‘চাই কিংসলের মতো আমাকে নিয়েও মাতামাতি হোক’

লাল-সবুজের জার্সিতে নিজেকে মেলে পাদপ্রদীপের আলোয় উঠে আসতে চান মজিবুর রহমান জনি।

মোহাম্মদ জুবায়েরমোহাম্মদ জুবায়েরসিলেট থেকেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 27 March 2023, 02:23 AM
Updated : 27 March 2023, 02:23 AM

সিশেলসের বিপক্ষে প্রথম ম্যাচে লাল-সবুজের জার্সিতে অভিষেক দুজনের। কিন্তু আলোচনায় এলিটা কিংসলে আছেন বেশি, কিছুটা আড়ালে মজিবুর রহমান জনি। এ নিয়ে হতাশা থাকা অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের সঙ্গে একান্ত আলাপচারিতায় এই অ্যাটাকিং মিডফিল্ডার আড়ালে থাকার প্রসঙ্গ পাড়তেই দিলেন পরিণত উত্তর। বললেন-তিনিও চান কিংসলের মতো তাকে নিয়েও মাতামাতি হোক এবং সেটা পারফরম্যান্স দিয়ে একদিন আদায় করে নেবেন।

জনি এমন আত্মপ্রত্যয়ী অনেক কারণে। শৈশব তার ঝঞ্জাবিক্ষুব্ধ। কৈশরে প্রাণ হারাতে বসেছিলেন অ্যাপেন্ডিক্স ফেটে যাওয়ায়। চোটে থমকে যাওয়া বড় ভাইয়ের কাঁধে চেপে এতটা পথ পাড়ি দেওয়ার পর প্রতিদান দেওয়ার নিদারুণ তাড়না ১৮ বছর বয়সী এই তরুণকে তাড়িয়ে বেড়ায় অনুক্ষণ। তাই কোনো আক্ষেপে নিঃশেষ হতে চান না তিনি, বরং আক্ষেপের অনলে পুড়ে হতে চান খাঁটি সোনা।

‘বস্তি’ থেকে রাজপথে আসা শৈশব

ছোটবেলা থেকে তিনি ডানপিঠে। ফুটবল তার খেলার সঙ্গী। দিনাজপুরে বাড়ির চারপাশ খানিকটা ‘বস্তি’ এলাকার মতো। মহল্লার ছেলেদের সঙ্গে খেলতেন ফুটবল। আর্জেন্টাইন মহাতারকা লিওনেল মেসি তার প্রিয় খেলোয়াড়। তবে তার শুরুর পথচলায় সবচেয়ে বেশি প্রভাব ছিল বড় ভাই মনিরুজ্জামান মনিরের। বড় ভাই ফুটবলার হওয়ায় পথটা শুরুতে প্রশস্ত হয়েছিল কিছুটা। কিন্তু কাঁধের চোটে মনিরের পেশাদার ক্যারিয়ার থমকে যাওয়ায় শঙ্কার মেঘ জমেছিল জনির আকাশেও।

“আমার জন্য বড় ভাই সবসময় ত্যাগ স্বীকার করেছে। দুই কাঁধে চোট পাওয়ায় ভাইয়ের ক্যারিয়ারটা এগোয়নি। আর্থিক অনটনের সংসার আমাদের। এখন খ্যাপ খেলে বেড়ান। আমার অর্থের জোগান সবসময় তিনিই দিয়েছেন। স্বপ্ন ভাঙার ব্যাপার ছিল বড় ভাইকে নিয়ে, তাই আমার বাবা চাইলেও মা কখনও চাননি আমি ফুটবল খেলি।”

“কিন্তু ভাই আর আব্বার কারণে ফুটবল চালিয়ে যেতে পেরেছি। এলাকার মানুষও নানাভাবে আমাকে সহযোগিতা করেছে। সবাই তো আর অর্থ দিয়ে সাহায্য করে না। কেউ-কেউ আর্থিক সাহায্য করেছে, বাকিরা এগিয়ে যাওয়ার জন্য দিয়েছে ভালোবাসা।”

বিকেএসপিতে ভর্তি এবং প্রাণে বেঁচে ফেরা

২০১৭ সালে বাংলাদেশ ক্রীড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বিকেএসপিতে ভর্তি হন জনি। ২০১৮ সালে আবাহনীর অনূর্ধ্ব-১৮ দলে খেলতে এসেছিলেন। একদিন অনুশীলন শেষে রুমে ফেরার পর পেটে ব্যথা অনুভব করেন। সেই সময়ের মনে হলে এখনও যেন শিউরে ওঠেন জনি।

“একদিন সন্ধ্যায় ফের ব্যথা উঠল, তখন আমি বাড়িতে। আব্বা গ্যাসের ওষুধ এনে দিল, সেটা খেলাম কিন্তু সারা রাত ব্যথায় কাতরাতে থাকলাম। পরে আমার এক বন্ধু ডাক্তারের পাশাপাশি থাকত, সে বলল ডাক্তার দেখা, আমার মনে হচ্ছে এটা তোর অ্যাপেন্ডিক্সের ব্যাথা। ডাক্তারের কাছে গেলে তিনি বলল অ্যাপেন্ডিক্স ফেটে গেছে। ডাক্তার বলেছিল, আরেকটু দেরি হলে তুমি মরে যেতে।”

প্রাণে বেঁচে গেলেন জনি। ছয় মাস চিকিৎসা নেওয়ার পর শুরু করলেন স্বপ্ন পূরণের পথে যাত্রা। ২০২১ সালে তৃতীয় বিভাগে খেললেন বিক্রমপুর কিংসের হয়ে, পরের বছর বাফুফে এলিট একাডেমির হয়ে খেললেন চ্যাম্পিয়ন্সশিপ লিগে, ২০২৩ সালে তার পা পড়ল প্রিমিয়ার লিগে সুবিশাল আঙিনায় এবং শিসেলসের বিপক্ষে গত শনিবার তার হয়ে খেল স্বপ্নের আন্তর্জাতিক অভিষেকও।

“বিষয়টা আমার কাছে স্বপ্নের মতো। যখন ক্যাম্পে ডাক পেলাম, শুরুতে ইচ্ছা ছিল ২৩ জনের দলে থাকার। সৌদি আরবে আমি ট্রেনিং করেছি মন দিয়ে। চেয়েছিলাম সেরা একাদশে থাকার, সেটা পূরণ হয়েছে। কোচ আমার টেকনিক্যাল দিক পছন্দ করেছেন বলে জানিয়েছেন। আমিও মনে করি আমার শক্তির জায়গা পাসিং, বল নিয়ন্ত্রণ। বডি ডজ দেওয়াতেও আমি ভালো। দুর্বলতা বলতে পেনাল্টি এরিয়ায়, গোলমুখে থ্রু পাস দেওয়াটা আমাকে আরও ভালোভাবে শিখতে হবে।”

এখন বড় স্বপ্ন আঁকা জনির চোখে

২০১৭ সালে প্রথম বাংলাদেশ অনূর্ধ্ব-১৫ দলে নাম লেখান জনি। এরপর সাফ ও এএফসির বয়সভিত্তিক অনূর্ধ্ব-১৬, ২০ দলে খেলেন।

বয়সভিত্তিক ফুটবল পেরিয়ে এ বছর থেকে তিনি খেলছেন প্রিমিয়ার লিগের দল ফর্টিস এফসির হয়ে। লিগে ১০ ম্যাচ খেলে কেড়ে নেন জাতীয় দলের কোচ হাভিয়ের কাবরেরার নজর। এখন বাকিদের নজর কাড়তে চান বেলজিয়ান তারকা কেভিন ডে ব্রুইনেকে ‘আইডল’ মেনে ছুটে চলা জনি। কিংসলের মতো নিজের অভিষেক নিয়ে মাতামাতি হলো না বলে মোটেও হতাশ নন তিনি।

“কিংসলে অন্য দেশের, তিনি বাংলাদেশের নাগরিকত্ব পেয়েছেন। তার প্রতি গণমাধ্যমের দৃষ্টি অন্যরকম ছিল। তাছাড়া তিনি অন্য মাপের খেলোয়াড়ও। আমি তরুণ, নতুন। তবে সমর্থন ও উৎসাহ পেলে আমি দেশকে আরও বেশি কিছু দেব ইনশাল্লাহ। হয়তো অভিষেক ম্যাচে আমি গোল পেলে গণমাধ্যমের দৃষ্টি আমার দিকে আসত, সেটা হয়নি বলে কিন্তু এ নিয়ে আমার কোনো খারাপ লাগা নেই। আমিও চাই আমাকে নিয়ে কিংসলের মতো মাতামাতি হোক এবং পারফরম্যান্স করেই একদিন সেটা আমি আদায় করে নেব।”

“আমি অ্যাটাকিং ফিল্ডার। এটা খুব টাইট একটা পজিশন। এখানে পাসিংয়ের জন্য, খেলার জন্য পর্যাপ্ত স্পেস আমরা তৈরি করতে পারি না, কিন্তু এটা আমাকে তৈরি করতে হবে। সামনে সাফ চ্যাম্পিয়নশিপ আছে। আশা করি, সাফে গোল করব এবং গোল করাব।”