ফুটবল বিশ্বের অনেকের কাছে কদিন আগেও এক অপরিচিত নাম ছিল শেরিফ তিরাসপুল। তিন ধাপের বাছাইপর্ব ও সবশেষে প্লে-অফ পেরিয়ে তারা যখন চ্যাম্পিয়ন্স লিগে জায়গা করে নিল, তখন কেউ কেউ হয়তো মাথা চুলকে বলেছিল, এরা আবার কারা!
Published : 30 Sep 2021, 11:09 AM
সেই দলটি যখন রিয়াল মাদ্রিদ, ইন্টার মিলান ও শাখতার দোনেৎস্কের সঙ্গে একই গ্রুপে জায়গা পেল, তখন ফুটবল বিশেষজ্ঞদের অনেকে হয়তো ভাবতে শুরু করেছিলেন, ম্যাচগুলোয় কত গোল হজম করবে শেরিফ নামের এই দল। মাঠের লড়াই শুরু হতেই অবশ্য সব ভাবনা বদলে গেছে। দুর্দান্ত পারফরম্যান্সে তাক লাগিয়ে দিয়েছে তারা।
চ্যাম্পিয়ন্স লিগের ইতিহাসের সবচেয়ে বড় অঘটনটগুলোর একটির জন্ম দিয়ে ফেলেছে ক্লাবটি। প্রতিযোগিতার রেকর্ড চ্যাম্পিয়ন রিয়াল মাদ্রিদকে হারিয়ে দিয়েছে তাদের মাঠেই!
বিস্ময়ের শেষ নয় এখানেই, আসরের নবাগত ক্লাবটি জিতেছিল টুর্নামেন্টে নিজেদের আগের ম্যাচটিও। ‘ডি’ গ্রুপের পয়েন্ট তালিকায় ৬ পয়েন্ট নিয়ে সবার ওপরে ছোট্ট দেশটির এই ক্লাব।
অনেকের মনেই একটি প্রশ্ন ঘুরেফিরে আসছে। ফুটবলের দুনিয়ায় এই শেরিফ আসলে কারা?
এক অ-স্বীকৃত রাজ্য
শেরিফ তিরাসপুলের অবস্থান পূর্ব ইউরোপের দেশ মলডোভায়। ৩৫ লাখ মানুষের দেশটি অর্থনৈতিকভাবে ইউরোপের সবচেয়ে গরীব দেশগুলোর একটি।
সোভিয়েত ইউনিয়ন ভাঙার এক বছর আগে ১৯৯০ সালে রাশিয়ান ভাষাভাষীরা মলডোভা ছেড়ে চলে যায়। তাদের মনে ভয় ছিল, ভাষা ও সংস্কৃতিতে মিল থাকায় শিগগিরই হয়তো রোমানিয়ার সঙ্গে মিলে যাবে এই দেশ।
এরপর ১৯৯২ সালে সেখানকার বিচ্ছিন্নবাদীরা মলডোভার সঙ্গে ছোট একটি যুদ্ধও করে এবং এটাকে স্বাধীন রাজ্য হিসেবে ঘোষণা করে, যদিও রাশিয়াসহ কোনো দেশেরই স্বীকৃতি মেলেনি।
দেশটির নিজেদের পতাকা আছে, নাম্বার প্লেট, পাসপোর্ট ও মুদ্রাও আছে। এলাকাটিকে বলা যায় সোভিয়েত শাসনামলের ‘টাইম ক্যাপসুল।’
বিশ্ব রাজনীতিতে আরও অবাক করা তথ্য হলো, এই এলাকায় এখনও রাশিয়ার সৈন্যরা অবস্থান করছে, এমনকি অনেক আগে থেকে মলডোভার সরকার তাদের চলে যেতে বলার পরও।
এই এলাকার জনসংখ্যা সাড়ে চার লাখ। অবশ্য এর অধিকাংশই কাজের জন্য চলে গেছে রাশিয়া, ইসরায়েল ও তুরস্কে। প্রায় দুই লাখ মানুষ রাশিয়ার নাগরিক, এক লাখ ২০ হাজার ইউক্রেনের এবং মলডোভার নাগরিক দুই লাখ। বুলগেরিয়া ও রোমানিয়ার নাগরিকও আছে।
ক্লাবের মালিকানা
ক্লাবটির মালিকানা শেরিফ কোম্পানির এবং এর নামকরণও প্রতিষ্ঠানটির নামে।
সোভিয়েতের দুই সাবেক পুলিশ কর্মকর্তা ভিক্তর গুসান ও ইলিয়া কাজমালি ১৯৯০-এর দশকে কর্পোরেশনটি প্রতিষ্ঠা করেন। ট্রান্সনিস্ট্রিয়ার ব্যবসায়িক কাঠামোয় এই প্রতিষ্ঠানেরই আধিপত্য চোখে পড়ে; পেট্রোল স্টেশন থেকে শুরু করে, মোবাইল ফোন নেটওয়ার্ক, ব্যাঙ্কিং এবং সেখানকার জনপ্রিয় ব্র্যান্ডি তৈরিতে।
সাম্প্রতিক সময়ে মলডোভার শীর্ষ লিগে শেরিফের দাপট স্পষ্ট; গত ১০ শিরোপার ৯টিই জিতেছে তারা। লিগের চলতি আসরে আট ম্যাচে ১৯ পয়েন্ট নিয়ে তাদের অবস্থান তিন নম্বরে; শীর্ষে থাকা ক্লাব মিলসামির ৮ পয়েন্ট পেছনে, তবে তিন ম্যাচ কম খেলেছে শেরিফ।
বিদেশি খেলোয়াড়
মলডোভার লিগের অধিকাংশ ক্লাবই মূলত স্থানীয় খেলোয়াড়দের নিয়ে গড়া। তবে শেরিফ তিরাসপুল এক্ষেত্রে ভিন্ন। দলটিতে আছে কলম্বিয়া, ঘানা, নাইজেরিয়া, পেরু, ব্রাজিল, গ্রিস ও উজবেকিস্তানের খেলোয়াড়।
দলটির বর্তমান স্কোয়াডে মলডোভার খেলোয়াড় মোটে পাঁচজন। রিয়ালের বিপক্ষে ইতিহাস গড়া ম্যাচেই যেমন তাদের একাদশে ছিল না দেশটির কোনো খেলোয়াড়। দলটিতে লুক্সেমবুর্গের একজন খেলোয়াড়ও আছেন-মিডফিল্ডার সেবাস্তিয়ান থিল। লুক্সেমবুর্গের ক্লাব প্রগেস নিডারকর্ন থেকে ধারে আসা এই মিডফিল্ডারের ৮৯তম মিনিটের গোলেই রিয়ালকে তাদেরই মাঠে চমকে দেয় শেরিফ।
ক্লাবটির আমদানি করা সবচেয়ে বড় সম্পদ বলা যায় ইউক্রেনের কোচ ইউরি ভেরনিডুব। ৫৫ বছর বয়সী সাবেক এই ফুটবলারের হাত ধরেই প্রথমবারের মতো চ্যাম্পিয়ন্স লিগে উঠে এসেছে দলটি। সবাইকে অবাক করে দিয়ে ইউরোপ সেরার মঞ্চে পেয়েছে অসাধারণ শুরু। এবার পালা কেবলই সামনে এগিয়ে যাওয়ার।