“ঘরের তালা ভাঙার পর দেখি, তিনজনকে গলাকেটে মেরে ফেলে রাখা হয়েছে। ধারণা করছি, শনিবার রাতে তাদের হত্যা করা হয়েছে।”
Published : 30 Jan 2024, 04:22 PM
সিরাজগঞ্জে এক দম্পতি ও তাদের মেয়ের খুন হওয়ার ঘটনাটি কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না তাদের পরিবার।
তাড়াশ উপজেলা সদরের বিকাশ সরকার, তার স্ত্রী স্বর্ণা রানী সরকার ও তাদের একমাত্র মেয়ে পারমিতা সরকার তুষিকে ‘কুপিয়ে’ ও ‘গলাকেটে’ হত্যা করা হয়েছে বলে পুলিশ জানালেও তাদের স্বজনরা বুঝতে পারছেন না কেন এমন হয়েছে।
নিজেদের জমিতে কৃষিকাজ ও পুকুরে মাছ চাষ করতেন ৪৫ বছর বয়সী বিকাশ। শনিবার রাত থেকে তিনি ও তার পরিবারের সঙ্গে স্বজনদের কোনো যোগাযোগ ছিল না। পরে বাসার বাইরে থেকে তালা দেখে মোবাইলে ফোন দেওয়াসহ বিভিন্নভাবে যোগাযোগের চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে থানায় খবর দেয় তারা।
মঙ্গলবার ভোরে উপজেলার পৌর শহরের বারোয়ারী বটতলা এলাকার তিনতলা ভবনের তৃতীয় তলার বাসার দরজার তালা ভেঙে তাদের মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। পরে তা ময়নাতদন্তের জন্য সিরাজগঞ্জ শেখ ফজিলাতুন নেছা মুজিব জেনারেল হাসপাতালের মর্গে পাঠানো হয়।
এ খবর ছড়িয়ে পড়লে নিহতদের পরিবারে শোকের ছায়া নেমে আসে; শত শত মানুষ ঘটনাস্থলে ভিড় করতে শুরু করেন। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বেশ কয়েকটি ইউনিট এরই মধ্যে হত্যার রহস্য উদঘাটনে আলামত সংগ্রহ এবং তদন্ত শুরু করেছে। ওই বাড়ির ভেতরে কাউকে ঢুকতে দিচ্ছে না পুলিশ।
বিকাশের বড় ভাই প্রকাশ চন্দ্র সরকার তাড়াশ উপজেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি। তিনি বলেন, “বিকাশ পরিবার নিয়ে কোথাও গেলে আমাকে কিছুই বলে যেত না। শনিবার থেকে তার ফ্ল্যাটে তালা ঝুলতে দেখছি। তিনদিনেও কোনো সাড়া শব্দ না পেয়ে মঙ্গলবার ভোরে প্রতিবেশীদের ডেকে এনে দেখাই ও পুলিশকেও জানাই।
“ঘরের তালা ভাঙার পর দেখি, তিনজনকে গলাকেটে মেরে ফেলে রাখা হয়েছে। ধারণা করছি, শনিবার রাতে তাদের হত্যা করা হয়েছে।”
নিহতের বোন জামাই সমীর কুমার দাস জানান, রাজশাহীর পুঠিয়ায় বিকাশের ভাগ্নি রিমির বিয়ে হয়। স্বামীর বাড়ির লোকেরা রিমিকে মারধর ও নির্যাতন করে বাড়ি থেকে বের করে দেয়। এ ঘটনায় ২০২৩ সালের মাঝামাঝি বিকাশ বাদী হয়ে ভাগ্নিজামাই সুব্রত ও শ্বশুরবাড়ির বাকি স্বজনদের বিরুদ্ধে মামলা করেন।
“ওই মামলায় সুব্রত জেলে আছেন। শুনেছি, রিমির শ্বশুরবাড়ির লোকজন বেশি ভাল না, খারাপ প্রকৃতির। তারাও এ হত্যাকাণ্ড ঘটাতে পারে”, যোগ করেন তিনি।
সমীর বলেন, “শ্বশুরের বিশাল সম্পত্তির ভাগাভাগি নিয়ে বিকাশদের দুই ভাইয়ের মধ্যেও দ্বন্দ্ব রয়েছে। এসব বিষয়ে বেশ কয়েকবার পারিবারিকভাবে সালিশও হয়েছে, কিন্তু সমাধান হয়নি। এ কারণে দুই ভাইয়ের মধ্যে কথা বলাও বন্ধ ছিল। এ শক্রতা থেকেও হত্যাকাণ্ড ঘটতে পারে। আসলে আমরা কিছুই বুঝে উঠতে পারছি না।”
বিকাশ ‘ভদ্র স্বভাবের’ ছিলেন এবং এলাকায় তার কোনো ‘শক্র নেই’ জানিয়ে তাড়াশ উপজেলা পূজা উদযাপন কমিটির সাবেক সভাপতি তপন গোস্বামী বলেন, শনিবার বিকালে দেশীগ্রাম ইউনিয়নের শিবমন্দিরে সভায় এসেছিলেন বিকাশ। কিছুক্ষণ পর তিনজন ব্যক্তির সঙ্গে জরুরি ভিত্তিতে দেখা করতে হবে জানিয়ে তিনি সভা শেষ হওয়ার আগেই বাড়ির দিকে চলে যান। এরপর আর তার সঙ্গে দেখা হয়নি।
তিনি বলেন, “সোমবার রাতে তার বোনজামাই শেরপুরের চণ্ডি বাবু আমাকে ফোন করে জানান, তারা বিকাশের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারছেন না; সবাই শঙ্কায় রয়েছেন। এরপর তার ছেলেকে শেরপুর থেকে আমার কাছে পাঠান। রাত সাড়ে ১২টার দিকে বিকাশের বাসায় গিয়ে দরজায় তালা দেখি।
“ওই সময় বিকাশের মোবাইলে ফোন দিলে ঘরের ভেতর ফোন বাজার শব্দ পাই। এতে আমরা আতঙ্কিত হয়ে থানায় খবর দেই। পুলিশ এসে তালা ভাঙলে বিছানা ও মেঝেতে তিনজনের লাশ পড়ে থাকতে দেখি।”
খবর পেয়ে পাঁচ বোনই বিকাশের বাসায় আসেন। তবে তাদের কেউ হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে কিছু বলতে পারছেন না; শুধু কেঁদে চলেছেন।
বিকাশ, তার ৪০ বছর বয়সী স্ত্রী স্বর্ণা রানী সরকার ও ১৫ বছর বয়সী মেয়ে তাড়াশ সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণির ছাত্রী পারমিতার লাশ উদ্ধারের পর তাড়াশ থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মো. নূরে আলম জানান, রোববার রাত থেকে সোমবার দিনের কোনো এক সময় তিনজনকে কুপিয়ে ও গলাকেটে হত্যা করা হয়েছে বলে আপাতত ধারণা করা হচ্ছে।
সিরাজগঞ্জে তালাবদ্ধ বাসায় স্বামী-স্ত্রী ও মেয়ের গলাকাটা লাশ
পুলিশ, সিআইডি, ডিবি পুলিশ ও পিবিআই ঘটনাস্থল থেকে বিভিন্ন আলামত সংগ্রহ করেছে এবং মামলার প্রস্তুতি চলছে বলে তাড়াশ থানার ওসি নজরুল ইসলাম জানিয়েছেন।
সিরাজগঞ্জের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার সামিউল ইসলাম জানান, বিকাশের ভাগ্নি জামাইয়ের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের, নিজের পরিবারের এবং ব্যবসা-বাণিজ্য সংক্রান্ত দ্বন্দ্ব মাথায় রেখে তদন্ত চলছে।
তিনি বলেন, “আমরা ওই ভবনের নিচের দুই তলার ভাড়াটিয়া, আশপাশের লোকজন ও নিহতদের স্বজনদের জিজ্ঞাসাবাদ করছি। পুলিশের কয়েকটি দল সেখানে কাজ করছে।”