সময়ের সেরা ছাপিয়ে অনেকে তাকে রাখতে শুরু করেছেন সব সময়ের সেরার তালিকায়। ফুটবল কিংবদন্তি পেলে ও মারাদোনার চেয়েও তাকে বড় করে দেখেন কেউ কেউ। তবে এই আলোচনায় শুরুতেই এতদিন বসে যেত একটি যতি চিহ্ন, দেশের হয়ে যে তেমন কোনো সাফল্য ছিল না মেসির।
কোপা আমেরিকায় এই জয়ে, আর্জেন্টিনার ২৮ বছরের শিরোপা খরা কাটিয়েই যে মেসি বিশ্বজয়ী পেলে, মারাদোনাকে ছাপিয়ে গেছেন এমন নয়। তবে সর্বকালের সেরা আলোচনায় মেসির উপস্থিতি নিশ্চিত হয়ে গেল এবার।
ছয় ব্যালন ডি’অর জয়ের রেকর্ড আগে থেকেই মেসির। কোপা আমেরিকার মুকুট মাথায় তোলার পর হয়তো এসে যেতে পারে সপ্তমটিও।
এর আগে দেশের হয়ে একটি বিশ্বকাপ ও তিনটি কোপা আমেরিকার ফাইনালে খেলেছিলেন মেসি। প্রতিবারই ফিরেছিলেন শূন্য হাতে। এবার পেলেন মুঠো ভরে। ২০১৪ সালে জার্মানির বিপক্ষে যে মাঠে হেরেছিলেন বিশ্বকাপের ফাইনালে, যে মাঠে আছে আর্জেন্টিনার অনেক বেদনার কাব্য সেই ঐতিহ্যবাহী মারাকানা স্টেডিয়ামে জিতলেন দেশের হয়ে প্রথম শিরোপা।
মেসি কাঁদছেন, তবে এই কান্না প্রাপ্তির কান্না
ব্রাজিল বিশ্বকাপে তো সেরা খেলোয়াড়ের পুরস্কার গোল্ডেন বলও জিতেছিলেন মেসি। কিন্তু ওই যে, খুব কাছে গিয়েও শিরোপায় চুমু আঁকা হয়নি। তাইতো তার চোখে-মুখে ছিল অন্ধকার।
এবার যেন সব শূন্যতা মিটে গেল। আসরের শুরু থেকে তিনি ছিলেন আরও উদ্যমী। কদিন আগে ব্রাজিলিয়ান কিংবদন্তি তোস্তাও যেমন বলেন, এই মেসি আরও গতিময়। আরও শক্তিশালী, ধারালো এবং সাফল্যের জন্য মরিয়া। টুর্নামেন্টে আর্জেন্টিনার হয়ে কেবল তিনিই খেলেছেন প্রতিটি মিনিট। আগেই শেষ চার নিশ্চিত হলেও নেননি বিশ্রাম। সেমি-ফাইনালের দ্বিতীয়ার্ধের প্রায় পুরোটা খেলেন রক্তাক্ত পা নিয়ে।
সাম্প্রতিক সময়ে ভুগছিলেন পেনাল্টিতে। কিন্তু কলম্বিয়ার বিপক্ষে টাইব্রেকারে বুলেট গতির শটে জাল খুঁজে নিয়ে বুঝিয়ে দেন স্নায়ুচাপ পাত্তা পাচ্ছে না তার কাছে। পাখির চোখ যে করেছেন শিরোপাকে।
জন্মদিনটা এবার আর্জেন্টিনার সতীর্থদের সঙ্গে কাটিয়েছেন মেসি। প্রায় সাত সপ্তাহ ধরে পরিবার-স্বজন থেকে দূরে। ক্লান্তিকর দীর্ঘ একটা মৌসুম শেষে করোনাভাইরাস পরিস্থিতিতে জৈব সুরক্ষা বলয়ে থাকছেন, কেবল একটি শিরোপার জন্য। সতীর্থরাও মরিয়া মেসির স্বপ্ন পূরণ করতে, দেশের ২৮ বছরের শিরোপা খরা কাটাতে।
কলম্বিয়াকে হারানোর পর মেসি জানান, এই সময়ে দলের কোনো সদস্য বাবা হয়েছেন। কিন্তু প্রিয় সন্তানকে দেখতে ছেড়ে যাননি ক্যাম্প। শিরোপা খরা কাটানোর প্রত্যয় যেন ছুঁয়েছিল সবাইকে।
করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে জর্জরিত ব্রাজিলে এবারের কোপা আমেরিকা সরিয়ে নেওয়ার পর খেলতে চাননি ব্রাজিলের খেলোয়াড়রা। একই ভাবনা ছিল আরও কয়েকটি দেশের খেলোয়াড়দের। তবে এত শঙ্কা থাকা সত্ত্বেও আর্জেন্টিনা কোনো দ্বিধায় ছিল না। সবার আগে দলটি জানায়, তারা খেলতে প্রস্তুত। দেশের হয়ে একটি শিরোপা জিততে মেসির যে বেশি সময় ছিল না, এবার না হলে আর দক্ষিণ আমেরিকার ফুটবল শ্রেষ্ঠত্বের লড়াইয়ে আর তার খেলা হয় কী না কে জানে।
গত ১ জুলাই থেকে কোনো দল নেই মেসির। তাকে চুক্তি করানোর চেষ্টা করে যাচ্ছে বার্সেলোনা। সতর্ক দৃষ্টি রাখছে পিএসজিসহ আরও কয়েকটি ক্লাব। যার ভবিষ্যৎ ঠিকানা নিয়ে এত আলোচনা, সেই মেসির ভাবনার পুরোটা জুড়েই ছিল জাতীয় দল আর কোপা আমেরিকা। গোল করে ও করিয়ে নেতৃত্ব দিয়েছেন সামনে থেকে। ফাইনালের পথে ছয় ম্যাচের চারটিতেই জিতেন ম্যাচ সেরার পুরস্কার।
চার গোল করে আসরের সর্বোচ্চ গোলদাতা তিনিই। তার পাঁচ অ্যাসিস্ট তো কোপা আমেরিকার ইতিহাসেই রেকর্ড। এত গোল কোনো আসরে ছিল না কারও।
আর ফাইনালের আগে নেইমারের সঙ্গে যৌথভাবে জিতেছেন আসরের সেরা খেলোয়াড়ের পুরস্কারও। সঙ্গে সর্বোচ্চ গোলদাতার খেতাব। আর সবশেষে উঁচিয়ে ধরলেন আরাধ্য ট্রফিটি। এ যেন মেসিময় কোপা আমেরিকা!