মা দিবসের গল্প
মীরার এই মা’টা অন্যসব বন্ধুদের মায়ের মতো আধুনিক নন। তিনি গুছিয়ে শাড়ি পরেন না, টিপ দেন না, সানগ্লাস বা হাইহিল পরেন না।
Published : 11 May 2024, 11:40 PM
টিফিন পিরিয়ডে মীরা খাবারের বাটিটা খুলল। আবিদা বলল, ‘কী এনেছিস আজ?’ পাশ থেকে লিজা বলল, ‘ও পরোটা বা নুডলস ছাড়া আর কী আনবে!’ মীরা বলল, ‘মা পরোটা দিয়েছে আজও।’
লিজার কথায় মনটা একটু কেমন করে উঠল মীরার। আসলেই তো, সেই কিন্ডারগার্টেন থেকে ক্লাস ফাইভ পর্যন্ত সে কেবল দুই ধরনের খাবারই টিফিনে এনেছে। হয় পরোটা, আলুভাজি আর ডিম; নয়তো নুডলস। মা আর কখনোই অন্য কোনো খাবার টিফিনবক্সে দেয়নি।
কেন দেয়নি? সবাই কী সুন্দর কেক, খিচুড়ি, ফল, মিষ্টি, স্যান্ডউইচ আরও কত কী নিয়ে আসে একেকদিন! অবশ্য মীরারও এর আগে টিফিন নিয়ে কখনও কিছু মনে হয়নি। মা যা দিয়েছে, তাই খেয়ে নিয়েছে সে। আজ লিজার কথায় সে কেমন যেন একটু লজ্জা পেল, কষ্টও পেল। লুডুর ছক্কার মতো চারকোনা ওই একই টিফিনবক্সে, ওই একই টিফিন রোজ দেয় কেন মা?
বারবার একই কথা মনে হতে লাগল মীরার। স্কুল ভ্যানে করে বাড়ি ফেরার সময়ও ওর মনে হলো, একটা মিকি-মাউসওয়ালা টিফিন কিনে দিতে পারে না মা? লুডুর ছক্কার মতো সবুজ রঙের প্লাস্টিকের টিফিনবক্সটা বের করতেও লজ্জা লাগে মাঝে মাঝে ওর। সবাই কী সুন্দর কার্টুনআঁকা রঙিন টিফিনবক্স নিয়ে আসে!
বাড়ি ফিরে গোসল করে খেতে বসল মীরা। মা খাবার বেড়ে দিচ্ছে। মীরা তাকিয়ে আছে মায়ের দিকে। মায়ের কপালে বয়সের ছাপ। কপালঘেঁষে রুপালি চুল গজিয়েছে অনেকগুলো। কালো কলপের আস্তর ছেড়ে আরও অনেকগুলো সাদা কি রুপালি চুল বেরিয়ে আসছে। মীরার মা যেন স্কুলের অন্যান্য বন্ধুদের মায়েদের মতো নয়। একটু বয়সে বড়, একটু বেশিই বড়।
মীরার মা ওকে স্কুলে আনতে যান না অন্য মায়েদের মতো। হাইহিল, রোদচশমা কোনোটিই পরেন না। মীরার মা কখনোই বাইরে গেলে হাতে ভ্যানিটি ব্যাগ নেন না। স্কুলে অন্য বন্ধুদের মায়েরা যেমন টিচারদের সঙ্গে নানা বিষয়ে কথা বলতে যান, মীরার মা তো কখনোই যাননি।
এমনকি সন্ধ্যার পর অন্য সবার মায়ের মতো তিনি মীরাকে পড়তেও বসান না। মাগরিবের আজান দিলে খালি বলেন, ‘মীরা পড়তে বসো!’ ছুটির দিন সকালে বলেন, ‘মীরা বাবার কাছে অঙ্ক করো।’ মা এমন কেন? বারবার মীরার এই কথাই মনে হয়- ‘এই মা’টা কেন অন্য অন্য সবার মায়ের মতো না?’
মীরার পাতে ছোট এক টুকরা ইলিশ মাছ আর তার ওপর ঝোল ছড়িয়ে দিয়ে মা বললেন, ‘খাওয়া শুরু করো।’ মাছের সাইজ দেখেই মীরার চোখ দিয়ে পানি বেরিয়ে এলো। মা এত ছোট একটা টুকরা দিল..! ওদিকে বড় এক পিস মাছের টুকরা তুলে রেখেছেন তিনি বাটিতে; মীরার বড় ভাইয়ের জন্য। ‘মা কী আমাকে ভালোই বাসে না? আর তাই বলে রোজ একই টিফিন দেয়, মাছের ছোট টুকরা দেয় আমাকে?’ মনে মনে তাই ভাবতে লাগল মীরা। চুপচাপ খেয়ে বিছানায় গেল ভাতঘুমের জন্য। ঘুম আসার আগ পর্যন্ত কোলবালিশে মুখ গুঁজে কাঁদল সে।
ঘুম ভাঙল রাত আটটায়। অনেক দেরি হয়ে গেছে, পরদিন ছুটি বলে মা-ও আর ডেকে তোলেনি। উঠেই দেখে উঠোনে তার বড় ভাই কাগজ দিয়ে একটা ছোট্ট শহীদ মিনার বানিয়েছে, মীরার জন্যই। আগামীকাল একুশে ফেব্রুয়ারি। ‘বাবু, সকালে তুই এই শহীদ মিনারে ফুল দিস কেমন? তোর জন্য বানিয়েছি।’- বলল মীরার বড় ভাই মিঠু।
মীরার মনটা ভালো হয়ে গেল। সে বলল, ‘আর ফুল কোথায় পাব?’ ‘ভোরে পেয়ে যাবি, তুলে দেব আশপাশ থেকে।’ -বলল মিঠু।
পরদিন খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠল মীরা। হাতমুখ ধোয়ার সময় দেখল, মা রুটি বানাচ্ছে। এই দৃশ্য রোজকার। ঘুম থেকে ওঠার পর মা ‘শুভ সকাল’-ও বলে না, হাসিও দেয় না একটিবার। মা এমন কেন?
হাতমুখ ধুয়ে উঠোনের কোণে রাখা শহীদ মিনারের কাছে গেল মীরা। মিঠু ঠিকই শিউলি, জবা, অলকানন্দা জোগাড় করে এনে রেখেছে মীরার জন্য। মীরা শিউলি ফুল দিয়ে মালা গাঁথলো। জবা ফুলের পাতা দিয়েও একটা মালা বানালো। মনে মনে ঠিক করে রাখল, কোন ফুল বা কোন মালাটা দিয়ে কে শহীদ মিনারে শ্রদ্ধাঞ্জলি দেবে।
অলকানন্দা ফুলগুলো সবচেয়ে তাজা ছিল, ঠিক করল সেটা ভাইয়ের জন্য রাখবে। শিউলির মালাটা দিয়ে বাবা শ্রদ্ধাঞ্জলি জানাবে। এমন সময় মা উঠোনে এলো আচারের বয়াম রোদে দেওয়ার জন্য। ‘মা তুমি শহীদ মিনারে একটা ফুল দিয়ে যাও।’- বলল মীরা। ‘দাও তাড়াতাড়ি দাও, চুলায় ভাজি পুইড়া যাইতেছে।’- বলল মা।
মীরা জবাফুলের ভেতর থেকে রেণুটা ছিঁড়ে মাকে দিলো। ‘নাও, এটা দাও।’ মা রেণুটা হাতে নিয়ে বলল, ‘আ এডু? আরেট্টু কিছু দাও।’ মীরা জবাফুলের পাতা দিয়ে বানানো মালাটা মাকে দিলো, ‘নাও এটা নাও। এটাও তো মালা।’
মা চুপচাপ জবাফুলের পাতার মালাটা দিয়েই কাগজের শহীদ মিনারে শ্রদ্ধা নিবেদন করল। তারপর রান্নাঘরে চলে গেল। কিন্তু মা চলে যাওয়ার পরের মুহূর্ত থেকে মীরার আর কিছু্ই ভালো লাগল না। কেন মাকে সে একটা ভালো ফুল দিল না? ফুল থেকে রেণু ছিঁড়ে কেন দিল? পাতার মালাটা কেন মায়ের হাতে তুলে দিল সে? এই অপরাধবোধে ভুগতে লাগল মীরা।
প্রতি বছর একুশে ফেব্রুয়ারি এলে এই জবাফুলের রেণু আর জবাপাতার মালা মায়ের হাতে তুলে দেওয়ার দৃশ্যটা বারবার মনে পড়ে মীরার। মনে পড়ে, জবাফুলের ভেতর থেকে রেণুটা ছিঁড়ে মাকে দেওয়ার পর, তার মুখ থেকে বেরিয়ে আসা সরল বাক্যটার কথা, ‘আ এডু? আরেট্টু কিছু দাও।’ আহা, কী মন খারাপই না হয়েছিল মায়ের?
মীরার এই মা’টা অন্য সব বন্ধুদের মায়ের মতো আধুনিক নন। তিনি গুছিয়ে শাড়ি পরেন না, টিপ দেন না, সানগ্লাস বা হাইহিল পরেন না। মীরার স্কুলে গিয়ে টিচারদের সঙ্গে চোখে চোখ রেখে কথা বলতে ভয় পান। না বুঝে মেয়েকে ছোট আর ছেলেকে মাছের বড় টুকরা দেন; মীরাকে রোজ একই টিফিন বানিয়ে দেন।
কিন্তু তবুও, মীরার এখন মনে হয়- এই মা’টা তো আমাদের সবই দিয়ে দেন, নিজের পাতে মাছের লেজটাই নেন বারবার। হয়ত কখনও পাতে কানসা বা লেজ পাওয়ার পর মাছের বড় টুকরা খেতে ইচ্ছে হলেও কাউকে বলতে পারেননি, ‘আ এডু? আরেট্টু কিছু দাও।’