পুরান ঢাকায় কেবল কুট্টি নয়, সুখবাস বলে বলার আরেকটি ভাষাভঙ্গি আছে। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার বিস্তার, মানুষের স্থানান্তরসহ নানা চাপে দুটিই বিলোপের পথে।
Published : 21 Feb 2024, 11:23 AM
‘আব্বে কয় কী?’- পুরান ঢাকার অলিগলিতে এখন আর ‘ঢাকাই টানে’ এমন বাক্য শোনা যাওয়ার নিশ্চয়তা দেওয়া যাবে না।
দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে পুরান ঢাকায় আবাস গড়া, তাদের সঙ্গে মিথস্ক্রিয়ায় ভাষায় বিবর্তন, ‘ঢাকাইদের’ রাজধানীর অন্য অংশে ছড়িয়ে পড়া ইত্যাদি নানা ঘটনায় ‘ঢাকাই বাংলার’ ব্যবহার কমছে। আরেক কারণ হল, স্কুলে যাওয়ার পর শিশু কিশোরদের মধ্যে ‘প্রমিত বাংলা’র চর্চা।
দূর থেকে মানুষ ভাবে পুরান ঢাকায় বলার ভঙ্গি মানেই বুঝি ‘কুট্টি’। তবে সেখানে আরো একটি গোষ্ঠী, যারা কথা বলে সোব্বাস ভাষায়, নিজেদের বলে সোব্বাসী।
এই সোব্বাস শব্দটি এসেছে সুখবাস থেকে। সোব্বাস ঢাকাইরা 'সুখ'কে বলে 'সোখ'। সুখে বাস করে বলে তাদের সুখবাস বলা হয়। সুখবাস থেকে সোখবাস, আর তা থেকে সোব্বাস।
ফটো সাংবাদিক পাভেল আহমেদের জন্ম, বেড়ে উঠা, সবই পুরান ঢাকায়। সুখবাসী বা সোব্বাসী হলেও তিনি আর সে ভাষা চর্চা করেন না।
গবেষক ও আদি ঢাকাইরা বলছেন, মোঘলরা ঢাকায় আসার সময় ভারতের বিভিন্ন প্রদেশ থেকে লোকজন নিয়ে আসেন। তারা তখন স্থানীয়দের সঙ্গে মিশতে উর্দু, ফার্সি, হিন্দি এমন বেশ কিছু ভাষার মিশ্রণে নতুন এক কথার ভঙ্গির প্রচলন করেন যেটি ‘সুখবাস’ হিসেবে পরিচিত। পরে সেই ভাষায় বাংলা ও ইংরেজি শব্দও ঢুকে পড়ে।
পুরান ঢাকায় যে ভাষাভঙ্গি বাইরের সমাজে বেশি পরিচিত, তাকে বলে ‘কুট্টি’। এর উদ্ভব ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসনামলে।
১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধের পর বাংলায় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির প্রভাব এবং পরে শাসনভার গ্রহণ করার পর বেশ কয়েকটি দুর্ভিক্ষ হয়। এরপর বৃহত্তর ঢাকা, কুমিল্লা, ময়মনসিংহ, ফরিদপুর ও বরিশাল থেকে ঢাকামুখী স্রোত তৈরি হয়।
তারা ঢাকার প্রচলিত পেশায় নিজেদের খাপ খাওয়াতে না পেরে তারা ধান কুটার পেশাকে বেছে নেয়। সে থেকে ‘কুট্টি’ নামে নতুন গোষ্ঠী তৈরি হয়। ‘সুখবাস’ এর তুলনায় তাদের বলার ভঙ্গি কিছুটা আলাদা।
পুরান ঢাকায় বহু বছর ধরেই একই সঙ্গে ‘সোব্বাস’ ও ‘কুট্টি’রা চলে আসছে। আর এখন সময়ের সঙ্গে দুটি ধারাই বিলুপ্তির পথে।
ঢাকা বিষয়ক গবেষক শায়লা পারভীন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “হয়ত ২০ বছর পরে এ রকম করে আর কেউ কথা বলবে না।”
এই ভাষাভঙ্গির টিকে থাকার সম্ভাবনা দেখছেন না পুরান ঢাকা বিষয়ক আরেক গবেষক হাশেম সূফীও।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “লিখিত স্ক্রিপ্ট যখন নাই তখন আর সম্ভব না। মুখে মুখে যতদিন থাকে, সেভাবে আর সম্ভব না।”
কেন বিলুপ্তির পথে
ঢাকায় বিভিন্ন এলাকার মানুষদের সঙ্গে যোগাযোগ, বিয়ে আর প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার কারণে পুরান ঢাকার ভাষার কথ্য রূপের দুটি ধারার চর্চাই কমে যাচ্ছে। সেখানেও প্রমিত, কুট্টি বা সোব্বাসের মিশ্রণে নতুন এক ধাঁচে কথা বলে মানুষ। আর স্কুলগামী শিশু-কিশোররা প্রমিত বাংলাই বেশি ব্যবহার করছে।
এক সময় সুখবাসী বা কুট্টিরা বিয়ের সম্পর্ক নিজেদের মধ্যেই সীমিত রাখত। এখন আর সে দিন নেই। ছেলে মেয়েরা বড় হয়ে বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল কলেজে পড়াশোনা করছে, দূরের কোথাও ব্যবসা করছে, নতুন নতুন মানুষের সঙ্গে সম্পর্ক হচ্ছে, বিয়েও হচ্ছে দূর দূরান্তে।
সেই পরিবারে যে সন্তানের জন্ম হচ্ছে, তারা হয়ত পুরান ঢাকার সুর শুনে বড়ই হচ্ছে না। এটিও ভাষার হারিয়ে যাওয়ার অন্যতম এক কারণ।
সূত্রাপুরের কলতাবাজার এলাকায় দোকানে কাপড় ইস্ত্রি করছিলেন ৭২ বছর বয়সী নূরুল হক। নিজেকে তিনি সুখবাসী হিসেবে পরিচয় দেন।
তিনি বলছিলেন, তাদের মত প্রবীণরা ছাড়া কেউ আর এসব ভাষায় কথা বলে না। জানালেন, সুখবাস কেবল নিজেদের মধ্যে বলেন। অন্যদের সঙ্গে কথা বলার সময় সেটি ব্যবহার করেন না।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে নুরুল হক বলেন, “বাঙালি ভাষা শিখে গেছে গা অনেকে। আমি ঢাকাই, বিয়ে করছি ঝালকাঠি, বাচ্চারা গ্রামের ভাষা পাইছে। আমাদের সুখবাসে কুট্টি ভাষাও মিইল্যা গেছে গা অনেক, তো হারায় যাইব না তো কী হইব?”
রোকনপুরের পাঁচভাই ঘাট লেনের প্রবীণ নাগরিক মো. শহীদুল্লাহ জানালেন, বিভিন্ন এলাকার মানুষের সমাগমের ফলে তাদের সঙ্গে মিশতে হচ্ছে ঢাকাইদের। ফলে চেনা সংস্কৃতি, ভাষা, চলাফেরা সবই বদলে যাচ্ছে।
“দুই জন বন্ধু যদি হয় ঢাকার, ১০ জন তো ঢাকার বাইরের। এসব কারণে আমাদের ঘরের ভাষাও বদলে যাচ্ছে। আমার ছেলের সঙ্গে কথা বললে বুঝতে পারবেন না সে ঢাকাইয়া। আমার নাতিদের কাছে ঢাকাই অচেনা ভাষা। কারণ, তার সঙ্গে আমরা সে আচরণ করি না।”
তিনি মনে করেন, ঢাকাই বাংলা পরিস্থিতির শিকার হচ্ছে। তাদের প্রজন্ম পর্যন্ত ‘জীবন যুদ্ধে’ চলতে অন্যদের সাথে মিশতে হয়নি, তাই টিকে ছিল নিজস্বতা।
এখন এ ভাষার চর্চা চালাতে গিয়ে যে নানা ধরনের বিড়ম্বনায় পড়তে হয়, সে কথাও বলেন তিনি।
“আমার সন্তানরা বলে, ‘বাবা এভাবে কথা বলো না, এভাবে বলা ঠিক হবে না’, তখন শুদ্ধ ভাষায় কথা বলার চেষ্টা করতে হয়। এভাবে মিশ্রণটা আরো হয়ে যাচ্ছে।”
শহীদুল্লাহ ৩৫ বছর আগে বিয়ে করেছেন এক সুখবাসী নারীকে। দীর্ঘদিন ধরে বাঙালি পরিবারে চলতে চলতে তার ভাষাতেও অনেক বাংলা শব্দ ঢুকে গেছে।
“আমার শ্বশুর এলে তারা তাদের ভাষায় কথা বলে। আর আমাদের সঙ্গে বাংলাতেই কথা বলে। দীর্ঘদিন সুখবাসীদের সাথে চলেও আমাদের স্বকীয়তা বজায় ছিল। এখন এই ভাষায় কথা বলার পরিসর অনেক কমে গেছে।”
কলতাবাজার গ্রিন গার্ডেন এলাকায় একদল ঢাকাইয়া কুট্টিকে বসে গল্প করতে দেখা গেল। তারা বলেন, সারাদিনের কাজ শেষে তারা এসে এখানে বসেন আর ছুটির দিন গল্প চলে দিনভর। সব জায়গায় নিজের ভাষায় কথা বলতে না পারায় তাদের এ আয়োজন।
ব্যবসায়ী জহির উদ্দিন বলেন, “স্কুল-কলেজে এ ভাষায় কথা বললে বাধা দেয়, শুদ্ধ ভাষায় বলতে বলে। আমরা চাই আমাদের ছেলে-মেয়েরাও এ ভাষায় কথা বলুক। তাদের এভাবে কথা বলতে বলি। পুরান ঢাকার ঐতিহ্য যে ভাষাটা, এটা টিকে থাকুক।”
বংশালের কসাইটুলি গলির বাসিন্দা মো. গিয়াসউদ্দিন জানালেন, ‘সভ্য সমাজে’ এই ভঙ্গিতে কথা বললে হাসি-ঠাট্টার শিকার হতে হয়; ফলে জেনেও অনেকে বলতে চান না।
“কম ব্যবহারের কারণে অনেক শব্দ বিলুপ্ত হয়ে গেছে। আমাদের ছেলেমেয়েরা এ ধরনের ভাষা বলতে পারে না,” বলেন তিনি।
গবেষক হাশেম সূফী বলেন, “সুখবাস ও কুট্টি, দুটোই এখন নিশ্চিহ্ন প্রায়। সব জেলার মানুষ আসছে, তারা বিভিন্ন পেশায় জড়িয়ে পড়ছে ফলে ভাষা পাল্টে যাচ্ছে।”
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাষাবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ফিরোজা ইয়াসমীন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেছেন, পুরান ঢাকার দুই জনগোষ্ঠীই সব জায়গায় প্রমিত ভাষার সংস্পর্শে আসছেন। ঘরোয়া পরিবেশ ছাড়া নিজেদের ‘ভাষা’ অনুশীলন করার সুযোগ তাদের নেই।
এক সময় সুখবাসীরা আরো বেশি ‘বাংলা ঘেঁষা’ হয়ে যাবে বলেও মনে করেন তিনি। বলেন, “দেখা যাবে সুখবাস একেবারেই বাংলার একটা ‘উপভাষা’ হয়ে দাঁড়াবে। যখন সংখ্যাগরিষ্ঠ ভাষা সম্প্রদায় আর সংখ্যালঘু ভাষা সম্প্রদায় পাশাপাশি থাকে তখন স্বাভাবিকভাবেই সংখ্যাগরিষ্ঠের ভাষাটা সংখ্যালঘু ভাষাগোষ্ঠীকে প্রভাবিত করে।”
বর্তমানে যোগাযোগ ব্যবস্থা সহজ হওয়াকেও পরিবর্তনের কারণ হিসেবে দেখছেন ফিরোজা ইয়াসমীন।
“ফলে অন্য ভাষার সঙ্গে ভাব বিনিময় অনেক বেড়ে গেছে। এটাও আগের চেয়ে পরিবর্তনে দ্রুত প্রভাব ফেলছে, সব ভাষার ক্ষেত্রেই।”
‘আমরাই শেষ প্রজন্ম যারা ঢাকাই বলি’
বর্তমানে যারা ঢাকাই ভাষার চর্চা চালিয়ে যাচ্ছেন তারা বলছেন, তারাই শেষ প্রজন্ম যারা ঢাকার নিজস্ব ভঙ্গিতে কথা বলছেন।
কসাইটুলিতে দেখা গেল সুখবাসী আকিল আহমেদকে। তিনি বলেন, “আমি বিয়ে করেছি গ্রামের মেয়েকে। তার সাথে, রাস্তায় দোকানির সাথে বাংলাতেই বলতে হয়। বাংলা ধরতে ধরতে এখন আমরা বাংলাতেই বলি। আমার সন্তানরা সুখবাস বোঝে না।”
সন্তানদের নিজের ভাষা শেখাতে চেষ্টার কমতিও করেননি তিনি, কিন্তু তারা এ ভাষা গ্রহণ করেনি; বলেন তিনি।
“প্রথমে তাদের মাদ্রাসায় দিয়েছিলাম। কিছু দিন পড়ে চলে আসছে। পরে বাধ্য হয়ে স্কুলে দিতে হইছে। আমাদের সময়ে স্কুলে ভর্তি হত কম। আমরা অনেক পরে স্কুলে যেতাম। তাই আমাদের মধ্যে সেটার প্রচলন ছিল।”
নবাব বাড়ির সদস্য খাঁজা শাহেদ রহমানকেও পাওয়া গেল সেখানে। তিনি বলেন, “সমাজের সাথে মিশতে গিয়ে নতুন প্রজন্মের বাংলা ভাষা আয়ত্ত করতে হচ্ছে।
“পরিবারে পুরোপুরি সুখবাসেই কথা বলি। নতুন প্রজন্মের যারা তাদের সাথে বাংলা বলি।”
কলতাবাজারের বাসিন্দা ফিরোজ আহমেদ শাহীন জানালেন, নতুন প্রজন্ম আর কুট্টিতে কথা বলতে চায় না। তবে যুগের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে ছেলে-মেয়েরা প্রমিত ভাষা শিখুক, সেটাও চান তিনি।
“পোলাপান শুদ্ধভাষায় কথা বলে। আমরাও চাই তারা ভদ্রভাবে কথা বলুক। আমরাই হয়ত শেষ প্রজন্ম যারা ঢাকাই বলতে পারছি কিছুটা।”
আকিল আহমেদ বলেন, “আমাদের একটা ঐতিহ্য ছিল ভাষাটা। নাই হয়ে যাইতেছে; খারাপ লাগা কাজ করে অনেক।”
বেগম বাজারের কে আজম লেনের একটি দালানের নিচতলায় ক্যারাম খেলতে দেখা গেল একদল তরুণকে।
তারা সুখবাসী হলেও ধীরে ধীরে বাংলায় অভ্যস্থ হওয়ার কথা বললেন ব্যবসায়ী মো. রাসেল। তিনি বলেন, “মূল ভাষা যেটা, সেটা আমরা ব্যবহার করি না। বাংলাতেই কথা বলি। দেখা গেল একটা অফিসে গেলাম, সেখানে তো আর সুখবাসে কথা বলতে পারি না। কেউ বুঝবে না। যেখানে যে ভাষার দরকার সেখানে সে ভাষাতেই কথা বলি।”
‘আমরা পারি না ঢাকাই ভাষা’
ধোলাইখালের গলিতে পাওয়া যায় সেন্ট গ্রেগরি স্কুলের নবম শ্রেণি পড়ুয়া মো. শাহরিয়ারকে। এই কিশোর বংশ পরম্পরায় এখানকার বাসিন্দা হলেও সে জানে না সে কুট্টি নাকি সুখবাসী।
“বাবা-মা দুজনই ঢাকাইয়া হলেও স্কুলে শুদ্ধ ভাষায় কথা বলা হয়৷ বাসাতেও সে ভাষাই শিখানো হচ্ছে৷ যেটা বেশি শোনা হয় সেটাই বলি, তাই ওই ভাষাটা পারি না। পরিবারের মুরব্বিদেরও পাইনি আমি।”
নারিন্দার বাসিন্দা পাভেল আহমেদ বলেন, তার পূর্বপুরুষরা সুখবাসে কথা বলতেন কিন্তু তার প্রজন্ম থেকে আর কেউ ওই ভাষায় কথা বলতে পারে না।
মা ঢাকার বাইরের বাসিন্দা হওয়ায় আর বাবা রাজনীতি করতেন বলে এ প্রভাব পড়েছে, জানান তিনি।
“আমি তো আমার মায়ের ভাষায় কথা বলেছি। একটা লাইন সুখবাসই পারি আমি। যেসব আত্মীয়রা পারে তারা যখন নিজেরা কথা বলে, তখন চুপ করে বসে থাকি। কিচ্ছু বুঝি না।”
স্থানান্তরিত হচ্ছে ঢাকাইরা
পুরান ঢাকার বাসিন্দারা বলছেন, ঢাকাই উপভাষার দুটো ধারার মানুষই গত দুই যুগ ধরে পুরান ঢাকা ছাড়ছেন। ভাষার সংকট তৈরির পেছনে এটাকেও কারণ হিসেবে দেখছেন তারা।
আদি ঢাকাইদের পুরান ঢাকা ছাড়ার কারণ সম্পত্তির ভাগাভাগি। একটা দালান দীর্ঘদিন ধরে ভাগ হতে হতে এখন আর খাট ফেলার জায়গা থাকছে না, ফলে এলাকা ছেড়ে কেউ ঢাকার অন্য অংশে যাচ্ছে। কেউ আবার বসতি গড়ছে কেরাণীগঞ্জ ও নারায়ণগঞ্জের দিকে।
কুট্টি ব্যবসায়ী জহির উদ্দিন বলেন, “এখন এখানে বরিশাল আর বিক্রমপুর এলাকার মানুষ বাড়ছে। সংখ্যায় তারা বেশি হওয়ায় ভাষাটাও তাদের দিকে মিশ্রণ হচ্ছে। সেদিকে মানুষের আকর্ষণ বেশি হবে এটাই স্বাভাবিক, কারণ তারা সংখ্যায় বেশি।”
সুখবাসী আকিল আহমেদ বলেন, “এত প্রজন্ম ধরে শরিক বাড়তে বাড়তে জায়গার সংকট তৈরি হয়েছে, এসব কারণে চলতে পারে না। তাই বাড়ি বিক্রি করে অনেকে কেরাণীগঞ্জ চলে গেছে। এটাও ভাষা নাই হয়ে যাওয়ার একটা কারণ।”
রায়সাহেব বাজারে দেখা মিলল ব্যবসায়ী মো. ইলিয়াসের। তিনি ধোলাইখালের বাসিন্দা। মাস ছয়েক পরই পুরান ঢাকা ছেড়ে উত্তরায় স্থায়ী হওয়ার কথা রয়েছে তার।
এই ঢাকাইয়া কুট্টি বলেন, “আমার ওখানেও বাড়ি আছে। ওইদিকে আধুনিকতার ছোঁয়া আছে। এদিকে ঘিঞ্জি এলাকা এসব কারণে চলে যাব।”
এখন তিনি আর ঢাকাইয়া কুট্টিতে কথা বলেন না। তার সন্তানরা জানেই না সেই বলার ভঙ্গি।
“আমার ভাইয়েরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছে, তাদের ছেলেমেয়েরা আমেরিকায় থাকে, তারা তো এখন আরও এ ভাষায় কথা বলে না। যার শিক্ষা আছে, তার পরিবেশই আলাদা। খুব কম মানুষ আছে যারা এ ভাষায় কথা বলে এখন।”
উর্দু ছেড়ে বাংলায় ফেরা
সাতরওজার আবুল হাসনাত রোডের শাহজাহান মিয়ার গলির বাসিন্দারা বলছেন, পাকিস্তান আমলে তাদের পূর্বপুরুষদের উর্দু রপ্ত করতে হয়েছিল তাদের। ফলে উর্দু তাদের দৈনন্দিন চর্চার ভাষাও হয়ে উঠে। তবে স্বাধীনতার পর নতুন প্রজন্ম ফিরে আসে বাংলায়।
আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর ভাষার গান ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’ বাংলা ভাষায় ফেরার ক্ষেত্রে তাদের সহায়ক হয়েছিল, বলছিলেন তারা।
ব্যবসায়ী নূর হোসেন বলেন, “তারা (পূর্ব পুরুষ) তখন উর্দু বলত। আমরা জানলেও বলি না। আমাদের মাতৃভাষা বাংলা। যখন শুনি ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’ তখন আমাদের লোম খাঁড়ায় যায়। বাংলা বলতে ইচ্ছে করে।”
এই এলাকার অনেকেই উর্দু জানলেও নিজেদের মধ্যে এখন বাংলাই বলছে, বলেন তিনি।
বেসরকারি চাকরিজীবী মো. নাদিম বলেন, “আমরা উর্দু পারি, কিন্তু বলতে খারাপ লাগে। আমরা বাংলাদেশের মানুষ, বাঙালি, এটাই আমাদের বড় পরিচয়। এ এলাকার সবাই এখন বাংলায় ফিরে আসছে।”
টিকিয়ে রাখার কী উপায়
গবেষক শায়লা মনে করেন, মানুষের ভাষা থেকে তাদের নৃতাত্ত্বিক পরিচয় বের করা যায়; ফলে আঞ্চলিক ভাষাগুলোকে টিকিয়ে রাখার চেষ্টা জরুরি।
কিন্তু উপায় কী?- সে প্রশ্নে তিনি বলেন, “বিভিন্ন অঞ্চলে আঞ্চলিক ভাষা পরিষদ বা কমিটি হওয়া উচিত, যারা সচেতনতা তৈরি করবে। নতুন প্রজন্ম ইংরেজি শিখুক, কিন্তু তাকে বাংলা বলতে হবেই। পাশাপাশি যার যার আঞ্চলিক ভাষা বাচ্চাদের সাথে ঘরে অনুশীলন করা।”