ক্যাম্পের কঠিন জীবন আর অনেক ত্যাগে ভারতের বিপক্ষে জয়ের গল্প লেখা হয়েছে, বললেন সাবিনা খাতুন-মনিকা চাকমারা।
Published : 14 Sep 2022, 07:20 PM
‘আমার মনে হয় ছোটন স্যার এই দিনের অপেক্ষায় ছিলেন’, ভারতের বিপক্ষে জয় নিয়ে বললেন সাবিনা খাতুন। তবে কেবল বাংলাদেশ কোচ নন, এই মাহেন্দ্রক্ষণের জন্য প্রতীক্ষা ছিল সাবিনা-কৃষ্ণা-স্বপ্নাদেরও। অনেক অপেক্ষার প্রহর পেরিয়ে, অনেক ত্যাগের সিঁড়ি মাড়িয়ে এসেছে বহুকাঙ্খিত জয়টি। ঐতিহাসিক এই জয়ের পেছনের গল্প সাবিনা-কৃষ্ণারা যখন শোনাতে শুরু করলেন, তাদের চোখে মুখে তখন বিষন্নতা আর তৃপ্তির ছাপের লুকোচুরি খেলা।
নেপালের কাঠমান্ডুর দশরথ স্টেডিয়ামে সাফ চ্যাম্পিয়নশিপের ম্যাচে মঙ্গলবার ভারতকে ৩-০ গোলে হারায় বাংলাদেশ। পাঁচবারের চ্যাম্পিয়নদের বিপক্ষে ৯ হার ও এক ড্রয়ের পর মেলে প্রথম জয়ের অনির্বচনীয় স্বাদ। ম্যাচের পর কোচ ছোটনও শিষ্যদের ‘স্যালুট’ জানিয়ে বলেছিলেন অনেক ত্যাগের ফল এই জয়।
ভুটানের বিপক্ষে সেমি-ফাইনাল সামনে রেখে দশরথের পাশেই আর্মি হেডকোয়াটার মাঠে বুধবার অনুশীলন সারে বাংলাদেশ। শক্তিশালী ভারতকে গুঁড়িয়ে দেওয়ার আড়ালের গল্পটা প্রস্তুতির ফাঁকে শোনালেন মনিকা-মারিয়ারা। যেখানে বিষাদের উপস্থিতিও বেশ!
২০১৬ সাল থেকে বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের চতুর্থ তলায় শুরু হয় মেয়েদের ক্যাম্প। সেই থেকে বাবা-মা, ভাই-বোন, পরিবার-পরিজন ছেড়ে ক্যাম্পে থাকছেন মেয়েরা। খাওয়া-দাওয়া এখানে। প্রস্তুতিও চলে বাফুফে ভবনের পাশের টার্ফে কিংবা কমলাপুর স্টেডিয়ামে। ঈদ কিংবা পূজা-পার্বনের সময় কালে-ভদ্রে মেলে বাড়িতে যাওয়ার সুযোগ। বাংলাদেশের ম্যাচ থাকলে সে সুযোগও জোটে না। এই ক্যাম্পই তাদের ঘর-বাড়ি সবকিছু। এই সতীর্থরাই বোন-বন্ধু।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের সঙ্গে আলাপচারিতায় প্রিয়জনদের ছেড়ে মাসের পর মাস, বছরের পর বছর থাকার কষ্ট লুকাননি শিউলি-স্বপ্নারা। ভারতের বিপক্ষে পাওয়া জয়টি তারা দেখছেন অনেক কষ্ট-ত্যাগের বিনিময়ে পাওয়া ফল হিসেবে।
শিরোপাধারীদের জালে জোড়া গোল করা সিরাত জাহান স্বপ্না যেমন বললেন, প্রায় ছয় বছর একসঙ্গে থাকায় কী লাভ হয়েছে তাদের।
“একটা ভালো কিছু পেতে হলে তো আপনাকে অবশ্যই কিছু না কিছু ত্যাগ স্বীকার করতেই হবে। যখন আপনি ত্যাগ স্বীকার করবেন, তখনই কিছু পাবেন। পরিবার ছেড়ে বাফুফের ক্যাম্পে আমরা মাসের পর মাস থাকি, কঠোর পরিশ্রম করি। তারই সুফল ভারতের বিপক্ষে জয়, সামনের দিনগুলোতেও আশা করি এর ধারাবাহিকতা থাকবে।”
“আমরা যেহেতু মাসের পর মাস একসাথে থাকি, আমাদের মধ্যে বোঝাপড়াটাও অনেক বেশি। মাঠেও আমরা বুঝি একজন কী চাচ্ছে বা কোথায় বল দিলে সে পাবে। আমাদের ভেতরে এই বন্ডিংটা খুব ভালো।”
খাগড়াছড়ির পাহাড়ি মনোরম পরিবেশ, বাবা-মা ছেড়ে ঢাকায় থাকাটা সহজ ছিল না মনিকা চাকমার। কিন্তু কোচ ছোটন, সহকারী কোচ মাহবুবুর রহমান লিটু বুঝতে দেননি বাবা-মায়ের অভাব। আদরে-যত্নে-শাসনে আগলে রেখেছেন। ১৮ বছর বয়সী এই মিডফিল্ডারের কণ্ঠেও ঝরল কোচদের প্রতি কৃতজ্ঞতা।
“যেহেতু আমরা ২০১৬ সাল থেকে একসঙ্গে ক্যাম্পে আছি, ছয়-সাত বছরের মতো হয়ে গেছে। দীর্ঘদিন একসঙ্গে থাকার কারণেই আমাদের মধ্যে বনিবনা ভালো। কিভাবে পাস দিলে কী হবে, কাকে কখন দিতে হবে, সেটা আমরা খুব ভালোভাবে বুঝি। ২০১৯ সালের চেয়ে এখন এই বোঝাপড়া আরও বেশি ভালো হয়েছে। এ কারণেই ভারতকে হারাতে পেরেছি।”
“বাবা-মা, ভাই-বোনদের ছেড়ে থাকা কষ্টের। কিন্তু ক্যাম্পে কোচেরাই আমাদের কাছে বাবা-মায়ের মতো, পরিবারের মতো। তারা যেভাবে আমাদের দায়িত্ব নিয়েছেন, বলা যায় উনারাই আমাদের বাবা-মা।”
ডিফেন্ডার শিউলি আজিম বললেন, “একসাথে অনুশীলন করতে করতে আমাদের মধ্যে একটা বোঝাপড়া হয়ে গেছে।” কৃষ্ণাও একই কথা বলতে গিয়ে টানলেন প্রচলিত প্রবাদ-কিছু পেতে হলে কিছু হারাতে হয়।
“আমরা অনেক ছোট বয়স থেকে পরিবার ছেড়ে এই ক্যাম্পে থাকি। কোচেরাই আমাদের পরিবারের মতো যত্ন নেয়। সবাই আমাদের সাথে থাকে, পাশে থাকে। কিছু পেতে হলে তো কিছু ছাড়তে হয়-এটা আমি মানি। মানি বলেই হয়ত ভারতের বিপক্ষে এত বড় একটা জয় গতকাল আমরা পেয়েছি।”
এই দলে বয়সে সবার চেয়ে বড় সাবিনা খাতুন। তিনি দলের অধিনায়কও। সাতক্ষীরার গ্রামীণ পরিবেশ ছেড়ে ইট-পাথরের ঢাকা শহরে মনিকা-শিউদের আগলে রাখার কাজটি করতে হয় তাকেও। ভারতকে হারাতে পেরে ২৮ বঠর বয়সী এই তারকা স্ট্রাইকারও অনুভব করছেন ‘ছোটন স্যারকে’ কিছু ফিরিয়ে দেওয়ার তৃপ্তি।
“এমনও হয় ছয়-সাত মাস, কখনও ১০ মাস এই মেয়েরা বাড়িতে যেতে পারে না, ক্যাম্পেই পড়ে থাকে। পরিশ্রম করে। পরিশ্রমের মূল্য কোনো না কোনোভাবে তো পেতেই হবে, সেটা ভারতের বিপক্ষে পেয়েছি। তাছাড়া আমার মনে হয়, বিশেষ করে ছোটন স্যার এই দিনের অপেক্ষাতেই ছিলেন। উনার ১২ বছরের পরিশ্রম গতকাল সফল হয়েছে এবং আমার ও দলের কাছে এটা বড় একটা পাওয়া।”
আগামী শুক্রবার প্রথম সেমি-ফাইনালে ভুটানের মুখোমুখি হবে বাংলাদেশ। অনেক ত্যাগের ফলে পাওয়া জয়ের রেশ অধিনায়ক টেনে নিতে চান আগামী দিনগুলোতেও।
“দল নিয়ে আমি খুশি। মেয়েরা তাদের সর্বোচ্চটাই দিচ্ছে। খেলায় হার-জিত আছে, সেমি-ফাইনাল বা ফাইনালে কী হবে জানি না। কিন্তু আমাদের লক্ষ্য ছিল ভারতকে হারাব, শেষ পর্যন্ত সেটা আমরা করেছি। বাকিটা সৃষ্টিকর্তার ইচ্ছা, আমরা ম্যাচ বাই ম্যাচ পরিকল্পনা করে এগিয়ে যাব।”