উইমেন’স সাফ চ্যাম্পিয়নশিপ
যার হাত ধরে জাতীয় নারী ফুটবল দলের প্রথমবারের মতো সাফ চ্যাম্পিয়নশিপ জয়ের উচ্ছ্বাসে মেতে ওঠা, সেই গোলাম রব্বানী ছোটন মনে করছেন, এবার প্রস্তুতিতে ভারত-নেপালের চেয়ে অনেক পিছিয়ে বাংলাদেশ।
Published : 14 Oct 2024, 04:06 PM
পেশাদার দুনিয়া- গোলাম রব্বানী ছোটনের এই ছোট্ট কথাতেই ফুটে উঠল তার আবেগ, আক্ষেপ হতাশা, ক্ষোভের সবটুকু! বাংলাদেশ নারী ফুটবলের সেরা সাফল্য তো বটেই, এর সব আনন্দ-বেদনার গল্পের পাতাজুড়ে ছিলেন তিনি। এরপর নানা বাঁকবদলে, রূঢ় বাস্তবতায় তাকে ছাড়তে হয় বাংলাদেশ দলের ডাগআউট। ফলে দীর্ঘদিন যিনি ছিলেন নেপথ্যের কারিগর, উইমেন’স সাফের মুকুট ধরে রাখার মিশনে এবার তিনি দর্শক।
রব্বানী চলে যাওয়ার পর জাতীয় নারী ফুটবল দলের হাল ধরেন পিটার বাটলার। ১৭ অক্টোবর নেপালের কাঠমাণ্ডুতে শুরু হতে যাওয়া সাফে তার ছকেই খেলবেন সাবিনা-কৃষ্ণা-মারিয়ারা। নতুন কোচের অধীনে মেয়েরা মুকুট ধরে রাখতে পারবে কিনা, সে প্রশ্নের উত্তর কেউ দিচ্ছেন আশার সুরে, কেউ বলছেন শঙ্কা মেশানো কণ্ঠে।
গত ছয়টি সাফে বাংলাদেশের সঙ্গী ছিলেন রব্বানী। এবার তিনি নেই। তবে নেই বলে পুরো ‘নেই’ হয়ে যাননি। বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের সাথে আলাপচারিতায় সাফজয়ী এই কোচ খুলে দিলেন মনের আগল। মেয়েদের সাথে যোগাযোগ থাকা, নানা পরামর্শ দেওয়া থেকে শুরু করে, বর্তমান দল নিয়ে ভাবনা, দলের কৌশলগত পরিবর্তনসহ নানা বিষয় নিয়ে কথা বললেন তিনি।
এবার আপনি দলের সাথে নেই, অথচ আপনার হাত ধরেই ২০২২ সালে এসেছিল সেরা সাফল্য। মুকুট ধরে রাখার মিশনে কোচ হিসেবে না থাকা…।
গোলাম রব্বানী: পেশাদার দুনিয়া-এটাই স্বাভাবিক। আমার ভাগ্য ভালো যে সবার দোয়ায় দীর্ঘদিন বাংলাদেশের কোচ ছিলাম। বাংলাদেশ এ নিয়ে সপ্তম সাফ চ্যাম্পিয়নশিপে খেলবে, ছয়টাতেই আমি ছিলাম। সেদিক থেকে আমি ভাগ্যবান। এবার দায়িত্বে নেই। স্বাভাবিকই মনে হচ্ছে।
মানছি, পেশাদার দুনিয়ায় সবকিছুই সম্ভব, কিন্তু আপনার মুকুট ধরে রাখার মিশনে ডাগআউটে থাকাও তো সম্ভব ছিল, কেন সেটা হলো না?
গোলাম রব্বানী: অনেক দিন ধরে ফেডারেশন, গণমাধ্যম, আমরা সবাই মিলে কাজ করে উন্নতি করেছিলাম, সাফল্য পেয়েছিলাম। আমরা ২০১৪ সালে কাজ শুরু করেছিলাম, পরে গ্রাজুয়ালি উন্নতি করেছি এবং সিনিয়র সাফ চ্যাম্পিয়ন হয়েছি। এখানেই তো অবশ্যই প্রত্যাশা ছিল, যারা এত শ্রম দিয়ে এই সাফল্য পেল, তা ধরে রাখার লড়াইয়ে তারা থাকতে পারত। যে কোনো কারণেই এটা হয়নি। এটা আমার, দলের সবার জন্যই দূর্ভাগ্য বা যা কিছু বলেন, সেটাই।
আপনার সাফ জয়ী দলের সাথে যদি বর্তমান দলের তুলনা করতে বলি? বিশেষ করে এই দলে সিরাত জাহান স্বপ্না, আঁখি খাতুন নেই আগেভাগে অবসর নেওয়ায়।
গোলাম রব্বানী: বেশি দূর যাওয়া লাগবে না। যদি আপনারা চাইনিজ তাইপে ও ভুটানের বিপক্ষের ম্যাচগুলোই ধরেন, নেপালে সাফ চ্যাম্পিয়নশিপে আপনারা যে গতিময় খেলা দেখেছেন, যে সমন্বয়, ওয়ান টাচ-টু টাচ ফুটবল, যে মাঠে হাঁটা যায় না (সাফের সময় বৃষ্টিতে মাঠ কর্দমাক্ত ছিল), সেই মাঠে স্বপ্না, কৃষ্ণা, সাবিনা, সানজিদার সমন্বিত পাসে যে গোলগুলো, যে ছন্দ ছিল, সেগুলো এখনও চোখে ভাসে, চাইনিজ তাইপে ও ভুটানের বিপক্ষে সেগুলোর কিছুই দেখিনি আমি। যে সমন্বয়, বোঝাপড়া, ফাইনালে মাসুরা পারভীনের গোললাইন সেভ, কনফিডেন্স লেভেল, যে ইচ্ছাশক্তি, আমার মনে হয় সেগুলো মেয়েরা হারিয়ে ফেলেছে।
কেন হারিয়ে ফেলেছে বলে আপনার মনে হচ্ছে?
গোলাম রব্বানী: কারণ হচ্ছে বিভিন্ন বিষয়, সাফ চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পর বিভিন্ন ঘটনা শুরু হলো। প্রথমে মিয়ানমারে যেতে পারল না মেয়েরা, সবাই খেলার জন্য প্রস্তুত ছিল। এরপর কোচ বদল হলো, গত দুই বছরে আরও বিভিন্ন ঘটনা তো ঘটেছেই, মেয়েরা শুধু অনুশীলনই করেছে, ম্যাচ খেলার সুযোগ পায়নি। অথচ ভারত সাফে হেরে এসেই চারজাতি টুর্নামেন্ট আয়োজন করল, ইউরোপেও খেলছে। নেপালও বড় বড় দলের সঙ্গে খেলেছে। এই দুটি দল হচ্ছে আমাদের মূল প্রতিপক্ষ। গত দুই বছরে এই দুটি দল যে প্রস্তুতি নিয়েছে, আমরা তার ধারে কাছেও ছিলাম না।
অথচ প্রস্তুতি নেওয়ার কথা ছিল আমাদেরই। সাফ জিতে আসার পর বলেছিলাম, আমরা আশিয়ান অঞ্চলে খেলবো, আদৌ তা হয়নি। মেয়েরা শুধু অনুশীলনই করেছে, কোচ বদল হয়েছে। যখন একটা দল ২০১৪ সালে থেকে একটা দর্শন নিয়ে খেলেছে, হঠাৎ করে তাদের কৌশল বদল করে দেবেন, সেটার সাথে মানিয়ে নেওয়াই তাদের জন্য বড় ব্যাপার হয়ে গেছে।
কিন্তু এই দল নিয়ে তো উচ্ছ্বসিত অনেকে, প্রত্যাশাও অনেক। নতুন কোচের কৌশলে মানিয়ে নেওয়ার আশাবাদ জানিয়েছেন খেলোয়াড়েরাও।
গোলাম রব্বানী: ২০১৬ সালে আমরা যখন সাফে গিয়েছিলাম, তখন মারিয়া-মনিকাদের নিয়ে অনেকেই উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছিল, কিন্তু ওই বছর আমরা সাফ চ্যাম্পিয়ন হতে পারিনি। মনিকা, মারিয়া, স্বপ্না, আঁখি, শিউলি-তখন ওরা সবাই তখন প্রতিভাবান ছিল, কিন্তু ওরা ২০১৬ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত একসাথে থাকার কারণে, অনেক বয়সভিত্তিক ও জাতীয় দলের টুর্নামেন্ট খেলার ফলে সিনিয়র পর্যায়ে এসে চ্যাম্পিয়ন হয়েছে। সাগরিকা, আফিদারাও ভালো খেলোয়াড়, আমি মোটামুটি ওদের ছোট থেকে দেখছি, কিন্তু ওদের তো সময় দিতে হবে। ছয় বছর পর দেখবেন এরাও প্রস্তুত হয়েছে সাফল্য পাওয়ার জন্য।
আপনি কি তাহলে মনে করছেন, বর্তমান দল মুকুট ধরে রাখার পর্যায়ে পৌঁছায়নি?
গোলাম রব্বানী: দেখুন, ২০১৬ সালে মারিয়া, মনিকা, শামসুন্নাহার (জুনিয়র) এদের বয়স ১৪ বছর, তখন আমরা শিলিগুড়িতে রানার্সআপ হয়েছিলাম, এরপর নেপালের বিরাটনগরে গিয়ে সেমি-ফাইনাল থেকে বিদায় নিয়েছি, চ্যাম্পিয়ন হয়েছি ২০২২ সালে এসে। বর্তমান দলের নতুনরা প্রতিভাবান, এ নিয়ে সন্দেহ নেই, কিন্তু এরা শিরোপা জয়ের জন্য প্রস্তুত কিনা, সেটা ভাবনার বিষয়।
আরেকটা বিষয়, ভারত গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড় ফিরিয়ে এনেছে, চোটের কারণে গত আসরে পুরোটা খেলতে পারেনি সাবিত্রা ভান্ডারি, নেপাল তাকেও ফিরিয়েছে। অভিজ্ঞতার একটা মূল্য আছে বলেই ভারত, নেপাল এই সিদ্ধান্তগুলো নিয়েছে, যেটা আমরা পারিনি। নতুনদের প্রতিভা আছে, এ নিয়ে সন্দেহ নেই, কিন্তু অভিজ্ঞতা কম, এটাও মানতে হবে।
সাফজয়ী দলের অভিজ্ঞদের অনেকেই তো আছে বর্তমান দলে, মাসুরা পারভীন, সাবিনা খাতুন, কৃষ্ণা রানী সরকার, এমন আরও অনেকে…
গোলাম রব্বানী: কৃষ্ণার ব্যথা, আরও আগে ওর চিকিৎসার উদ্যোগ নেওয়ার দরকার ছিল। যদি ছয় মাস আগে চিকিৎসা করা হতো, তাহলে তো সে অনেক আগেই ফিট হয়ে যেত, কিন্তু সে গেলই শেষ মুহূর্তে। এখন তার পজিশন নিয়েই টানাটানি। আপনি চিন্তা করতে পারেন, কৃষ্ণার গতবারের পারফরম্যান্স, ভূমিকা, আঁখির ভূমিকা কেমন ছিল? সবাই বলে দল ঠিক আছে, আমি ফুটবল বেশি বুঝি না, কিন্তু কেন তারা বলে সব ঠিক আছে, সেটা আমি বুঝি না। আদৌও এই দল নিজেদের সেরাটা দিতে পারবে কিনা, তা নিয়ে আমার সন্দেহ আছে। পেপ গুয়ার্দিওলা দায়িত্ব নিলেও পারবে কিনা… বড় মুখে কথাটা বলে দিলাম।
মেয়েরা কি যোগাযোগ করে? তাদের সাথে কী এবারের সাফ মিশন নিয়ে আলাপ হয়েছে?
গোলাম রব্বানী: সবসময়ই যোগাযোগ করে, যখন কোনো সমস্যায় পড়ে, স্ট্রাগল করে, তখনই ফোন দেয়। আমিও নানা পরামর্শ দেই। এটা-ওটা করতে বলি। যেমন আঁখি নেই, স্বপ্না নেই, তাদের জায়গাগুলো কীভাবে পূরণ করতে হবে, সে বিষয়ে পরামর্শ দেই, কিন্তু মাঠে সেটার প্রয়োগ সেভাবে দেখতে পাচ্ছি না।
প্রস্তুতি নিয়ে আপনার মতো আরও অনেকের উষ্মা আছে। কিন্তু তারা আশাবাদী, আপনি তাদের মতো আশাবাদী হতে পারছেন না কেন?
গোলাম রব্বানী: দল হিসেবে আমাদের চেয়ে ভারত ও নেপাল শক্তিশালী দল এবং এটা মানতে হবে, তারা আমাদের চেয়ে ভালো প্রস্তুতি নিয়েছে। গতবার আমরা অসাধারণ খেলেছিলাম বলেই তাদের হারাতে পেরেছিলাম। অথচ, আমরা ডিফেন্ডিং চ্যাম্পিয়ন হয়েও এবার সেভাবে প্রস্তুতি নিতে পারিনি। স্বাভাবিকভাবেই শঙ্কাটা এসে যায়। বর্তমান দলেও ভালো পারফরমার আছে। আমিও আশাবাদী। অভিজ্ঞদের সাথে নতুনদের বোঝাপড়া যদি ঠিকঠাক হয়, তারা যদি সেরাটা দিতে পারে, আর যদি আল্লাহ রহমত করে, তাহলে ভালো কিছু হবে।