যায় গোলরক্ষকের গ্লাভসে। ২০ মিনিট পরের ফ্রি কিকের পরিণতিও একই।
প্রথমার্ধে নেইমার ঠিক যেন নেইমার হয়ে ওঠতে পারেননি। দক্ষিণ কোরিয়া ম্যাচের মতো আলো ঝলমলে ছিলেন না। তাতে গোলের জন্য অপেক্ষা বাড়ে ব্রাজিলের। চিন্তার বলিরেখা ফুটে ওঠে তিতের কপালে। যেখানে দক্ষিণ কোরিয়া ম্যাচে প্রথমার্ধেই মিলেছিল চার গোল, ক্রোয়েশিয়ার জালে গোল তো দূর অস্ত, গোলরক্ষকের যে তেমন কোনো পরীক্ষা নিতে পারেননি নেইমাররা!
ভালো একটি সুযোগ নেইমারের দরজায় কড়া নাড়ে ৫৫তম মিনিটে। কিন্তু ৩০ বছর বয়সী এই ফরোয়ার্ডের শট কোনো মতে পা দিয়ে আটকান গোলরক্ষক। ৭৬তম মিনিটে পিএসজির ফরোয়ার্ডকে আবারও হতাশ হতে হয়। এবার রিশার্লিসনের বাড়ানো পাস ধরে নেইমারে চেষ্টা করেছিলেন লিভাকভিচে পায়ের ফাঁক দিয়ে বল জালে জড়াতে। দারুণ দৃঢ়তায় হাঁটু দিয়ে আটকান গোলরক্ষক।
এরপর সতীর্থদের একটা-দুটো সুযোগ নেইমার তৈরি করে দিয়েছিলেন বটে, কিন্তু ক্রোয়াটদের কড়া পাহারায় সেভাবে আক্রমণে ওঠা হয়নি তার। ম্যাচ গড়ায় অতিরিক্ত সময়ে। একটি গোলের জন্য সেলেসাও সমর্থকদের প্রাণ ততক্ষণে ওষ্ঠাগত, অঘটনে ভরা কাতার বিশ্বকাপে শঙ্কার কালো মেঘ যেন উঁকি দেয় ব্রাজিলের আকাশে। কোচ তিতের অস্থিরতা ফুটে ওঠে বিক্ষিপ্ত পায়চারিতে।
অবশেষে অতিরিক্ত সময়ের প্রথম অর্ধের যোগ করা সময়ে মরুভূমির বুকে ব্রাজিলের জন্য এক পশলা স্বস্তির বৃষ্টি হয়ে আসেন নেইমারই। আক্রমণের সুর বেজে ওঠে মাঝমাঠ থেকে। এরপর বল আসে নেইমারের পায়ে। পাকেতাকে বাড়িয়ে এক ছুটে ঢুকে যান বক্সে। তাকে আটকাতে কড়া চার্জই করেছিলেন সোসা। কিন্তু সাম্বার নৃত্যের ছন্দে ধাক্কা খাওয়া শরীরটাকে একটু বাঁকিয়ে নিয়ে বেরিয়ে যান তিনি। গোলরক্ষককে কাটান শান্ত থেকে। এরপর নিখুঁত শটে খুঁজে নেন জাল। ১-০ গোলে এগিয়ে যাওয়ার উচ্ছ্বাসে ফেটে কেঁপে ওঠে এডুকেশন সিটি স্টেডিয়ামের গ্যালারি। তিতের বুক থেকে জমাট পাথরটা যেন সরে যায়।
চিত্রনাট্য এখানে শেষ হলে নায়ক হতে পারতেন নেইমার। কিন্তু ১১৭তম মিনিটে ব্রুনো পেতকোভিচের শট মার্কিনিয়োসের হাঁটুতে লেগে কিছুটা দিক পাল্টে জালে জড়ালে শুরু হয় নেইমারের ‘ট্র্যাজিক হিরো’ হওয়ার পর্ব। পোস্টে এটাই ছিল ক্রোয়েশিয়ার প্রথম শট, ঝাঁপিয়ে পড়লেও তা আটকাতে পারেননি আলিসন। ম্যাচের ভাগ্য গড়ায় টাইব্রেকারে।
এদিন যেন নেইমার নয়, নায়ক হওয়ার কথা ছিল লিভাকভিচের। তিনি হলেনও। ম্যাচ জুড়ে নেইমার, রিশার্লিসনদের হতাশ করেছেন একাধিকবার। টাইব্রেকারেও দিনামো জাগরেবের এই গোলরক্ষক শুরু করেন নিজের বাঁ দিকে ঝাঁপিয়ে রদ্রিগোর শট ঠেকিয়ে। কাসেমিরোর শটে বলের লাইনে থাকলেও গতির সঙ্গে পেরে ওঠেননি। পেদ্রোর শটে পরাস্ত তিনি।
কিন্তু ততক্ষণে নিকোলা ভ্লাসিচ, লভরো মাইয়ের, লুকা মদ্রিচ মদ্রিচ ও মিসলাভ অরসিচ টানা চার শটে লক্ষ্যভেদ করে ফেলেছেন। ক্রোয়েশিয়ার নৌকাটিও তরতর করে জয়ের বন্দরের দিকে ছুটছে। গ্যালারি আসা ক্রোয়াট সমর্থকরাও পেতে শুরু করেছেন প্রথমবারের মতো ব্রাজিলের বিপক্ষে জয়ের ঘ্রাণ।
ব্রাজিলের চতুর্থ শট নিতে এলেন মার্কিনিয়োস। যেন প্রার্থনায় ডুব দেন নেইমার, বিড়বিড় করে কিছু বলতে থাকেন। কিন্তু মার্কিনিয়োসের শটের নাগাল লিভাকভিচ না পেলেও তা ফিরে আসে পোস্ট কাঁপিয়ে। তাতে চূড়ান্তভাবে কেঁপে উঠে হুড়মুড়িয়ে ভেঙে পড়ে ব্রাজিলের ২০০২ সালের পর আরেকটি শিরোপা জয়ের স্বপ্ন। দুহাতে মুখ চেপে নেইমার ডুকরে কেঁদে ওঠেন। সতীর্থদেরকে সান্ত্বনা দেন, নিজেও সান্ত্বনা খুঁজতে থাকেন।
গোলের দিক থেকে পেলের পাশে বসা থেকে হয়তো সান্ত্বনা পেতে পারেন তিনি। কিন্তু অর্জনের খাতায় যে ফুটবল কিংবদন্তি যোজন যোজন এগিয়ে। সেই ব্যবধান ঘুচানোর আরেকটি সুযোগ হাতছাড়া হয়ে যাওয়ার দুঃখ কি এতো সহজে ভোলা যাবে?