‘বাইরের লোক’ আনোয়ারুজ্জামান সিলেট সিটি নির্বাচনে কতটা সফল হবেন

সিলেট সিটিতে আওয়ামী লীগের প্রার্থী ঘোষণার পর অনেক নেতাই বলছেন, ‘বাইরের লোককে’ মনোনয়ন না দিলেই ভালো হত।

বাপ্পা মৈত্রসিলেট প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 15 April 2023, 06:05 PM
Updated : 15 April 2023, 06:05 PM

সিলেট সিটিতে মেয়র পদে টানা দুটি নির্বাচনে জেতা বিএনপি নেতা আরিফুল হক চৌধুরী আবার ভোটে দাঁড়াবেন কি-না, এ নিয়ে আলোচনার মধ্যে আরও একটি প্রশ্ন সামনে এল। যদি আরিফুল আবার দাঁড়ান, তাকে মোকাবিলায় নৌকা প্রতীক পাওয়া আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী কতটা সফল হবেন?

পৌরসভা ও সিটি করপোরেশন মিলিয়ে তিনবার জয় পাওয়া প্রয়াত আওয়ামী লীগ নেতা বদর উদ্দিন আহমেদ কামরান পরের দুইবার হোঁচট খান আরিফুলের কাছেই। এর মধ্যে বিশেষ করে ২০১৮ সালের ভোটে দলীয় কোন্দলের বিষয়টি সামনে আসে। কামরান দলের প্রশ্নাতীত সমর্থন পাননি বলে আলোচনা ছিল।

সেই দ্বন্দ্বের বিষয়টি এবারও আছে। প্রকাশ্যেই কয়েক ভাগে বিভক্ত সিলেট আওয়ামী লীগ। আনোয়ারুজ্জামানকে প্রার্থী করার পর দলের সিদ্ধান্ত মেনে নিয়েও অনেক নেতাই তাকে ‘বাইরের মানুষ’ বলছেন।

দলকে এক করতে না পারলে ভোটে প্রভাব পড়বে, এমন কথা বলেছেন মহানগর আওয়ামী লীগের একজন শীর্ষস্থানীয় নেতাও।

সবশেষ পাঁচটি নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ‘স্বয়ংক্রিয় পছন্দ’ কামরান করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মারা যান ২০২০ সালের ১৫ জুন। ফলে এবার নতুন কাউকে বেছে না নেওয়ার উপায় ছিল না।

ক্ষমতাসীন দলে আগ্রহী প্রার্থীর অভাব পড়েনি। পরে যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক আনোয়ারুজ্জামানকে উপযুক্ত মনে করে দলের স্থানীয় সরকার মনোনয়ন বোর্ড।

আগামী ২১ জুনের ভোটে প্রার্থীদের মনোনয়নপত্র দাখিলের শেষ সময় ২৩ মে। তা বাছাই হবে দুদিন পর।

আওয়ামী লীগে বিভক্তি

নির্বাচনের মাস কয়েক আগে থেকেই মনোনয়নকে কেন্দ্র করে নগর আওয়ামী লীগ একাধিক ধারাতে বিভক্ত।

গত ২২ জানুয়ারি থেকেই সিলেটে আগাম প্রচার শুরুর পর থেকেই আনোয়ারুজ্জামান ও তার সমর্থকরা মনোনয়নের ব্যাপারে দলের ‘সবুজ সংকেত’ পাওয়ার দাবি করতে থাকেন। এ নিয়ে মনোনয়ন প্রত্যাশী একাধিক নেতা ও সমর্থকদের মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়।

আনোয়ারুজ্জামান গত দুটি সংসদ নির্বাচনে সিলেট ২ আসন (ওসমানীনগর-বিশ্বনাথ) থেকে মনোনয়নের চেষ্টা করেছিলেন।

সিলেট মহানগর আওয়ামী লীগের সম্পাদকমণ্ডলীর এক নেতা জানান, নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সিলেট আওয়ামী লীগে কোন্দল চরম পর্যায়ে রয়েছে। নগরের অনেক নেতাই চাচ্ছেন না বাইরের কেউ এসে নির্বাচন করুন।

তার প্রশ্ন, “সিলেট-৩ আসনে লন্ডন প্রবাসী হাবিবুর রহমান হাবিব এমপি হয়েছেন। সিলেট ১ আসনে পররাষ্ট্রমন্ত্রীও প্রবাসী ছিলেন। এখন সিটি নির্বাচনেও প্রবাসী তাহলে স্থানীয়দের রাজনীতি করে কী হবে! স্থানীয় নেতাদের ভবিষ্যৎ কী?”

আনোয়ারুজ্জামান নগরে প্রচার শুরুর পর মেয়র প্রার্থী নিয়ে ‘বিভ্রান্তি না ছড়াতে’ নগর আওয়ামী লীগ বিবৃতিও দিয়েছিল। এক পক্ষে আছেন কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের এক সাংগঠনিক সম্পাদক, মহানগর শাখার সহসভাপতি, যুগ্ম সম্পাদক, জেলার সাংগঠনিক সম্পাদক এবং জেলা ও মহানগর যুবলীগ ও ছাত্রলীগের নেতারা।

আরেক দিকে আছেন মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক, জেলার সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকসহ অনেক নেতাকর্মী।

এ ‘কোন্দল’ মেটাতে না পারলে নির্বাচনের ফলাফল কী হবে, তা নিয়ে শঙ্কিত নগর আওয়ামী লীগের সম্পাদকমণ্ডলীর সেই সদস্য।

‘মাঠের রাজনীতির কাউকে প্রার্থী করাই ভালো হত’

মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি মাসুক উদ্দিন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “নেত্রী যাকে মনোনয়ন দিয়েছেন আমরা মেনে নিয়েছি। আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করব। তবে সিলেটের মাঠের রাজনীতির কাউকে প্রার্থী করা হলে ভালো হত।

“যিনি মনোনয়ন পেয়েছেন তাকে অনেক নেতাকর্মীই চেনেন না বিদেশে থাকার কারণে। তবে আমরা তাদের (স্থানীয় নেতা-কর্মী) বলছি, উনি দীর্ঘদিন ধরে সিলেটের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত রয়েছে। তাই নির্বাচনে এসব কিছু প্রভাব ফেলবে না।”    

মনোনয়ন প্রত্যাশী মহানগর আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক এ টি এম এ হাসান জেবুল বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “যাকে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে উনি শহরের না, বাইরের লোক। আর এর আগের নির্বাচনে যারা দলে কোন্দল তৈরি করেছিল পরে তাদের পুরষ্কৃত করা হয়।”

আনোয়ারুজ্জামান বিরোধী অংশের আরেক নেতা বলেন, “মেয়র প্রার্থী নিয়ে মনোনয়ন পাওয়াকে আমাদের কাছে ‘উড়ে এসে জুড়ে বসা’র মতই মনে হচ্ছে। এ নিয়ে সিলেট আওয়ামী লীগের প্রথম সারির অনেক নেতা ক্ষুব্ধ। আমরা যারা এতদিন ধরে মাঠে আছি তাদের কী হবে?” 

তবে মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জাকির হোসেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “সিলেট মহানগর আওয়ামী লীগে কোনো কোন্দল নেই। নৌকা হচ্ছে উন্নয়নের প্রতীক; তাই নৌকাকে আমরা বিজয়ী করব। আমি সিলেটসহ আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পাওয়া পাঁচজনকে অভিনন্দন জানাই।”  

নগরীর বন্দরবাজরের ব্যবসায়ী আমজাদ হোসেন বলছেন, কামরান টানা দুটি নির্বাচনে পরাজিত হওয়ার পরও মানুষের সঙ্গে সম্পর্ক রেখে চলেছেন। তিনি বের হলেই ভীড় লেগে যেত। তিনি মারা যাওয়ার পর সিলেটে এ রকম ঘটনা আর দেখা যায়নি।

দলীয় প্রার্থীকে অভিনন্দন ও শুভকামনা জানিয়ে মনোনয়নের আশায় থাকা মহানগর আওয়ামী লীগের সহসভাপতি আসাদ উদ্দিন ফেইসবুকে লিখেছেন, “এতদিনের পথচলায় যারা আমাকে সহযোগিতা করেছেন, প্রার্থী হতে পরামর্শ, দিক-নির্দেশনা দিয়েছেন সকলের প্রতি অফুরন্ত কৃতজ্ঞতা ও ভালোবাসা। আমি এবং আমার পরিবার সবসময় আমাদের নেত্রী, বঙ্গবন্ধু কন্যা, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার সকল সিদ্ধান্তের প্রতি অতীতেও অনুগত ছিলাম, আজও আছি, ভবিষ্যতেও থাকব ইনশাআল্লাহ।”

আনোয়ার সমর্থকদের উল্লাস

শনিবার আনোয়ারুজ্জামান মনোনয়ন পাওয়ার পর পর নগরীতে আনন্দ মিছিল করেছেন তার সমর্থকরা। বিকালে শহরের কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার থেকে বের হওয়া মিছিলটি কোর্ট পয়েন্টে গিয়ে শেষ হয়।

এতে জেলা ও মহানগর আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ, ছাত্রলীগ, তাঁতী লীগের উল্লেখযোগ্য সংখ্যক নেতা-কর্মী উপস্থিত ছিলেন। 

তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় আনোয়ারুজ্জামান উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রাখতে নগরবাসীকে নৌকা প্রতীকে ভোট দেওয়ার আহ্বান জানান। বিশেষ করে প্রবাসী বাংলাদেশিদের সহযোগিতা চেয়েছেন তিনি।

তিনি বলেন, “সিলেটের পরিকল্পিত উন্নয়নের জন্য একটি মাস্টারপ্ল্যান করে আগামীতে বিশেষজ্ঞদের মতামতকে প্রাধান্য দিয়ে একটি আদর্শ নগরী গড়ে তুলব।”

আরিফুল কী করবেন

নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবাধায়ক সরকারের দাবি না মানলে জাতীয় নির্বাচনে অংশ না নেওয়ার ঘোষণা আছে বিএনপির। বর্তমান নির্বাচন কমিশনের অধীনে কোনো স্থানীয় নির্বাচনেও আসছে না দলটি। ফলে সিটি করপোরেশনের কোথাও তাদের প্রার্থী থাকছে না।

তবে সিলেটে আরিফুল হক চৌধুরী ‘স্বতন্ত্র’ প্রার্থী হিসেবে ভোটে দাঁড়াবেন বলে আলোচনা আছে। যদিও এ ব্যাপারে স্পষ্ট করে তিনি কিছু বলেননি।  

গত মঙ্গলবার লন্ডনে যুবদলের যুক্তরাজ্য শাখার এক আয়োজনে বক্তব্যে আরিফুল বলেন, “এই সরকারের আমলে দুই দুইবার বিএনপির হয়ে মেয়র নির্বাচিত হয়েছি। কিন্তু এবার যেহেতু আমাদের দল এই স্বৈরাচারী সরকার, ফ্যাসিস্ট সরকারের অধীনে নির্বাচনে যাবে না। সেই ক্ষেত্রে আমরা অটল।… তবে, একটি কথা বলে রাখতে চাই। আজকে যুক্তরাজ্যে আসছি মাত্র চারদিন হ্যাঁ, আমার সঙ্গে আমার নেতার (তারেক রহমান) মিটিং হয়েছে। তিনি আমাকে একটা সিগন্যালও দিয়েছেন। সেটা রেড কিংবা সবুজ-সেটা সময়ই বলে দেবে ইনশাল্লাহ। আন্দোলনের মধ্য দিয়ে বিজয় অর্জন করব।

১৩ এপ্রিল আরিফুল সংবাদমাধ্যমকে বলেন, ‘‘নির্বাচনে অংশ নেওয়া না নেওয়ার বিষয়ে এখনও কোনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়নি। দল বর্তমান সরকারের অধীন কোনো নির্বাচনে যাচ্ছে না। আমি দলের কর্মী, বিএনপির সিদ্ধান্তের বাইরে যাওয়ার সুযোগ নেই। তবে যেহেতু আমাকে সিলেট নগরের মানুষ দুইবার নির্বাচিত করেছেন, দল-মতনির্বিশেষে সবার ভালোবাসা পেয়েছি, এই অবস্থায় অনেকেই নির্বাচনে এবারও অংশ নেওয়ার জন্য অনুরোধ করছেন। এখানে (লন্ডন) এসে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের সঙ্গে কথা বলেছি। দেশে ফিরে বিস্তারিত জানাব।”

মেয়র আরিফ লন্ডন থেকে কবে দেশে ফিরবেন এ নিয়ে জেলা ও মহানগর বিএনপির কেউ কথা বলতে রাজি হননি।

পরে সিলেট সিটি করপোরেশনে যোগাযোগ করা হলে একজন কর্মকর্তা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান, রোববার তিনি দেশে ফিরবেন।