সংবাদ সম্মেলন শেষ করে দুপুরের খানিকটা পর বাংলাদেশ দল ছুটল আর্মড পুলিশ ফোর্স মাঠে। কাঠমাণ্ডু শহরেই পাহাড়ের কোলঘেঁষা নান্দনিক এক ময়দান। শান্ত ও সুনিবিড় সেই প্রাঙ্গন মুহূর্তেই মুখরিত ও প্রাণবন্ত হয়ে উঠল সাবিনা খাতুন, কৃষ্ণা রানী সরকারদের কলরবে। সোমবার ঘণ্টা দেড়েকের এই ঘাম ঝরানো প্রস্তুতির পরতে পরতে স্পষ্টভাবে ফুটে উঠল আগের রাতে করে আসা প্রতিজ্ঞার ছাপও।
গত রাতের টিম মিটিং ছিল না স্রেফ আর দশটা মিটিংয়ের মতো। ‘সাফের শিরোপা জিততে হবে’, প্রথাগত এমন শপথ বাক্য পাঠ কারানো হয়নি। কিন্তু কোচ গোলাম রব্বানী ছোটন বুঝিয়ে দিয়েছেন তার চাওয়াটা। “না পাওয়ার অতীত ভুলে যাও, নতুন স্বপ্ন ও লক্ষ্য নিয়ে বাঁচো, ঝাঁপিয়ে পড়ো মাঠে”, এই মন্ত্র জপতে বলে দিয়েছেন। মেয়েরাও তা গেঁথে নিয়েছে মনে।
মেয়েদের সাফ ফুটবলে বাংলাদেশের প্রত্যাশা আর প্রাপ্তি এখনও মেলেনি একবিন্দুতে। পিছু ফিরে দেখা সাফের পাঁচ আসরে প্রাপ্তি কেবল ২০১৬ সালের আসরে ফাইনাল খেলা। ভারতের কাছে হেরে রানার্সআপ হওয়া। সবশেষ ২০১৯ সালে এই নেপালের বিরাটনগরেও চাওয়ার সঙ্গে পাওয়ার হিসেবটা মেলেনি। সেবার দল ছিটকে যায় সেমি-ফাইনালে স্বাগতিক নেপালের কাছে হেরে।
ছোটনের চাওয়া, হতাশার এই অতীতটুকু ভুলে যাক তার দল।
“এতদিন এই মেয়েরা একসঙ্গে রয়েছে। অনেক আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলেছে। তারা যে পারবে, এই বিশ্বাস তাদের এখন থাকতেই হবে। নিজেদের সামর্থ্যের উপর বিশ্বাস রাখতেই হবে। সামনে এগিয়ে যেতে চাইলে অতীত নিয়ে পড়ে থাকলে তো আর চলবে না।”
তাই শনিবার কাঠমান্ডুতে নোঙর ফেলে পরের দিন থেকে শুরু হয়েছে অনুশীলন। দুই দিনের প্রস্তুতিতে, হোটেলে-মাঠে মেয়েদের চলনে-বলনে, নিজেদের মধ্যে আলাপচারিতায় আত্মবিশ্বাসে ফুটতে থাকা একটা দলের প্রতিচ্ছবিই ভেসে উঠেছে টিম ম্যানেজার আমিরুল ইসলাম বাবুর মনে।
“মেয়েরা খুবই হাসিখুশি আছে, তাদের মধ্যে দুঃশ্চিন্তার কিছু দেখিনি। ওদের দেখেই মনে হচ্ছে, ভালো কিছু করতে ওরা এবার দারুণ আত্মবিশ্বাসী। কঠোর প্রস্তুতিও নিচ্ছে হাসি মুখে।”
প্রস্তুতি শেষে মেয়েদের এই উচ্ছ্বলতার প্রমাণও মিলেছে। কেউ কেউ খুনসুটিতে মেতে উঠলেন সতীর্থের সঙ্গে। মিডফিল্ডার ঋতুপর্না চাকমা তো মুহূর্তেই হয়ে গেলেন ক্যামেরাম্যান; দুই ডিফেন্ডার মাসুরা পারভীন ও নিলুফা ইয়াসমিন নীলা পোজ দিলেন হাসি মুখে।
গত রাতের ‘শপথ অনুষ্ঠান’ নিয়ে প্রশ্ন করতে হেসে ফেললেন মনিকা চাকমা। মাঝ মাঠের সুরটুকু বেঁধে দেওয়ার ভার তিনি বেশ কিছুদিন ধরে টেনে নিচ্ছেন মারিয়া মান্দার সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়। এবারের স্বপ্ন পূরণের লক্ষ্যে এই দুজনের কাছে প্রত্যাশা অনেক বেশি। মনিকাও প্রতিশ্রুতি দিলেন তা পূরণের।
“জিততেই হবে-এই পণ স্যার আমাদের করাননি। তবে কী কী করতে হবে, সবই বলেছেন। সিনিয়র টিমের সাফ চ্যাম্পিয়নশিপে আমরা কখনও শিরোপা জিততে পারিনি। এটা নিয়ে অবশ্যই আমাদের সবার খারাপ লাগা আছে।”
“কোচ বলেছেন, আগের বিষয়গুলো ওভাবে মনে না রাখতে। দুই বছর আগের নেপালে এসে (বিরাটনগরে) আমরা পারিনি। এবারও নেপালে খেলা। তবে এটা নতুন আসর, তাই কোচ নতুন করে ভাবতে বলেছেন।”
আপাতত খুব বেশি দূরে না তাকিয়ে মনিকার ভাবনার কেন্দ্রে বুধবার দলের প্রথম ম্যাচ।
“প্রথম ম্যাচে আমাদের প্রতিপক্ষ মালদ্বীপ। জয়ে শুরুটা আমাদের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ এবং আমরা তাই মালদ্বীপ ম্যাচ নিয়ে ভাবছি।”
সেই ভাবনার প্রতিফলন পড়ল দলের অনুশীলনেও। ডান প্রান্ত ঘেঁষে ছুটলেন মাসুরা। আড়াআড়ি ক্রস বাড়ালেন বক্সে। কৃষ্ণা দারুণভাবে বুক দিয়ে বল নামিয়ে দিলেন সাবিনাকে। কিন্তু অসমান মাঠে বল একটু লাফিয়ে ওঠায় ঠিকঠাক শট নিতে পারলেন না অধিনায়ক। এই না পারার ক্ষোভেই চিৎকার করে উঠলেন সাবিনা।
প্রস্তুতিতে গোল পেলে বা না পেলেই বা কী? পরিসংখ্যানের পাতায় তার আচঁড় পড়বে না, সাবিনা তা খুব ভালো করেই জানেন। কিন্তু অধিনায়কের ওই চিৎকারটুকুই যেন বার্তা দিল, গত রাতের ‘শপথ’ কতখানি বুকে গেঁথে নিয়েছে দল।