১৯৭১ সালের ৩ এপ্রিল সকালে বেনাপোল জিরো পয়েন্টে উড়িয়ে দেওয়া হয় বাংলাদেশের পতাকা।
Published : 30 Nov 2022, 11:18 PM
মুক্তিযুদ্ধের পুরোটা সময়ই সবুজ জমিনে লাল সূর্য, মাঝে বাংলাদেশের মানচিত্র – এই পতাকা পতপত করে উড়েছে বেনাপোলের আকাশে।
পতাকাটি নামিয়ে ফেলতে বারবার আক্রমণ চালিয়েছে হানাদার বাহিনী; দিনের পর দিন যুদ্ধ চলেছে; কিন্তু বুকের রক্তে এই পতাকা নয় মাস অক্ষত রেখেছিলেন বাংলার মুক্তিকামী মানুষ।
তবে বিজিবি ক্যাম্পের সামনের এই স্থানে এখন বাংলাদেশে পতাকা উড়লেও সে সময়ের স্মৃতি হিসেবে বিশেষভাবে সংরক্ষণের কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
পতাকাটি উত্তোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন এমন দুই জন মুক্তিযোদ্ধা এখনও বেঁচে আছেন। তাদের একজন বেনাপোলের মুক্তিযোদ্ধা দ্বীন ইসলাম মল্লিক (৮২) এবং অপরজন মোহাম্মদ আলি মাস্টার (৭৭)।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের কাছে যুদ্ধদিনের সেই নয় মাসের স্মৃতিচারণ করেছেন তারা।
দ্বীন ইসলাম মল্লিক জানান, বেনাপোল চেকপোস্ট ইপিআর ক্যাম্পের ইনচার্জ সুবেদার মোশারেফ হোসেনের নেতৃত্বে ১৯৭১ সালের ৩ এপ্রিল সকালে বেনাপোল জিরো পয়েন্ট এলাকায়, বর্তমান বিজিবি আইসিপি ক্যাম্পের সামনে, বাঁশের খুঁটিতে উড়িয়ে দেওয়া হয় সেই পতাকা।
“ঢাকায় পাকসেনাদের হামলার খবর ছড়িয়ে পড়ার পর আমরা উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ি। ২৭ মার্চ বেনাপোল ইপিআর ক্যাম্পের সুবেদার মোশারেফ হোসেন তিনজন ইপিআর সদস্য নিয়ে ক্যাম্প থেকে সশস্ত্র অবস্থায় বেরিয়ে এসে আমাদের সংগঠিত করে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার সাহস ও অনুপ্রেরণা যোগান।
“৩০ মার্চের মধ্যে আমাদের সঙ্গে আরও ১৪-১৫ জন যোগ দেন। ১ এপ্রিল সুবেদার মোশারেফ আমাদের নিয়ে যান বেনাপোলের বিপরীতে ভারতের জয়ন্তীপুর ফুটবল মাঠের শরণার্থী ক্যাম্পে। সে সময় মোজাম্মেল হোসেন, আবদুর রশিদ, ছাত্রনেতা মোহাম্মাদ আলীও আমাদের সঙ্গে ছিলেন। ওখান থেকে এসে ৩ এপ্রিল আমরা সীমান্তে পতাকা উত্তোলন করি।”
বীর মুক্তিযোদ্ধা মোহাম্মদ আলি মাস্টার বলেন, “বেনাপোল চেকপোস্টের ইপিআর ক্যাম্পের সামনে যে পাকিস্তানি পতাকা উড়েছিল তা নামিয়ে আমি ছিঁড়ে ফেলি। বাংলাদেশি পতাকা উত্তোলনের সময় পেট্রাপোল ও বেনাপোলের বহু মানুষ সেখানে উপস্থিত ছিলেন।
“মুক্তিযোদ্ধা মোফাজ্জল হোসেন বাবলু, সাবেক সংসদ সদস্য আলি কদর, আওয়ামী লীগ নেতা ডা. আব্দুল হাই, আব্দুল করিম চেয়ারম্যান, আইউব হোসেন মেম্বার ও পেট্রাপোলের সামছুর রহমান মুক্তিযুদ্ধের সব পক্ষের লোক হিসেবে সেখানে উপস্থিত ছিলেন।
"পতাকা উত্তোলনের পর সবাই বেনাপোল হাইস্কুলে এসে একটি দোয়া অনুষ্ঠান করি।"
সাব সেক্টর কমান্ডার তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী সেই পতাকা সম্পর্কে ‘যশোর জেলার ইতিহাস’ বইতে লিখেছেন, “এপ্রিল মাসের শেষের দিকে যখন মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য আমাদের জনশক্তি সীমান্তের ওপারে চলে যায়, তখন বেনাপোল সীমান্তের উড্ডীয়মান পতাকাকে আমরা অসহায়ভাবে ফেলে যাইনি।
“মে মাসের প্রথমার্ধে যখন মুক্তিবাহিনীর পুনর্বিন্যাস চলছিল তখন এই পতাকা সংরক্ষণের ভার নিয়েছিলেন ভারতীয় বিএসএফের ১৮ ব্যাটালিয়ন কমান্ডার লেফটেন্যান্ট কর্নেল মেং সিং বীরচক্র। এই রাজপুত অফিসার আমাদের পতাকাকে সম্মান দিয়ে মুক্তিসংগ্রামের প্রতি তার শ্রদ্ধা প্রকাশ করেছিলেন। ১৮ বিএসএফ দুই দেশের দুটি পতাকা কভার করে রেখেছিল। কাক-পক্ষিও তার কাছে ভিড়তে পারেনি।
“সকাল-দুপুর-সন্ধ্যা বা গভীর রাতে মেশিনগান গর্জে উঠত, যদি তার আশপাশে সামান্যতম কোনো গতিবিধি পরিলক্ষিত হত। এই পতাকা ধ্বংস করার জন্য পাকিস্তানিদের সমস্ত চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে। এ জন্য কতজন যে হতাহত হয়েছে তা ঠিকভাবে বলা মুশকিল। এই পতাকা নিয়ে বেনাপোল সীমান্ত থাকত সব সময় সরগরম। আমাদের অনাগত দিনের বিজয়ের প্রতীক ছিল এই পতাকা।”
তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী লিখেছেন, জুন-জুলাইয়ে বেঙ্গল রেজিমেন্ট বেনাপোল সীমান্ত থেকে বিদায় নিয়ে বাংলাদেশের উত্তর সীমান্তে চলে যায়।
“ওই সময় পতাকাটি বেনাপোল সীমান্তে একটি স্বীকৃত সত্য হয়ে গিয়েছিল। এরপর ভারতীয় সেনাবাহিনী ও মুক্তিযোদ্ধারা মিলে যৌথভাবে এই পতাকা সংরক্ষণের দায়িত্ব নেয়। বেনাপোল সীমান্ত থেকে প্রায় ৮০০ গজ জায়গা এ সময় জিরো লাইনে পরিণত হয়।”
‘যশোর জেলার ইতিহাস’ বইয়ে সেই পতাকা রক্ষার লড়াইয়ের কথা লিখেছেন মুক্তিযোদ্ধা হাফিজ উদ্দিন আহম্মেদ।
“২৩ এপ্রিল পাকিস্তানি বাহিনীর দুই ব্যাটালিয়ন সৈন্য বেনাপোলের কাগজপুকুর এলাকায় মুক্তিবাহিনীর মূল ঘাঁটিতে আঘাত করে। এখানে ছয় ঘণ্টা তুমুল যুদ্ধ হয়। এ যুদ্ধে মুক্তিবাহিনীর ১৫ জন শহীদ হন। ইপিআর বাহিনীর নায়েক সুবেদার মজিবুল হক এ যুদ্ধে শহীদ হন। বাংলাদেশ সরকার তাকে 'বীর বিক্রম' উপাধি প্রদান করে। এর পরবর্তী ১৫ দিন পাকিস্তানিরা বেনাপোল কলোনি ওচেকপোস্ট এলাকা দখলে নেওয়ার জন্য বহুবার আক্রমণ করে। কিন্তু প্রত্যেক বারই তাদের আক্রমণের পাল্টা জবাব দিই এবং প্রতিহত করি। এই আক্রমণের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল চেকপোস্টের দখল নিয়ে সেখানে পাকিস্তানি পতাকা উত্তোলন করা। কিন্তু তাদের সে চেষ্টা ব্যর্থ হয় এবং বাংলাদেশের পতাকাই উড়তে থাকে। এ এলাকা তারা কখনও দখল করতে পারেনি। এখানকার যুদ্ধে বিভিন্ন সময়ে আক্রমণ পাল্টা আক্রমণে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর প্রায় ১০০ জন সৈন্য নিহত হয়। আমার ১০ জন সৈন্য শহীদ হন। কিন্তু এলাকাটি কখনও পাকিস্তানিদের দখলে যায়নি।”
স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের দুঃখ, বাঙালির মুক্তি সংগ্রামের সাক্ষী সেই স্থানটির কোনো চিহ্ন এখন আর নেই। সেখানে এখন বিজিবি ক্যাম্পের কংক্রিট ইয়ার্ড।
ইতিহাস রক্ষায় ওই স্থানটি যথাযথভাবে সংরক্ষণের জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে দাবি জানিয়েছেন শার্শা উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কমান্ডার মোজাফ্ফর হোসেন।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “স্থানটি আজও আমাদের স্মৃতিতে অম্লান। এটা যেহেতু বিজিবি আইসিপির সামনে তাই এর সংরক্ষণে সরকারের উদ্যোগী হওয়া কর্তব্য।”
মুক্তিযোদ্ধা সংসদ সন্তান কমান্ড, কেন্দ্রীয় কমিটির নির্বাহী সদস্য ফারুক হোসেন উজ্জ্বল বলেন, “বেনাপোল চেকপোস্টের বাংলার মানচিত্র খচিত পতাকার দখল নিতে হানাদার পাকবাহিনী বিভিন্নভাবে চেষ্টা করে; কিন্তু অকুতোভয় মুক্তিযোদ্ধারা সেটা হতে দেয়নি। এটা আমাদের এক অনন্য গর্ব ও অহংকারের বিষয়।
“বাঙালির চিরমুক্তির প্রতীক অম্লানঅর্জন স্থানটি চিহ্নিতকরণ এবং স্মৃতিস্তম্ভ তৈরি করে নতুন প্রজন্মকে ইতিহাস জানার অধিকার প্রতিষ্ঠায় সরকারের কাছে জোর দাবি জানাচ্ছি।”
শার্শার উপজেলা চেয়ারম্যান মুক্তিযোদ্ধা সিরাজুল হক মঞ্জু বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “বিষয়টি আমাদের মনে আছে। এ ব্যাপারে একটি পরিকল্পনা প্রক্রিয়াধীন।”