দুই ভাইয়ের মধ্যে একজন স্পেনের হয়ে, অন্যজন ঘানার হয়ে খেলবেন।
Published : 08 Nov 2022, 06:27 PM
বছরখানেক আগেও এত বড় স্বপ্ন দেখেননি মারিয়া-ফেলিক্স দম্পতি। সেটাই এখন সত্যি হতে চলেছে। তাদের দুই ছেলে ইনাকি ও নিকো উইলিয়ামস খেলবেন কাতার বিশ্বকাপে! সাহারা মরুভূমির তপ্ত বালু মাড়িয়ে, ট্রাকে চেপে, পায়ে হেঁটে হাজার-হাজার মাইল পাড়ি দেওয়া সেই নিদারুণ কষ্টের দিন-রাতগুলোর স্মৃতি উঁকি দিচ্ছে মারিয়া-ফেলিক্সের মনে।
ইনাকি ও নিকো উইলিয়ামস-দুই ভাইয়ের মধ্যে আট বছরের ছোট নিকো। বড় জন ফরোয়ার্ড। ছোট জন উইঙ্গার। ক্লাব ফুটবলে দুজনে খেলছেন আথলেতিক বিলবাওয়ের হয়ে। কিন্তু বিশ্বকাপে দুজন ছুটবেন দুই পথে। ইনাকি বেছে নিয়েছেন পিতৃভূমি ঘানার জার্সি। স্পেনেরটা গায়ে তোলার অপেক্ষায় নিকো।
তেমন নামকরা না হলেও লা লিগায় ইনাকি বেশ পরিচিত। বিলবাওয়ের হয়ে স্পেনের শীর্ষ লিগে টানা ২০৩ ম্যাচ খেলার রেকর্ডের পাতায় নাম লিখিয়েছেন। যদিও ২০১৬ সালে স্পেনের হয়ে খেলেছিলেন, কিন্তু ওই এক ম্যাচই। এবার ইনাকি ঘানার তাবুতে। ‘ব্ল্যাক স্টার্স’দের হয়ে ম্যাচও খেলে ফেলেছেন দুইটি। গত সেপ্টেম্বরে নিকারাগুয়ার বিপক্ষে অভিষেক, পরের ম্যাচ খেলেন ব্রাজিলের বিপক্ষে।
২০ বছর বয়সী নিকোর পেশাদার ক্যারিয়ার সবে শুরু। তবে এরই মধ্যে বেশ কিছু ম্যাচ তিনিও খেলেছেন ক্লাব পর্যায়ে। স্পেনের জার্সিতে খেলা হয়েছে দুটি ম্যাচ। গত সেপ্টেম্বরে উয়েফা নেশন্স লিগের স্পেন দলে নিকোকে ডাকেন লুইস এনরিকে। অভিষেক হয় সুইজারল্যান্ডে বিপক্ষে।
নিকো দ্বিতীয় ম্যাচে বদলি নামেন পর্তুগালের বিপক্ষে। ওই ম্যাচে সামর্থ্যের ঝলক দেখান আলভারো মোরাতার জয়সূচক গোলের সুর বেঁধে দিয়ে। যে জয়ে সাওয়ার হয়ে স্পেন উঠেছে নেশন্স লিগের ফাইনাল ফোরে। ‘লা রোজা’দের সঙ্গে কাতারের বিমান ধরার জন্য আশায় আছেন এই তরুণ উইঙ্গারও।
বিশ্বকাপ নিয়ে দুই ছেলের গোছগাছ দেখে পিছু ফিরে দেখছেন মারিয়া-ফেলিক্স দম্পতিও। তাদের সংসারে গোছগাছের মতো তেমন কিছু যে ছিলই না। তাই একটু ভালো করে বাঁচার আশায়, একটু স্বচ্ছ্বল জীবনের খোঁজে দুজনে হাঁটা শুরু করেছিলেন ঘানা থেকে। চার হাজার কিলোমিটার পাড়ি দিয়ে পৌঁছান স্পেনের ছিটমহল মেলিয়ায়।
এই পথচলার বাঁকে বাঁকে বাধা-বিপত্তির অন্ত ছিল না। কখনও মানুষে ঠাসা ট্রাকে চেপে, বাকিটা পথ পায়ে হেঁটে, ৪০ থেকে ৫০ ডিগ্রি তাপমাত্রায় আগুণ হয়ে থাকা সাহারা মরুভূমির বালু মাড়িয়ে ছিটমহলে এসে পৌঁছেছিলেন দুজনে। দুঃসহ সেই সময় ছাপ রেখে রেখে গেছে ফেলিক্সের পায়ে, এখন তার হাঁটতে সমস্যা হয়।
নতুন জীবনের সন্ধানে যখন নিরন্তর ছুটছেন মারিয়া ও ফেলিক্স, তখন ইনাকি-নিকো কারো জন্ম হয়নি। ইনাকি তখন মারিয়ার গর্ভে। কিন্তু মেলিয়ায় পৌঁছে অবৈধ হিসেবে গ্রেফতার হলেন তারা। তবে ভাগ্য সূপ্রসন্ন হলো কিছুটা। জুটল রাজনৈতিক আশ্রয়।
জন্ম হলো ইনাকির। এই নামের পেছনেও আছে গল্প। যে পাদ্রি দুঃসময়ে আগলে রেখেছিলেন, তার নামানুসারেই রাখা হয় ছেলের নাম। বাবা-মায়ের সেই কষ্টের স্মৃতি গার্ডিয়ানকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে আওড়েছিলেন ইনাকি।
“বাবা-মা আমাদের জন্য যে আত্মত্যাগ করেছেন, তাদের সেই ত্যাগের গল্প শুনে প্রতিদান দিতে আরও বেশি লড়াই করার ইচ্ছা জাগে। কখনও এর প্রতিদান দিতে পারব না-তারা নিজেদের জীবনকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলেছিলেন। সেই জীবনটাই আমি তাদেরকে দেওয়ার চেষ্টা করি, যে জীবন আমাদেরকে দেওয়ার স্বপ্ন দেখেছিলেন তারা।”
চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে পামপ্লোনার কাছাকাছি এক শহরে থিতু হলেন মারিয়া-ফেলিক্স দম্পতি। আট বছর পর কোলজুড়ে এলো নিকো। ওই সময় ফেলিক্সকে পরিবারের প্রয়োজন মেটাতে বাইরে-বাইরে থাকতে হতো। আট বছরের বড় ইনাকি তখন নিকোর ‘অভিভাবক’! ছোট ভাইকে স্কুলে নিয়ে যাওয়া, ফুটবল অনুশীলন করানো, নিকোর জন্য দুপুরের খাবার তৈরি-এমন অনেক কিছু করতে হতো তাকে।
বড় ভাইয়ের বড্ড ন্যাওটা ছিলেন নিকো। ২০১৩ সালে ইনাকি যখন আথলেতিক বিলবাওয়ে যোগ দিলেন, ১১ বছর বয়সী নিকোও পিছু ধরল তার। সেখানকার যুব দলে যোগ দিল। এরপর শুরু হলো দুই ভাইয়ের একই আঙিনায় ফুটবলার হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে বেড়ে ওঠা।
বলার অপেক্ষা রাখে না, দুজনের স্বপ্নই পূরণ হয়েছে। এখন বিশ্বকাপ স্বপ্ন পূরণ হওয়ার পালা। মা মারিয়ার আনন্দ তাই বাঁধনহারা।
“আমি ওদেরকে নিয়ে গর্ব অনুভব করি। ফুটবলার হওয়া খুবই কঠিন। ১০০ জনের মধ্যে মাত্র পাঁচজন ফুটবলার হতে পারে। কল্পনা করুন, সেখানে একই দলে দুই ভাই খেলছে।”
দুজনের বড় হওয়া, ফুটবলার হয়ে ওঠা একসাথে। বিলবাওয়ের হয়ে ১২টি লিগ ম্যাচও খেলেছেন একসঙ্গে। নিকো খেলেছেন রাইট-উইংয়ে, ইনাকি সেন্টার-ফরোয়ার্ডের ভূমিকায়। এই প্রথম তারা ‘আলাদা হচ্ছেন’; জাতীয় দলে খেলবেন ভিন্ন ভিন্ন জার্সিতে।
মারিয়া-ফেলিক্স কি একটু দোটানায় পড়ে গেলেন? স্পেন ও ঘানা অবশ্য কাতার বিশ্বকাপে এক গ্রুপে নেই। ‘ই’ গ্রুপে স্পেনের সঙ্গে আছে কোস্টা রিকা, জার্মানি ও জাপান। ‘এইচ’ গ্রুপে ঘানার প্রতিপক্ষ পর্তুগাল, উরুগুয়ে ও দক্ষিণ কোরিয়া।
গ্রুপ পর্বে হচ্ছে না, কিন্তু বিশ্বকাপের পথচলায় যদি সত্যিই দেখা হয়ে যায় স্পেন ও ঘানার, তখন? আবেগের টানাপোড়েনের চোরাস্রোত নিশ্চিতভাবে বয়ে যাবে বাবা-মায়ের মনে। পাশাপাশি তৃপ্তির ফল্গুধারাও তো বইবে-দুই ছেলেকে এমন জীবন দেওয়ার জন্যই তো চার হাজার কিলোমিটার পাড়ি দিয়ে দেশান্তরী হয়েছিলেন তারা!
স্পেন ও ঘানা, কোনো দলই অবশ্য এখনও তাদের স্কোয়াড ঘোষণা করেনি। তবে ইনাকির ঘানার দলে ডাক পাওয়াটা প্রত্যাশিতই। নিকোও শুরুর দুই ম্যাচে জানান দিয়েছেন সামর্থ্যের। এখন কেবল স্পেন কোচ লুইস এনরিকের নাম ঘোষণার অপেক্ষা।