কুয়েতের বিপক্ষে গোল করতে চান রাকিব হোসেন, সঙ্গে দলকে নিয়ে যেতে চান সাফের ফাইনালে।
Published : 30 Jun 2023, 02:28 PM
মালদ্বীপের রক্ষণ ভেঙেছেন। গুঁড়িয়েছেন ভুটানের প্রতিরোধের দেয়াল। কিন্তু এবার রাকিব হোসেনের সামনে কুয়েতের রক্ষণে চিড় ধরানোর মহাকঠিন চ্যালেঞ্জ। তিনি নিজেও অনুভব করছেন কাজটা সহজ নয়। তবে নকআউট পর্বের ম্যাচ বলে নিজেদের সামর্থ্যে আস্থা রাখছেন রাকিব। কুয়েতের বিপক্ষে বড় প্রাপ্তির স্বপ্নের জাল এই ফরোয়ার্ড বুনছেন আত্মবিশ্বাসের সুতো দিয়ে।
অথচ একটা সময় শঙ্কার কালো মেঘের ঘনঘটা ছিল রাকিবের খেলা নিয়েই! হ্যামস্ট্রিংয়ের চোট সঙ্গী করে বঙ্গবন্ধু সাফ চ্যাম্পিয়নশিপের বাংলাদেশ দলে যোগ দিয়েছিলেন। কম্বোডিয়ার বিপক্ষে প্রীতি ম্যাচ খেলেননি। শতভাগ ফিট ছিলেন না বলে সাফে লেবাননের বিপক্ষে প্রথম ম্যাচে ছিলেন না শুরুর একাদশে। বদলি নেমে সেই ম্যাচে করতে পারেননি তেমন কিছু। তাকে চেনা গতিময় রূপে প্রথম দেখা যায় মালদ্বীপ ম্যাচে, এরপর আলো ছড়ান ভুটানের বিপক্ষেও। টানা দুই ম্যাচে গোল পাওয়ার ধারা এবার তিনি ধরে রাখতে চান কুয়েতের বিপক্ষেও।
সাফের সেমি-ফাইনালে শনিবার বেঙ্গালুরুর কান্তিরাভা স্টেডিয়ামে কুয়েতের বিপক্ষে খেলবে বাংলাদেশ। বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে রাকিব জানালেন, ২০০৯ সালের পর প্রথমবারের মতো সেরা চারের মঞ্চে উঠে আসায় দল এখন দারুণ আত্মবিশ্বাসী। নিজের উঠে আসা, সংশয়ের স্রোত পেরিয়ে সাফে আলো ছড়ানো, কুয়েত ম্যাচের ব্যক্তিগত লক্ষ্য নিয়ে বললেন অনেক কথাই।
চোট পেরিয়ে আলোয় ফেরা
চোট নিয়ে এলেও রাকিবকে নিয়ে আত্মবিশ্বাসী ছিলেন কোচ, সতীর্থরা। কিন্তু ২৪ বছর বয়সী ফরোয়ার্ড নিজেই ছিলেন ভয়ে। লেবাননের বিপক্ষে বদলি নামার পর ছিলেন অনুজ্জ্বল। ম্যাচের যোগ করা সময়ে দেখান কিছুটা ঝলক। বাঁ দিক দিয়ে তেড়েফুঁড়ে বেরিয়ে গিয়ে রফিকুল ইসলামের জন্য গোলের সুযোগ তৈরি করে দেন। যদিও এই আক্রমণ পূর্ণতা পায়নি। বাংলাদেশ ২-০ গোলে হেরে শুরু করে সাফ। কিন্তু ওই দৌড়টাই রাকিবের মনের ভয় দূর করে দিয়েছিল।
“একটা সময় আমি ভাবতে পারিনি এবারের সাফ খেলতে পারব। যেভাবে চোট পেয়েছিলাম, প্রথম টিয়ারে চোট ছিল, কিন্তু কোচ ও কোচিং প্যানেলের সবাই আমার উপর ভীষণ আস্থা রেখেছেন। কোচ বলেছিলেন, তোমাকে কম্বোডিয়ার বিপক্ষে খেলতে হবে না, সাফেও প্রথম ম্যাচ খেলা লাগবে না, মালদ্বীপের বিপক্ষে শুরু থেকে খেলতে পারলেই হবে। এখনও ১৪-১৫ দিন সময় আছে।”
“আসলে লেবানন ম্যাচের আগে মাঠে সেভাবে অনুশীলন করতে পারিনি। দুই দিন মাঠে অনুশীলন করেছিলাম। আমাদের ফিজিও কম্বোডিয়াতে থাকার সময় আমাকে নিয়ে খুব কষ্ট করেছেন, শ্রম দিয়েছেন জিমে। আসলে বড় ধরণের একটা চোট কাটিয়ে ফিরলে ওটা নিয়ে ভয় থাকে। সেই ভয়টাই কাজ করছিল। মাঠে যখন ১৫-২০ মিনিট খেললাম, তখন ভয়টা কেটে গেছে। পরের ম্যাচ যখন খেলতে নামলাম…তখন ভয়টা আর ছিল না। এটাও সত্যি দেশের জন্য যখন খেলতে নামি, তখন কোনো ভয় থাকে না। ওই দৌড়টা দেওয়ার পরই ভয়টা কেটে যায়। আগের দিনও রানিং করেছিলাম, তখন কোচও বলেছিলেন এখন তুমি খেলতে পারবে, কোনো সমস্যা হবে না।”
আরও দুঃস্বপ্ন ছিল সঙ্গী
এবারের সাফে তিনি আলো ঝলমলে, কিন্তু গতবারের এক দুঃস্বপ্ন ছিল সঙ্গী। নেপালের বিপক্ষে ম্যাচে জিতলে ফাইনালে খেলত বাংলাদেশ, কিন্তু রাকিবের ভুলেই ভেস্তে যায় সবকিছু। ৮০তম মিনিটে তার ভুল ব্যাক পাস ক্লিয়ার করতে গিয়ে নবযুগ শ্রেষ্ঠার সঙ্গে সংঘর্ষ হয় আনিসুর রহমান জিকোর। গোলরক্ষক লালকার্ড পেলে ১০ জনের দলে পরিণত হয় দল। পোস্ট সামলানোর দায়িত্ব ওঠে আশরাফুল ইসলাম রানার কাঁধে। কিন্তু দ্বিতীয়ার্ধের যোগ করা সময়ে পেনাল্টি গোলে স্বপ্ন ভাঙে বাংলাদেশের। সেই দুঃস্বপ্ন এখনও তাড়া করে ফিরে রাকিবকে।
“ওইটা ছিল আমার প্রথম সাফ, প্রথম দিকে বলে নার্ভাসনেস ছিল। আমার কিছু ভুল ছিল, কিছু সমস্যা ছিল, যেটা নিয়ে আমার ক্লাবের যে কোচ, তিনি কাজ করেছিলেন। যার কারণে এখন ওরকম সমস্যা হয় না। আল্লাহর রহমতে এবারের সাফটা আমার গতবারের চেয়ে ভালো হচ্ছে। ক্লাবে অনেক পরিশ্রম করেছি।”
“ওই সাফের কথা যখনই মনে হয়, ফেইসবুকে বা ইউটিউবে দেখতাম ওই দৃশ্য, তখন খুব খারাপ লাগত। আমি নিজেকে দোষারোপ করতাম, মনে হতো, যদি ওই ব্যাক পাসটা না দিতাম, তাহলে… ওই বছর সাফে কিন্তু আমরা খুব ভালো খেলেছি, ফাইনালও খেলতে পারতাম, ওই ভুলের কারণে নিজের কাছে খুব খারাপ লাগত। কিন্তু ফুটবল এমন একটা খেলা, অনিশ্চয়তার খেলা, এখানে যে কোনো সময় যেকোনো কিছু হতে পারে। কেউ ইচ্ছাকৃতভাবে এমন ভুল করে না, কিন্তু খেলার ভেতরে এগুলো হয়ে যায়। হ্যাঁ, ওই বিষয়টা আমার নিজের ভেতরে কাজ করেছে। মনে হয়েছে, গতবার আমার ভুলের কারণে ওটা হয়েছে, এবার যেন না হয়। এবার আমি যেন ভালো কিছু করতে পারি।”
এবার ভাঙতে চান কুয়েতের রক্ষণ
আপনার বিশেষত্ব কি? এ প্রশ্নে আত্মবিশ্বাসী কণ্ঠেই রাকিব বলেন ‘গতি।’ এর আগে কোচ কাবরেরাও প্রিয় শিষ্যকে প্রশংসার সুরে বলেছেন ‘বিস্ট।’ এবার তিনি ভাঙতে চান কুয়েতের রক্ষণ। আক্রমণভাগে শেখ মোরসালিনের সঙ্গে বোঝাপড়া দারুণ হওয়াটা আরও সাহসী করে তুলছে তাকে।
“এটায় (নিজের দুই গোল) আমার চেয়েও পুরো দলের কৃতিত্ব। দলের সবাই যদি একসাথে পরিশ্রম না করত, তাহলে আমার একার পক্ষে সম্ভব হতো না। এটা পুরো দলের কৃতিত্ব। ক্লাব থেকেই মোরসালিনের সঙ্গে আমার বোঝাপড়া ভালো। ক্লাব থেকে আপনারা দেখবেন… শেষ দুই ম্যাচ ও খেলেছে, আমাদের বোঝাপড়া ছিল। প্রথম ম্যাচে আমাকে পাস দিয়েছে, আমি গোল করেছি, এগুলো ক্লাবের হয়ে খেলার সময় হয়েছে। আমরা এক বছর এক ক্লাবে আছি, এজন্য ওর সাথে আমার বোঝাপড়া ভালো।”
চলতি সাফে সবচেয়ে বেশি গোল (৮টি) করা দল কুয়েত, এশিয়ান কাপের সাবেক চ্যাম্পিয়নরা গোল হজম করেছে মাত্র ২টি। তাদের রক্ষণে কঠিন পরীক্ষার মুখোমুখি হতে হবে, জানেন রাকিব। এটাও জানেন, কুয়েতের বিপক্ষে গোল পাওয়া মানে বিশাল কিছু।
“ইনশাআল্লাহ, সম্ভব হবে (আমরা ওদের রক্ষণ ভাঙতে পারব)। আত্মবিশ্বাস আছে সবার মধ্যে। ভালো কিছু হবে। এখন তো গ্রুপের ম্যাচ না। সেমি-ফাইনাল। সবাই চাইবে ইতিহাসে নাম লেখাতে। আমরা ফাইনালে যেতে চাই। আমিও চাই ইতিহাসের অংশ হতে (কুয়েতের বিপক্ষে গোল করে)।
রাকিবের স্বপ্ন আছে আরও
বরিশালের ছেলে রাকিব। ফুটলের আঙিনায় তার পা রাখা রাকিব নামের এক ভাইয়ের হাত ধরে। এরপর সৈয়দ গোলাম জিলানীর চোখে পড়েন তৃতীয় বিভাগে আরাফ স্পোর্টিং ক্লাব, পুলিশ ফুটবল ক্লাবে খেলার সময়। ভিক্টোরিয়া এফসি ঘুরে এই কোচের হাত ধরে ২০১৮ সালে যোগ দিলেন প্রিমিয়ার লিগের দল রহমতগঞ্জ মুসলিম ফ্রেন্ডস অ্যান্ড সোসাইটিতে। এরপর চট্টগ্রাম আবাহনী, ঢাকা আবাহনী হয়ে গত বছর যোগ দেন বসুন্ধরা কিংসে। চলতি লিগে কিংসের বিদেশি ফরোয়ার্ডদের ভিড়ে পাওয়া সুযোগে গোল করেছেন ৪টি, অ্যাসিস্ট আছে পাঁচটি। চলতি সাফে এরই মধ্যে দুইবার পেয়েছেন জালের দেখা। পরিশ্রমের সিঁড়ি বেয়ে এসেছেন এতখানি, পেরুতে চান দেশের গণ্ডিও।
“আসলে ফুটবলে পরিশ্রম ছাড়া কোনো কিছু সম্ভব না। মাঠে এবং ট্রেনিংয়ের কঠোর পরিশ্রম, কোচ যখন যা করতে বলেন সেটা করি এবং আমি নিজেও এক্সট্রা কিছু করার চেষ্টা করি। মাঠের বাইরে জিম, সব কিছু মিলিয়ে জীবনটাকে একটা সিস্টেমের মধ্যে নিয়ে এসেছি বলে এগুলো সম্ভব হচ্ছে। স্কোরিংয়ে আমার আরও উন্নতি দরকার। যখন বক্সে যাই, তখন তাড়াহুড়ো করে ফেলি। খেলা শুরুর আগে ভাবি ওগুলো করব না, কিন্তু মাঠে গেলে একটু নার্ভারনেস কাজ করে, এটা নিয়ে কাজ করছি।”
“দেশের বাইরে খেলার স্বপ্ন তো আছেই। ভারতের আইএসএলে খেলার ইচ্ছা আছে। ভালো কোনো সুযোগ যদি আসে, তাহলে তো খেলব। পরিশ্রম করে যাচ্ছি, শিখছি, শেখার তো আসলে শেষ নেই। এখনও সময় আছে, আমি যেখানে যাই, সেখান থেকেই শিখি।”
সাফের পারফরম্যান্স দিয়ে রাকিবের মতো পাদপ্রদীপের আলো কেড়ে নিচ্ছেন মোরসালিন, ফয়সাল আহমেদ ফাহিম, মজিবুর রহমান জনিরা। রাকিবের মনে হচ্ছে ব্যক্তিগত নৈপূণ্য নির্ভর খেলোয়াড়ের জন্ম হচ্ছে বাংলাদেশ দলে।
“ভারত দল সুনিল ছেত্রির উপর নির্ভর করে অনেকটা, কিন্তু আমরা একটা দল হয়ে খেলি। আসলে একেকটা দল একেক রকম সিস্টেমে খেলা করে। আমরা দলীয়ভাবে চেষ্টা করছি। সেই ক্যারেক্টারগুলো (ব্যক্তিগত নৈপুণ্য নির্ভর খেলোয়াড়) আস্তে আস্তে তৈরি হচ্ছে এবং ইনশাল্লাহ আগামীতে আরও ভালো হবে।”