আগে যেখানে প্রতিজন রোহিঙ্গা বিশ্ব খাদ্য সংস্থা থেকে মাসে সাড়ে ১২ ডলার পেতেন, সেটা এখন হবে মাত্র ৬ ডলার।
Published : 13 Mar 2025, 01:37 AM
রাখাইন রাজ্যের মোহাম্মদ করিম আট বছর আগে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর নির্যাতন-হত্যা-হামলার মুখে বাস্তুচ্যুত হয়ে পরিবার নিয়ে আশ্রয় নিয়েছিলেন বঙ্গোপসাগরের উপকূলবর্তী কক্সবাজারের উখিয়ার আশ্রয়শিবিরে। শূন্য হাতে শরণার্থী হওয়া করিম ও তার পরিবারের জীবন তখন থেকেই রেশননির্ভর।
চরম দারিদ্র্য, নিজ গোষ্ঠীর মানুষদের অপরাধপ্রবণতা, মাদক ব্যবসার ছড়াছড়ি, অন্ধকার জগতের চোরাটান, আর ভবিষ্যতের অনিশ্চয়তা নিয়েও আশ্রয়শিবিরের ‘পরনির্ভর’ জীবন কোনোরকমে খেয়ে-পড়ে বেঁচে থাকার মত ছিল।
কিন্তু সম্প্রতি জাতিসংঘ ঘোষণা দিয়েছে, যে সামান্য খাদ্য সহায়তা রোহিঙ্গাদের দেওয়া হয়; সেটিও অর্ধেকের বেশি কমিয়ে দেওয়া হবে এপ্রিল মাস থেকে। আগে যেখানে একজন রোহিঙ্গা বিশ্ব খাদ্য সংস্থা থেকে সাড়ে ১২ ডলার পেতেন, সেটা কমে হবে ছয় ডলার।
রোহিঙ্গাদের যেখানে কাজ ও ব্যবসার কোনো সুযোগ নেই; সেখানে মাত্র সাড়ে ৭৫০ টাকা দিয়ে একজন মানুষ কীভাবে মাস পার করতে পারবে- সেই দুঃশ্চিন্তাই প্রতিনিয়ত কুড়েকুড়ে খাচ্ছে উখিয়ার রোহিঙ্গা আশ্রয়শিবিরের ২ নম্বর ক্যাম্পের ইস্ট ৯ ই ব্লকের সাত সদস্যের পরিবারের কর্তা করিমকে।
হতাশার সুরে তিনি বলছিলেন, “রিজিকের মালিক আল্লাহ। আল্লাহর দিকে তাকিয়ে আছি। জানি না এক মাস পর আমাদের কী হবে?”
এই দুশ্চিন্তা কেবল মোহাম্মদ করিমের না; ক্যাম্পে আশ্রিত ১১ লাখের বেশি রোহিঙ্গার।
বরাদ্দ কমানোর খবরে উদ্বেগ প্রকাশ করে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, রোহিঙ্গারা এমনিতেই মানবেতর জীবনযাপন করে। দারিদ্র্যের সুযোগ নিয়ে তাদের অন্ধকার জগতের দিকে টেনে নেওয়ার চেষ্টা করে উগ্রপন্থি আর অপরাধীচক্র। বরাদ্দ কমায় সেই জীবন এখন ‘অস্তিত্ব সংকটের’ মুখে পড়বে। রোহিঙ্গাদের মধ্যে ঝুঁকি নেওয়ার ঝোঁক বাড়বে; অন্য অনেক সমস্যার পাশাপাশি অপরাধও বাড়বে।
শরণার্থীদের বিষয়টি সরকারের পক্ষ থেকে দেখভাল করে বাংলাদেশের শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনারের কার্যালয়।
কমিশনের অতিরিক্ত কমিশনার সামসুদ্দৌজা নয়ন বলছিলেন, “খাদ্য সহায়তা অর্ধেকে নামিয়ে আনার এই সিদ্ধান্ত রোহিঙ্গা ক্যাম্পে বড় ধরনের প্রভাব ফেলবে। আশ্রিতরা তাদের মৌলিক চাহিদা পূরণের জন্য অপরাধে জড়িয়ে পড়তে পারে।”
এতে করে রোহিঙ্গা অধ্যুষিত অঞ্চলে আইন-শৃঙ্খলা অবনতির আশঙ্কাও প্রকাশ করলেন নয়ন।
‘না খেয়ে থাকতে হবে’
জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি-ডব্লিউএফপি শুক্রবার এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলেছে, অর্থায়নের অভাবে রোহিঙ্গা শরণার্থীর খাদ্য সহায়তা হুমকির মুখে পড়েছে। জরুরি নতুন তহবিল পাওয়া না গেলে শরণার্থীদের মাসিক রেশন অর্ধেকে নামিয়ে আনতে হবে।
রোহিঙ্গারা আশ্রয় শিবিরের বাইরে চলাফেরার স্বাধীনতা পান না; রোজগারের সুযোগও নেই। তাই রেশন আরও কমানো হলে তাদের নিরাপত্তা ও সুরক্ষা ঝুঁকি আরও বেড়ে যাবে। বিশেষ করে নারী ও শিশুরা পাচার, গার্হস্থ্য সহিংসতা এবং শোষণের উচ্চ ঝুঁকির মুখে পড়তে পারে। শিশুশ্রম ও বাল্যবিবাহের হারও বাড়তে পারে, কারণ বেঁচে থাকার তাগিদে পরিবারগুলো কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হবে বলে মনে করে ডব্লিউএফপি।
উখিয়া ক্যাম্পের বাসিন্দা মোহাম্মদ করিম জানাচ্ছিলেন, গেল মাসে ডব্লিউএফপি থেকে মাথাপিছু তারা পেয়েছেন এক হাজার ৫১২ টাকা করে। এ টাকার সমপরিমাণ নিত্যপণ্য তাদের কিনতে হয় নির্দিষ্ট দোকান থেকে।
এই টাকা দিয়ে করিম মাথাপিছু ১৩ কেজি চাল, এক লিটার তেল, ৫০০ গ্রাম পেঁয়াজ, ২৫০ গ্রাম করে রসুন ও মরিচ, এক কেজি ডাল, এক কেজি চিনি, পাঁচটি ডিম এবং এক প্যাকেট ময়দা কিনতে পারতেন এতদিন।
সেখান থেকে পরিবারের প্রয়োজনের অতিরিক্ত তেল, চিনি, ময়দা তিনি বাইরে বিক্রি করে দিতেন। এর বিনিময়ে যে টাকা পেতেন, তা দিয়ে শুঁটকি এবং তেলাপিয়া, পাঙ্গাসের মত কম দামি মাছ কিনতে পারতেন৷ মাংস শেষ কবে কিনেছিলেন তা মনে করতে পারেন না করিম।
উখিয়া ২১ নম্বর ক্যাম্পের ব্লক ডি-১ এর বাসিন্দা সোলাইমানের পরিবারের সদস্য সংখ্যা চার। মা বৃদ্ধ হওয়ায় অতিরিক্ত সাড়ে ৩০০ টাকা পান। কিন্তু পরিবারের সদস্য সংখ্যা কম হওয়ায় যে পরিমাণ রেশন পান তা দিয়েও চলে না।
ক্যাম্পের জীবন ছেড়ে 'জন্মভূমি উদ্ধারের যুদ্ধে' রোহিঙ্গারা
রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ক্ষুদ্র ব্যবসা চালুর প্রস্তাব ইইউর
ক্রসফায়ারের 'লীলাভূমি' থেকে অপহরণের 'স্বর্গরাজ্য'
সে কারণে ক্যাম্পের বাইরে গিয়ে কাজ করতেন সোলাইমান, যদিও তার নিয়ম নেই। রোহিঙ্গা হওয়ায় সব সময় কাজ পাওয়া যায় না। বেশিরভাগ সময় প্রতিবেশীদের কাছ থেকে ধারদেনা করে সংসার চালাতে হয়।
সোলাইমান বলেন, “এখনই এই অবস্থা, সেখানে যদি রেশন অর্ধেক করে দেয় না খেয়ে থাকতে হবে। নিজ দেশে সহায়-সম্পত্তি সব আছে। অথচ, এখানে ভিক্ষার জীবন চলছে।”
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম বিভিন্ন আশ্রয়শিবিরের ১০-১২টি পরিবারের সঙ্গে কথা বলেছে; তাদের প্রত্যেকেই সামনের দিনগুলোর অনিশ্চয়তার কথা বলছিলেন।
রেশন কমে যাওয়ায় চিন্তিত বাংলাদেশ ত্রাণ ও শরণার্থী প্রত্যাবাসন কমিশনও। এ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন হলে রোহিঙ্গাদের নির্দিষ্ট ব্যবস্থাপনার মধ্যে রাখা কঠিন হয়ে পড়বে বলে মনে করছেন কমিশনের কর্মকর্তারা।
শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মিজানুর রহমান বলেন, “দাতাদের অনুরোধ করছি তহবিল সংগ্রহ করার ক্ষেত্রে ভূমিকা নেওয়ার জন্য। আমরা আশা করছি, জাতিসংঘ সহায়তা অর্ধেক করার বিষয়টি তারা উইথড্র করবেন।”
‘অপরাধীদের মনোযোগ বাড়বে’
এমনিতেই কক্সবাজারের মিয়ানমার সংলগ্ন এই উপকূলবর্তী অঞ্চল মাদক কারবারিদের স্বর্গরাজ্যে পরিণত হয়েছে। সম্প্রতি সেখানে বেড়েছে অপহরণের ঘটনা। এ দুটি অপরাধের সঙ্গেই রোহিঙ্গাদের জড়িত থাকার কথা নানা সময়ে বলে আসছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।
এখন সহায়তা কমলে সেটা ‘নিরাপত্তায় হুমকি’ তৈরি করতে পারে বলে শঙ্কা প্রকাশ করছেন পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) মোহাম্মদ নুরুল হুদা।
তিনি বলেন, রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর মধ্যে একটি উল্লেখযোগ্য অংশ অল্প বয়সী। এখানে আসার পরও অনেক শিশুর জন্ম হয়েছে।
“যারা ২০১৭ সালে আসছে, তারা তো অলরেডি, আট বছরে আসলে ষোল বছর হয়ে গেছে। তো এইরকম তরুণ লোকদের যদি কাজকর্ম না থাকে, সাধারণত চরমপন্থি গ্রুপগুলো তাদেরকে রিক্রুট করতে পারে। এলাকার মধ্যেও অপরাধে জড়িয়ে পড়তে পারে। এটার একটা নিরাপত্তা হুমকি আছে।”
একই শঙ্কা প্রকাশ করেছেন সাবেক রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন কবিরও। তিনি বলেন, “যদি ক্যাম্পে ইন্টারন্যাশনাল ফান্ড কমে যায়, ন্যাচারালি যেটা হয়, এটার প্রতিক্রিয়া হিসেবে আসতে পারে। এবং অন্যভাবে মানি আর্নিং বা জীবন-জীবিকার জন্য চেষ্টা করতে পারে। করবেই এমন তো কোনো কথা নেই; তবে আশঙ্কা তো থাকবেই।”
তবে পরিস্থিতির স্থায়ী সমাধানে তহবিল বাড়ানোর পাশাপাশি রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনে সরকারের কূটনৈতিক তৎপরতা বাড়ানোর পরামর্শ দেন তিনি।
সহায়তা কমে যাওয়ায় আইন-শৃঙ্খলা বিঘ্ন ঘটার বিষয়টি নিয়ে আশঙ্কা প্রকাশ করেছে ক্যাম্পের নিরাপত্তায় নিয়োজিত আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন-এপিবিএন।
পুলিশের এই বাহিনীর অতিরিক্ত ডিআইজি মো. সিরাজ আমীন বলেন, “রোহিঙ্গাদের অনেকেই এমনিতে অপরাধে জড়িত। যেহেতু খাদ্য সহায়তা কমবে তাই এরা অপরাধ বাড়ানোর চেষ্টা করবে। অতীতেও এ ধরনের সহায়তা কমে এসছিল, তখনও কিছুটা বেড়েছিল অপরাধ, তবে আমরা আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নিয়েছিলাম।”
নিবন্ধনের বাইরেও অনেক রোহিঙ্গা রয়েছে জানিয়ে সিরাজ আমীন বলেন, “এদের তো অন্য কোনো কর্মসংস্থান নেই, তারা শুধু নির্ভর করে এই রেশনের উপর। তাই তাদেরও অসুবিধা হবে, খারাপ পরিস্থিতিতে পড়বে। মানবেতর জীবনযাপন করবে। তাই সুযোগ পেলেই অপরাধেও জড়িয়ে যাবে।”
নারী-শিশুরা পুষ্টিহীনতায় পড়বে
এর আগে ২০২৩ সালেও তীব্র অর্থায়ন সংকটের কারণে ডব্লিউএফপি রোহিঙ্গাদের মাসিক রেশন ১২ ডলার থেকে কমিয়ে আট ডলারে নামিয়ে আনতে বাধ্য হয়েছিল। তাতে খাদ্য গ্রহণের মাত্রা মারাত্মকভাবে কমে যায় এবং ২০১৭ সালের পর শিশুদের মধ্যে অপুষ্টির হার ১৫ শতাংশ ছাড়িয়ে যায়। নতুন অর্থায়ন পাওয়ার পর রেশন আবার কিছুটা বাড়ানো হয়।
এখন আবার সেই পরিস্থিতি তৈরি হলে নারী ও শিশুরা পুষ্টিহীনতার শিকার হবে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন রোহিঙ্গা নেতারা।
আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস অ্যান্ড হিউম্যান রাইটস এর চেয়ারম্যান মোহাম্মদ জুবায়ের বলেন, “রেশন কমানোর খবর শুনে আমি বাকরুদ্ধ। বরাদ্দ সাড়ে ১২ ডলার থেকে ছয় ডলারে আনা হলে রোহিঙ্গাদের বেঁচে থাকা অসম্ভব হয়ে পড়বে। অথচ সাড়ে ১২ ডলারও পুষ্টিকর জীবনযাপন করার জন্য যথেষ্ট নয়।”
পাশাপাশি ক্যাম্পের বাসিন্দাদের নানা ধরনের অপরাধ ও অবৈধ ব্যবসায় জড়িয়ে পড়া শঙ্কা তুলে ধরে জুবায়ের বলেন, “আমরা এখানে কারও আর্থিক সহায়তার উপর বেঁচে থাকতে চাই না। আমরা আমাদের দেশে ফিরে গিয়ে নিজেদের খাদ্য নিজেরাই জোগাড় করতে চাই।”
আশ্রয়শিবিরের তরুণ রোহিঙ্গা নেতা মুজিবুর রহমান বলেন, “রোহিঙ্গাদের আর কোনো আয়ের উৎস নেই। তাদের জীবন সম্পূর্ণভাবে খাদ্য সহায়তার উপর নির্ভরশীল। এমন রমজান মাসে এ ধরনের খবর আমাদের জন্য হতাশাজনক। এখানে দুর্ভিক্ষ শুরু হয়ে যাবে।”
স্থানীয়দের চাপ বাড়বে
রোহিঙ্গাদের সহায়তা কমে আসায় খবরে উদ্বেগ বাড়ছে স্থানীয় জনগোষ্ঠীর মধ্যেও। তারা মনে করছেন, যদি খাদ্যের অভাব হয়, তাহলে রোহিঙ্গারা অবশ্যই বাইরে কাজে যুক্ত হবে। তাতে স্থানীয়রা চাপে পড়বে। রোহিঙ্গাদের সঙ্গে এ নিয়ে সংঘাত-সংঘর্ষের আশঙ্কাও উড়িয়ে দিচ্ছেন না স্থানীয়রা।
কক্সবাজার সিভিল সোসাইটির সভাপতি আবু মোরশেদ চৌধুরী বলেন, “যখন তাদের খাদ্য সহায়তা কমানো হবে, তারা জীবিকার সন্ধানে ক্যাম্প ছেড়ে চলে যাবে। এটা স্থানীয় কর্মসংস্থানে প্রচুর চাপ ফেলবে।”
রোহিঙ্গাদের জন্য এটাকে ‘মানবিক সংকট’ অভিহিত করে এ পরিস্থিতিতে স্থানীয় এবং রোহিঙ্গাদের মধ্যে সংঘর্ষের আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন জাতীয় নাগরিক কমিটির রোহিঙ্গা ও এনজিও বিষয়ক সম্পাদক এস এম সুজা।
তিনি বলেন, “এই পরিস্থিতিতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে রোহিঙ্গাদের মৌলিক মানবাধিকার নিশ্চিত করতে এগিয়ে আসতে হবে। নাহলে এটি বাংলাদেশের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে যাবে।”
অনেক স্থানে স্থানীয়দের বাড়িঘর ঘিরে রোহিঙ্গা আশ্রয়শিবির গড়ে ওঠেছে। বলতে গেলে, আশ্রয়শিবিরের মধ্যে স্থানীয়দের বাড়িঘর। সেক্ষেত্রে তারা একটা অনিরাপত্তার মধ্যেই বসবাস করেন। রোহিঙ্গাদের হাতে স্থানীয়দের অপহরণের অনেক ঘটনাও ঘটেছে বলে মন্তব্য করেন উখিয়ার স্থানীয় অধিকার বাস্তবায়ন কমিটির সভাপতি ইঞ্জিনিয়ার রবিউল হুসাইন।
তিনি বলেন, “উখিয়া টেকনাফের জন্য চুরি, ছিনতাই এখন নিত্যদিনের ঘটনা। যা আরো বিস্তার লাভ করবে। সেই সঙ্গে অপহরণের স্বর্গরাজ্য হয়ে উঠবে এ অঞ্চল। পাশাপাশি ক্যাম্পের ভেতরেও আধিপত্য বিস্তার নিয়ে খুনের ঘটনা বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে।”
কুতুপালং এর স্থানীয় জনপ্রতিনিধি হেলাল উদ্দিন বলেন, “এ অবস্থা থেকে উত্তরণের একমাত্র পথ রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে ফেরত পাঠানো। প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া যতদিন পর্যন্ত কার্যকর না হচ্ছে ততদিন পর্যন্ত রোহিঙ্গাদের ক্যাম্প থেকে বাইরে আসতে না পারার বিষয়টি নিয়ন্ত্রণ করতেই হবে। এখন তো আশ্রয়শিবির থেকে স্থানীয়দের মাঝে মিশে যাওয়ার আশঙ্কা আরো বাড়বে।”
বিকল্প তহবিল ও প্রত্যাবাসন জরুরি
২০১৭ সালের শুরুর দিকে রোহিঙ্গাদের যে পরিমাণ সহায়তা দেওয়া হচ্ছিল তা প্রতিনিয়তই কমছে। সাত বছরে জয়েন্ট রেসপন্স প্ল্যানের চাহিদা অনুযায়ী সহায়তা দিন দিন কমছে বলে তথ্য দেন শরণার্থী বিশেষজ্ঞ ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃ-বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক রাহমান নাসির উদ্দীন।
তিনি বলেন, “এমনিতেই এই প্ল্যান অনুযায়ী তারা এখন যে সহায়তা পায় তা তাদের নিত্যদিনের চাহিদার অর্ধেক। এখন এসে তা সেই অর্ধেকের অর্ধেক হয়ে দাঁড়াবে। সেক্ষেত্রে রোহিঙ্গাদের দৈনন্দিন জীবনের মৌলিক চাহিদায় বড় ধরনের বাধা হবে।
“এ ছাড়া রোহিঙ্গাদের ভরণপোষণের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সরকারের ভর্তুকি দিতে হয়। তার উপর এই যে সহায়তা কমছে তাতে তো আর তাদের না খাইয়ে রাখা যাবে না, তাই বাংলাদেশের অর্থনীতিতে বড় ধরনের চাপ তৈরি হবে এতে করে।”
নৃবিজ্ঞানী নাসির উদ্দীন বলেন, “যুক্তরাষ্ট্রের বাইরে যেসব আন্তর্জাতিক দাতা সম্প্রদায় রয়েছে, যেমন ইউরোপীয় ইউনিয়ন, অস্ট্রেলিয়া, জাপান, কানাডাসহ অন্য যারা আছে, তাদেরকে সহায়তা বাড়াতে বলতে হবে। এ কাজটি করার জন্য বাংলাদেশ সরকারকে একটি ‘অ্যাগ্রেসিভ ডিপ্লোম্যাসি’তে যেতে হবে এবং দ্রুত একটা অ্যাকশন প্ল্যানে যেতে হবে।”
একই মত প্রকাশ করেছেন সাবেক রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন কবীর। তার ভাষ্য, “আমেরিকার ফান্ড তো কমে আসছে। ইন্টারন্যাশনাল ফান্ড তো কমে আসছে। ইন্টারন্যাশনাল ফান্ডের জন্য বলতে হবে। তবে শুধু ইন্টারন্যাশনাল ফান্ড দিয়ে কাজ হবে না। কূটনৈতিকভাবে প্রত্যাবাসনের জন্য চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে।
“কারণ, রেখে দিলে ঝামেলা হবেই। রোহিঙ্গাদের তো আরাকান আর্মির হয়েও ফাইট করতে হয়েছে বাধ্য হয়ে। মিয়ানমারের সরকারের হয়েও ফাইট করতে হয়েছে। তাদের তো অবস্থা খুব খারাপ। সেজন্য ফান্ডের সঙ্গে সঙ্গে প্রত্যাবাসন করা যায় কিনা সেটা দেখতে হবে। প্রত্যাবাসনটা জরুরি।”
তিনি বলেন, “এখন অলটারনেটিভ সোর্স যেগুলো আছে, কানাডিয়ানরা আছে, ইউরোপীয় ইউনিয়ন আছে, ডাচ আছে, অস্ট্রেলিয়া আছে তাদের ওরাও (ইউএন) অনুরোধ করতে পারে। বাকি কিছু, যেটা গ্যাপটা হবে, সেটা আমাদের দিক থেকেও চেষ্টা করতে পারি। দুই দিক থেকেই চেষ্টা করা যেতে পারে।
“যদি কিছুটা সাপোর্ট পাওয়া যায়, তাহলে আমাদের দিক থেকে সহজ হবে। কারণ আমাদের নিজেদের বাজেট দিয়ে চালানো কঠিন হয়ে যাবে। এমনিতেই আমরা বাজেট চাপে আছি। কাজেই এটা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়েরই সমর্থনটা দিতে হবে। সেক্রেটারি জেনারেল পারেন, আমরাও বাই-লেটারালি যারা এখন আছে, তাদের আমরা চেষ্টা করে দেখতে পারি।”
[প্রতিবেদনে তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন নিজস্ব প্রতিবেদক হামিমুর রহমান ওয়ালিউল্লাহ।]